স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজির) সিংহভাগ চাহিদা স্থানীয় গ্যাসে পূরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পুরনো ও নতুন কিছু কূপের সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে, কয়েকটির চলছে। নতুন করে খনন করা হচ্ছে আরো প্রায় দেড় ডজন কূপ। এসব উদ্যোগ সফল হলে আগামী বছরের মাঝামাঝি জাতীয় গ্রিডে স্থানীয় উৎস থেকে গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে। দেরিতে হলেও সরকারের নেয়া এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে হবে। বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে নতুন ও পুরনো কূপ সংস্কারের মাধ্যমে স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ও নতুন অনুসন্ধান চালানোর কথা বলে আসছিলেন। কিন্তু সরকার তাদের কথা আমলে না নিয়ে আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়ে। শুরুতে পরিস্থিতি অনুকূল থাকলেও হঠাৎ করে গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। ভর্তুকি ও গ্যাসের দাম বাড়িয়েও তা সামাল দেয়া সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়লে স্পট মার্কেট থেকে গ্যাসের আমদানি বন্ধ করে দেয়া হয়। এখন জ্বালানি বিভাগ সতর্ক হয়েছে এবং স্থানীয় গ্যাস আহরণে দৃষ্টি দিয়েছে। প্রত্যাশা থাকবে বিদ্যমান উৎস থেকে গ্যাস আহরণ বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানও জোরদার করা হবে।
এক গবেষণায় বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনের যেসব কূপ বন্ধ হয়ে গেছে, সেগুলো থেকে সেকেন্ডারি রিকভারি করে আবার গ্যাস উত্তোলন সম্ভব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। কাতার, নরওয়ে বা মেক্সিকোর মতো বিশ্বের গ্যাস উৎপাদনকারী অনেক দেশই ‘প্রাইমারি রিকভারি’ শেষে সেকেন্ডারি রিকভারির মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন করছে। বাংলাদেশের যেসব গ্যাসকূপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সেগুলো থেকে প্রাইমারি রিকভারির মাধ্যমে ৫০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। বাকি অর্ধেক গ্যাস এখনো রয়ে গেছে। বিশ্বজুড়েই গবেষণা বলছে, প্রাথমিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হয়। পরবর্তী আরো দুটি ধাপে উত্তোলন করলে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো এ রকম কোনো চেষ্টা কখনো করেনি। এবার করবে বলে পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে, যা ইতিবাচক। সরকারের উচিত প্রাইমারি রিকভারির মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া। কারণ দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। বাড়তি চাহিদা পূরণে গ্যাস উৎপাদনকারী বিদেশী কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা যেমন বাড়ছে, একই সঙ্গে এলএনজি আমদানির দিকেও ঝুঁকছে দেশ। এ আমদানিনির্ভরতা ভবিষ্যতে ঝুঁকির কারণ হতে পারে। তাই গ্যাস উৎপাদনে সরকারকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। মনে রাখা উচিত, টেকসই জ্বালানি নিশ্চিত করতে নিজস্ব উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। আমাদের যে গ্যাসক্ষেত্রগুলো রয়েছে, সেগুলো থেকে উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে গ্যাস অনুসন্ধান এবং উন্নয়নও জোরদার করতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার জরিপে বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত বিপুল গ্যাস সম্পদের কথা উঠে এসেছে নানা সময়ে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, সরকার কারো জরিপই বিবেচনায় নেয়নি। বরং দেশের জ্বালানি খাতকে ক্রমে ব্যয়বহুল আমদানিনির্ভর করে তোলা হয়েছে। ফলে জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত গ্যাস জরিপ প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যায়নে বাংলাদেশে বিপুল গ্যাসের মজুদ থাকার মত প্রকাশিত হয়েছে। হতাশাজনক হলেও সত্য, এসব গবেষণা উপাত্ত বিবেচনায় নিয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা হয়নি। ফলে যথেষ্ট মাত্রায় গ্যাস অনুসন্ধান না হওয়ার কারণে আজ গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে গ্যাস সম্পদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা কম অনুসন্ধানকৃত দেশগুলোর একটি। যথেষ্ট অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভূগর্ভে লুক্কায়িত গ্যাস উত্তোলন করলে গ্যাস সংকট থাকার কথা নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে যে পরিমাণ গ্যাস মজুদ আছে, তা দিয়ে আনুমানিক ৯-১০ বছর চলবে। স্বাভাবিকভাবেই এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খোঁজা জরুরি। যদিও এলএনজি আমদানির মতো সাময়িক সমাধানের মাধ্যমে জরুরি চাহিদা মেটানো যায়। তবে সেটি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত গ্যাসের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ব্যয়বহুল এবং এ পদ্ধতি জ্বালানি নীতির মূল ভিত্তি হতে পারে না। ২০১১ সালে পরামর্শক নিয়োগ করে তৈরি করা ‘গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধিতে পরামর্শ’ প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো আমলে নেয়া প্রয়োজন। সেখানে বর্তমান কূপগুলো রক্ষণাবেক্ষণ বা ওভারহোলিং, সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারে রিস্ক বেজড পদ্ধতির ওপর জোর দিতে বলা হয়েছিল।
ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ নিজস্ব উৎস থেকে জ্বালানি জোগানোতেই বেশি দৃষ্টি দিয়েছে। ভিয়েতনাম বর্তমানে নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লা ব্যবহারের মাধ্যমে মোট বিদ্যুতের যথাক্রমে ৩১ ও ২৬ শতাংশ উৎপাদন করছে। দেশটিতে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জলবিদ্যুতের অবদান ৪১ শতাংশ। বাকি ২ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে খুব সামান্য পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি করা হয়। এখন দেশটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহারে আরো বেশি জোর দিয়েছে। একইভাবে কম্বোডিয়াও নবায়নযোগ্য জ্বালানি তথা সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ ও জলবিদ্যুৎ ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্প খাতের জ্বালানি চাহিদা মেটাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায়ও সমরূপ অবস্থা। দেশটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লার প্রাধান্য থাকলেও ধীরে ধীরে জলবিদ্যুৎ ও জিওথার্মালের ব্যবহার বাড়ছে। এসব ক্ষেত্রে তারা দেশীয় উৎসনির্ভর। ফলে সেসব দেশে জ্বালানি ব্যয় আপেক্ষিকভাবে কম। এটি তাদের অর্থনীতিকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে।
সরকার এত দিন দাবি করেছে, দেশীয় উৎস কমে আসায় গ্যাসভিত্তিক শিল্পায়নের চাকা সচল রাখতে ব্যয়বহুল এলএনজি ও জ্বালানি তেল আমদানির বিকল্প কোনো পথ খোলা ছিল না। কিন্তু এখন স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি কমিয়ে আনতে স্থানীয় উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে। জ্বালানি চাহিদা পূরণে অতিমাত্রায় আমদানির ওপর জোর দিলেও পুরনো গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর উন্নয়ন ও নতুন গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান এবং উত্তোলনে গত এক যুগে সরকারের তেমন উদ্যোগ ছিল না। অথচ ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে এ সময়ে ৭০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। এর কিছু অর্থও যদি দেশের জ্বালানি সম্পদ উন্নয়ন ও উত্তোলনে ব্যয় করা হতো, তাহলে আজ জ্বালানি খাতে এতটা ঝুঁকি থাকত না। দেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়নে একমাত্র রাষ্ট্রীয় পেট্রোলিয়াম কোম্পানি বাপেক্সের অবদান ও সক্ষমতা উপেক্ষা করা যায় না। বাপেক্সকে শক্তিশালী করে তেল ও গ্যাস খাতের উন্নয়নে কাজে লাগানোর প্রস্তাব দীর্ঘদিনের। বাপেক্সের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হলে যে ধরনের বিশেষজ্ঞ, দক্ষ জনবল এবং লজিস্টিক সাপোর্ট দরকার, তা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশেল সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর তারা সমুদ্রের ব্লকগুলো থেকে জ্বালানি আহরণ শুরু করতে সক্ষম হলেও সরকার এখনো সমুদ্রে প্রয়োজনীয় জরিপকাজ, ব্লক ইজারার মতো প্রাথমিক কার্যক্রমও সম্পন্ন করতে পারেনি। অথচ ব্লু-ইকোনমি নিয়ে আমরা জাতিকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছি। দেশীয় গ্যাস, কয়লা ও সম্ভাব্য তেল ক্ষেত্র অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও উত্তোলন করে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়নে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে। সে সঙ্গে জ্বালানি খাতে পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাব্য সব বিকল্প উদ্যোগগুলোয় আরো মনোযোগ ও বিনিয়োগ করতে হবে। জলবিদ্যুৎ, সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দূষণসহ জীবাশ্ম জ্বালানির নানামাত্রিক জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ক্ষতি কমিয়ে আনার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব-দ্বীপ হওয়ায় বাংলাদেশে বিপুল গ্যাস থাকার কথা। তবু দেশের উপকূলীয় বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গ্যাসের মজুদ আছে কিনা তা অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা বিরোধ মিটে যাওয়ার পরও আমরা সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করিনি। এজন্য জরিপের বিষয়টি ২০১৫ সাল থেকে আলোচনা হলেও তা এখনো হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) গত দুই বছরে মাত্র একটি কূপ খনন করেছে, যদিও তাদের এক বছরে তিন-চারটি অনুসন্ধান কূপ খননের সক্ষমতা রয়েছে। এমনকি নতুন কোনো এলাকায়ও তারা সিসমিক জরিপ পরিচালনার বড় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। নতুন গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনীহা ও অদক্ষতা খুবই স্পষ্ট। সরকার এসব সমস্যার দিকে নজর না দিলে, ভবিষ্যতে গ্যাস সংকট সমাধান কঠিন হয়ে পড়বে। জরুরি কিছু খাতের সাময়িক সংকট মেটাতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত গ্যাসের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে সরকার এলএনজি আমদানি করতেই পারে। তবে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে দেশে গ্যাসের মজুদ অনুসন্ধানের বিকল্প নেই।
প্রাথমিক জ্বালানিতে আমাদের গত এক দশকে বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগ হয়নি। অথচ অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে। এসব খাতে বিনিয়োগ করে সুফলও কম। দেশের অনেক জায়গায় গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে, কিন্তু এসব লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা যায়নি। অথচ এ পরিমাণ অর্থ গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে বিনিয়োগ করা গেলে সেখান থেকে নিশ্চিতভাবেই ইতিবাচক ফল পাওয়া যেত। সমস্যা-সংকট থাকবেই। প্রয়োজন হচ্ছে সমস্যাকে যথার্থভাবে চিহ্নিত করা এবং তাকে আন্তরিকভাবে আমলে নিয়ে সমাধানের পথ খোঁজা। আমরা আশা করব, সরকার গ্যাস সরবরাহের সংকটকে অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে চিহ্নিত করে এর সমাধানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হবে।