অনিয়ম-দুর্নীতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

উচ্চশিক্ষায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কঠোর হোক

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসনস্বল্পতায় নব্বইয়ের দশকে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া শুরু হয়। যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য সামনে রেখে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যাত্রা করেছিল তার অধিকাংশই অর্জিত হয়নি। বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনীয় শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি না করেই লোভনীয় অফার বিজ্ঞাপনে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করছে। অধিকাংশই মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করেই উচ্চ শিক্ষার সনদ দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, বিদ্যমান শিক্ষা নীতিমালা আইন বাস্তবায়ন না করে শুধু ভ্যাট আদায় করেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির বৈধতা দিতে চায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বছরের পর বছর নানাভাবে অনৈতিক সার্টিফিকেট জালিয়াতি বাণিজ্য চালিয়ে গেলেও ইউজিসি মন্ত্রণালয় কার্যত নিষ্ক্রিয়। অধিকন্তু অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা ভিসি নিয়োগ নিয়ে উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্বার্থদ্বন্দ্ব, মামলা দখলবাজি চলছে। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা অনিশ্চয়তার সম্মুখীন। সরকারের অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে এটি বড় প্রতিবন্ধক। উচ্চ শিক্ষায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে সক্রিয় হতে হবে। 

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান, পরিবেশ, ব্যবস্থাপনাগত আয়োজন নিয়ে শুরু থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন কার্যকর করার নানা উদ্যোগ নিয়ে থাকলেও আইন বিধি-বিধানের নানা ফাঁকফোকর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার পথ থেকে খুব বেশি বিরত থাকছে না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই আইন কার্যকর করতে গড়িমসি করছে এবং নানা অজুহাত দেখিয়ে চলছে। প্রায় সবকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে মালিকের প্রভাব, ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং ফাঁকফোকরের আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে। আবার কোনো কোনোটি বিধিবদ্ধ পর্ষদ কিংবা কর্তৃপক্ষের শর্ত পূরণ দেখালেও মালিকের প্রভাব এবং ইচ্ছা পূরণ করার বাইরে কোনো পর্ষদ, উপাচার্য অন্যান্য পদে অবস্থিত ব্যক্তিরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে মোটেও সক্ষম নন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড আর্টিকলস (রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস) অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় একটি দাতব্য, কল্যাণমুখী, অবাণিজ্যিক অলাভজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শর্ত কতটা পূরণ করছে সেটি কারো অজানা নয়। যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপেক্ষাকৃত সুনাম সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোয় হাজার হাজার শিক্ষার্থী বছরে একাধিক সেমিস্টারে ভর্তি হচ্ছেন। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, চাকচিক্য, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া সেমিস্টার টিউশন ফিসহ নানা খাতে আদায়কৃত অর্থেরই মূল উৎস, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে দু-তিনটি ধারায় বিভক্তি রয়েছে। একটি ধারা উচ্চবিত্ত উচ্চমধ্যবিত্তের শিক্ষার চাহিদাকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিনিময়ে পূরণ করছে। আরেকটি ধারা, মাঝারি অবস্থানে শিক্ষার নামে ব্যবসাকে সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিচ্ছে। অন্য ধারার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রধানত অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা সনদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করছে। তিনটি ধারার মধ্যেই বাণিজ্যিক মনোভাব বিশেষভাবে কার্যকর রয়েছে। ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠাকালে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার সামান্যই কেউ কেউ পালন করার চেষ্টা করছে, বাকিরা বাণিজ্যকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। এমন প্রবণতা বন্ধ করতে তদারকি বাড়ানো দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প নেই।

উদ্বেগজনক হলো, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত। এসব দুর্নীতির মধ্যে মোটা দাগে আর্থিক প্রশাসনিক বিষয় ছাড়াও রয়েছে বড় ধরনের একাডেমিক দুর্নীতি। অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অলাভজনক সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানরূপে চলার কথা থাকলেও কৌশলে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (বিওজি) বা মালিক পক্ষ অনেকটা পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মতো সেগুলো চালাচ্ছে। একেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস্তবতা যেমন একেক রকম, সেগুলোর ভূমিকাও যার যার মতো। কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মানদণ্ড আদর্শ খুব একটা মিলিয়ে দেখার সুযোগ নেই। সুতরাং এগুলোর জবাবদিহি করার কর্তৃপক্ষ একমাত্র মালিকরাই নিজেদের মতো করে সাজিয়ে থাকেন। সেখানে রাষ্ট্রীয় আইন, ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিধি-বিধান খুব একটা অনুসৃত হয় না। এগুলোর মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান বোর্ড অব ট্রাস্টিজের নামে পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলোর সব ক্ষমতা আর্থিক হিসাব-নিকাশ মালিক পক্ষ নিজেদের মতো করেই ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। অনিয়ম বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতিই আজকের অবস্থা তৈরি করেছে, দ্রুতই এখান থেকে পরিত্রাণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।

মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিশ্বে, এমনকি এশিয়া মহাদেশের মধ্যেও বাংলাদেশের সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে বর্তমান অবস্থান, তা থেকে উত্তরণে কমপক্ষে এশিয়া মহাদেশের, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ার শিক্ষা এবং গবেষণা নীতিমালাকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ের প্রথম সারিতে ওই তিনটি দেশের নয়টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের উচ্চতর মান বজায় রেখেছে, যেখানে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এবং নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির নাম উল্লেখ করতেই হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত এগিয়ে চলছে। কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এগোচ্ছে না। বিশ্বের স্বনামধন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা দেশে তাদের শাখা খুলছে। বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রক্ষায় তাদের প্রবেশ সীমিত করা হয়েছে। কিন্তু তিন দশক পরে এসে দেখা যাচ্ছে, মানের চেয়ে মুনাফা অর্জনের যন্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিণত হয়েছে। সময় এসেছে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা বাংলাদেশে সম্প্রসারণের অনুমতি প্রদানের। এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং টিকে থাকার জন্যই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে।

বস্তুত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মালিকানা দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে নামকাওয়াস্তে পাঠদান, কোচিং সেন্টারের আদলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা, ভাড়ায় শিক্ষক এনে জোড়াতালির ক্যাম্পাস পরিচালনা, সনদ বিক্রি, ক্যাম্পাস শাখা বিক্রিসহ দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এমনসব কীর্তিকলাপ চলছে, যা এককথায় ভয়াবহ। উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে রকম নৈরাজ্য চলতে থাকলে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা অনেক ব্যাপক। নিজস্ব ক্যাম্পাসের পাশাপাশি প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক, পাঠাগার গবেষণাগারসহ সমন্বিত পাঠদানের জন্য আনুষঙ্গিক সবকিছুই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা প্রয়োজন। অথচ বাস্তবে আমরা কী দেখছি? বিপণিবিতান, বাসস্ট্যান্ড, আবাসিক এলাকা, এমনকি শিল্পকারখানার আশপাশের ভবনে গড়ে ওঠা দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় না আছে বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজনীয় শিক্ষক-শিক্ষিকা, না আছে জ্ঞানচর্চার মুক্ত পরিবেশ সুযোগ। দুঃখজনক হলো, এক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইউজিসির ভূমিকাও সন্তোষজনক নয়। দেশের আর দশটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যেভাবে চলে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রেও যদি সেই একই চিত্র বিরাজ করে, তাহলে উচ্চশিক্ষায় নৈরাজ্য সৃষ্টিকেই উৎসাহ দেয়া হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিরাজমান অনিয়ম, দুর্নীতি বিশৃঙ্খলা দূর করার ব্যাপারে সরকার দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় দেবেএটাই প্রত্যাশা।

বাংলাদেশের উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থা দ্রুত সম্প্রসারণ হয়েছে বটে, তবে তাদের গুণগত মানের নিশ্চয়তা নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় একটি চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রাজনৈতিক আনুগত্য দায়বদ্ধহীন সংস্কৃতির কারণে জ্ঞান উৎপাদনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্ভাবনাময় অবদান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এটা অনস্বীকার্য, বর্তমান বিশ্বে জ্ঞান দক্ষতা অর্জনে উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার বিকল্প নেই এবং উচ্চশিক্ষা গবেষণার মানোন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ভূমিকাই হচ্ছে প্রধান। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করে শিক্ষকদের দায়িত্ব উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিতকরণে জবাবদিহিতা আরো বাড়াতে হবে। এটা প্রতীয়মান যে পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন কাঠামোতে কার্যকর জবাবদিহিতা ব্যবস্থার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। প্রকৃত মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ পদোন্নতি প্রক্রিয়াগুলো যেন স্বচ্ছ মেধাভিত্তিক হয় সে ব্যাপারেও প্রশাসনকে আরো কঠোর এবং আপসহীন নীতি মেনে চলতে হবে। একাডেমিক প্রশাসনিক অনুশাসন নিশ্চিত করার দায়িত্ব ইউজিসির। উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে ইউজিসির নীতিমালা প্রণয়ন এবং কঠোরভাবে তা বাস্তবায়নে আর উদাসীনতার সুযোগ নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন