মজুরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব সূচকে পিছিয়ে চা শ্রমিকরা

শিল্পের উন্নতির সঙ্গে শ্রমিকের জীবনমানেরও উন্নয়ন ঘটুক

পালিত হলো চা শ্রমিক দিবস। ১৯২১ সালে ব্রিটিশ সৈন্যদের নির্বিচার গুলিতে নিহত হন আন্দোলনরত কয়েক হাজার শ্রমিক। নিহতদের স্মরণে এর পর থেকে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় চা শিল্প একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় সাড়ে হাজার কোটি টাকা। জিডিপিতে অবদান এখনো শতাংশের নিচে হলেও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে শ্রমঘন শিল্প। তথ্য বলছে, চা শিল্পে বর্তমানে দেড় লাখের বেশি কর্মী নিয়োজিত, যার বেশির ভাগই নারী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে চা শিল্পের দিন দিন উন্নতি হলেও শ্রমিকদের জীবনে তেমন পরিবর্তন নেই। এখনো তারা জীবনযাপন করছেন মানবেতর। এর বদল জরুরি। আর এটি করতে হবে সরকার মালিকদেরই।

দেশে চা শিল্পের যাত্রা ব্রিটিশ আমলে। পাকিস্তান আমল পেরিয়ে বাংলাদেশ পর্বে শিল্পের কলেবর বেড়েছে। সারা দেশে বর্তমানে ১৬৭টি ছোট-বড় চা বাগান রয়েছে। সিলেটের বাইরে বর্তমানে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, জামালপুর, চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোয় আরো চা বাগান হচ্ছে। আরো কিছু বাগান এখন নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় আছে। এটা ইতিবাচক। কিন্তু খাতের শ্রমিকদের অবস্থা এখনো ভালো নয়। আজও তারা নানাভাবে বঞ্চনার শিকার। এর বড় প্রমাণ মেলে তাদের কম মজুরি থেকে। একজন চা শ্রমিকের দৈনিক নগদ মজুরি ১২০ টাকা (মালিক-শ্রমিকের সর্বশেষ চুক্তি অনুযায়ী যা ২০১৯-২০ সালের জন্য কার্যকর) দৈনিক নগদ মজুরির সঙ্গে একজন শ্রমিক আরো যা পান, তার মধ্যে অন্যতম সাত-আট কেজি চাল বা আটা (সাড়ে তিন কেজি নিজের জন্য এবং বাকিটুকু স্বামী/স্ত্রী ১২ বছরের কম বয়সী সন্তানদের জন্য) ভর্তুকি মূল্যে প্রতি কেজি চাল বা আটার জন্য তাকে টাকা ব্যয় করতে হয়। মজুরি বৈষম্যসহ বিভিন্ন বঞ্চনার কারণে চা জনগোষ্ঠীর মানুষ অন্যান্য নাগরিকের চেয়ে অনেক পেছনে পড়ে আছে। বিবিএস ইউনিসেফের যৌথভাবে করা এক জরিপের ফল অনুসারে, চা বাগানের ৭৪ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। অথচ ২০১৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ শতাংশ। নিরাপদ পানীয় জলের অভাবে বছর বছর ডায়রিয়া আর পানিবাহিত রোগে চা বাগানে অনেক শ্রমিক মারা যান। বিপজ্জনক রাসায়নিকের ব্যবহার হয় চা বাগানে, এতে নারী-শিশুরা ভুগছে দুরারোগ্য ব্যাধিতে। এখনো ১০ হাতের ছোট্ট খুপরিতে দিন কাটে চা বাগানের লাখো পরিবারের। নেই নিরাপদ পুষ্টিকর খাদ্যের জোগান। গত ১৬৮ বছরেও নিশ্চিত হয়নি চা শ্রমিকদের স্থায়ী আবাসন ভূমির মালিকানা। শিক্ষা, ক্রীড়া, প্রযুক্তি বা বিনোদন কিছুই নাগালে নেই তাদের। সব মিলিয়ে চা শ্রমিকদের জীবন অনেকটাই অরক্ষণীয়।

খাতটির উদ্যোক্তাদের ভাষ্য হলো, মজুরি কম হলেও আবাসন, চিকিৎসা, রেশনের মতো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে শ্রমিকদের, যা অর্থের দিক দিয়ে পরিমাপ করা হয় না। সব সুযোগ-সুবিধা হিসাব করলে তাদের মাসিক মজুরি ১০-১২ হাজার টাকা হয়। তাদের যুক্তি ধোপে টেকে না। কেননা যেসব সুবিধা দেয়া হচ্ছে তা নামমাত্র। এতে শ্রমিকদের জীবনমানে বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসছে না। আমরা দেখছি, গত চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রায় দেড় বছর অতিক্রম হয়েছে কিন্তু মজুরি বোর্ড মজুরি সুপারিশ করতে পারেনি। শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে হলে তাদের মজুরি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার মালিকপক্ষের সক্রিয়তা কাম্য।

শ্রম আইনে আরো কিছু সুবিধা যেমন কর্মস্থলে টয়লেট প্রক্ষালন সুবিধা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। চা পাতা সংগ্রহ করা শ্রমিকদের ৯০ শতাংশের বেশি নারী হলেও তাদের জন্য নেই টয়লেট বা প্রক্ষালন কক্ষ। তাছাড়া খাবার পানির সরবরাহও সবসময় পর্যাপ্ত থাকে না, এমন অভিযোগও আছে। চা শ্রমিক আবাসন, স্বাস্থ্য শিক্ষাএসব দুর্ভাগ্যের আয়না। তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব বাগান মালিকের। ব্যাপারে বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫-এর পঞ্চম তফসিলে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। শুধু তা- নয়, ঘর মেরামতের দায়িত্বও বাগান মালিকের। শ্রম বিধিমালার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা [ () ] অনুসারে, প্রতি বছর লেবার লাইনে বসবাসকারী অন্তত ১০ ভাগ শ্রমিকের জন্য মির্তিঙ্গা টাইপ (পাকা দেয়ালের) গৃহ নির্মাণ করতে হবে। এটি যথাযথভাবে করা হচ্ছে না। প্রথমত, বাগান মালিকরা যদি প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে ঘর মির্তিঙ্গা টাইপ করে দিতেন, তবে চা বাগানের লেবার লাইন বা শ্রমিক কলোনিতে এখন আর কোনো কাঁচা ঘর থাকত না। চা বাগানগুলোয় বাগান ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হাসপাতাল ডিসপেনসারি আছে। কিন্তু এসব হাসপাতালে যে চিকিৎসা পাওয়া যায়, তা মোটেই সন্তোষজনক নয়। ক্যানসার, যক্ষ্মাসহ বড় কোনো রোগে পড়লে বাগানের হাসপাতাল ডিসপেনসারিতে ভালো চিকিৎসা মেলে না। শ্রম আইন বিধিমালায় যেসব প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা এবং অন্য সুযোগ-সুবিধা চা শ্রমিক তাদের পরিবারের পাওয়ার কথা, তার অনেক কিছুই তারা পান না। শিক্ষার অবস্থাও ভালো নয়। বেশির ভাগ বাগানেই বিদ্যালয় নেই। আবার প্রাথমিকের পর শিক্ষার দায়িত্বও নেয় না বাগান কর্তৃপক্ষ। বিদ্যমান অবস্থায় ব্যক্তিগত খরচে পড়ানোর সামর্থ্য নেই শ্রমিকদের। ফলে তাদের সন্তানরা শিক্ষা-দীক্ষা, স্বাস্থ্য সব সূচকেই পিছিয়ে থাকছে।

গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চা উৎপাদন হয়েছে। ক্রমেই বাড়ছে উৎপাদন। এখন চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। সাফল্যের কারিগর শ্রমিকরা, অন্য কেউ নয়। নিশ্চয়ই এতে দেশের অর্থনীতি উপকৃত হয়েছে, বৈশ্বিক পরিসরে বেড়েছে সুনাম। কাজেই তাদের জীবনমান উন্নয়নে পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই। ন্যায্য মজুরিসহ চা বাগানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় বাগান মালিক এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে বাধ্যবাধকতা জবাবদিহির আওতায় আনতে রাষ্ট্রকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। সব নাগরিকের সমমর্যাদা সমুন্নত রাখার ঘোষণা দিয়েছে আমাদের সংবিধান; চা শ্রমিকরা এর বাইরে নন। সরকার মালিকপক্ষের সম্মিলিত প্রয়াসে শ্রমিকদের জীবনে বড় রূপান্তর ঘটবে, এমনটাই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন