শ্রমিক সংকট ও অশনির বৃষ্টিতে ক্ষতি

বোরো ধান ঘরে তোলা নিয়ে কৃষকের দুশ্চিন্তা

বণিক বার্তা ডেস্ক

নওগাঁয় ঝড়ে হেলে পড়া ধান খেত ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

নওগাঁয় প্রতি বছর বাইরের জেলা থেকে ধান কাটার জন্য পর্যাপ্ত কৃষি শ্রমিক এলেও বছর কোনো শ্রমিক আসেনি। এতে বোরো মৌসুমে ফসল ঘরে তুলতে কৃষি শ্রমিকের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে স্থানীয় শ্রমিকদের বাড়তি টাকা দিয়ে ধান কাটতে হচ্ছে। এর পরও সময়মতো শ্রমিক পাচ্ছেন না চাষীরা। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে ফসল সম্পূর্ণ পাকলেও শ্রমিক সংকটের কারণে এখনো তা ঘরে তুলতে পারেননি অনেকেই। এতে চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে চাষীকে। প্রশাসন কৃষি বিভাগের সমন্বয়ে জেলার বাইরে থেকে দ্রুত কৃষি শ্রমিক আনার দাবি জানিয়েছেন তারা।

সরেজমিন সদর উপজেলার তালতলী বিল, হাঁসাইগাড়ী বিল, গুটার বিল, চণ্ডিপুর, রানীনগর উপজেলার দাঊদপুর, খট্টেশ্বর, আত্রাই উপজেলার কালিকাপুরসহ বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা যায়, গত মাসে জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দুদফা কালবৈশাখী ঝড়ে হেলে পড়া ধানের ৯৫ শতাংশ পেকে গিয়েছে। ধান পাকলেও শ্রমিক সংকটের কারণে বেশির ভাগ জমির ধান এখনো কাটতে পারেননি কৃষক। এরই মধ্যে দুদিন থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় অনেক মাঠের নিচু জমির ধান পানিতে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। হেলে পড়া ভেজা ধান কাটতে স্থানীয় শ্রমিকদের মাঝে অনীহা দেখা দিয়েছে। গত বছর বিঘাপ্রতি ধান কাটতে - হাজার টাকা খরচ হলেও বছর জেলার বাইরে থেকে এখনো কৃষি শ্রমিক না আসায় স্থানীয় শ্রমিকদের বিঘাপ্রতি - হাজার টাকা মজুরি দিতে হচ্ছে।

সদর উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের চুনিয়াগাড়ী গ্রামের কৃষক নকিম উদ্দিন বলেন, গত বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন এবং ভালো দাম পেয়েছিলাম। তাই বছর ৩৪ হাজার টাকা খরচ করে চার বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছি। এরই মধ্যে ঝড়ে গাছ হেলে পড়ায় ২৫ শতাংশ ধান চিটা হয়ে গেছে। এখন জমির ধান সম্পূর্ণ পেকেছে। অথচ শ্রমিক সংকটের কারণে মাত্র এক বিঘা জমির ধান কাটতে পেরেছি। স্থানীয় শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাদের সিরিয়াল পেতেও অনেক সময় লাগছে। যেকোনো সময় ঝড়-বৃষ্টি এসে ফসলের আরো ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু বাড়তি টাকা দিয়েও এখন শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। দুই বছর করোনার কারণে প্রশাসনের সহযোগিতায় জেলার বাইরে থেকে কৃষি শ্রমিক আনা হয়েছিল। এবারো যদি তাদের দ্রুত আনার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে আমরা ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাব।

একই উপজেলার হাঁসাইগাড়ী ইউনিয়নের কাঠখোর গ্রামের কৃষক সোহাগ হোসেন বলেন, গুটার বিলে ২০ বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছি। এখানকার জমি এক ফসলি হওয়ায় প্রতি বছর বোরো মৌসুমের ওপর নির্ভর করে আমাদের চলতে হয়। বর্তমানে জমির সব ধান পেকেছে। শ্রমিক সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয় শ্রমিকদের বাড়তি মজুরি দিয়ে ছয় বিঘা জমির ধান কাটা হয়েছে। গত বছর বিঘাপ্রতি ৩০-৩২ মণ করে ফলন পেয়েছিলাম। আর এবার ঝড়ে ধানগাছ হেলে পড়ায় বিঘাপ্রতি -১০ মণ কম ফলন পাচ্ছি। গত বছর বিঘাপ্রতি ধান কাটতে আড়াই হাজার টাকা শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দিতে হয়েছে। আর এবার হাজার টাকা দিয়েও সময়মতো শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।

আত্রাই উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের ছোট কালিকাপুর গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, সাড়ে ছয় বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছি। জমির ধান সম্পূর্ণ পেকে এক সপ্তাহ পার হলো। অথচ ধান কাটার কোনো কৃষি শ্রমিক নেই। প্রতি বছর ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী জেলা থেকে এখানে কৃষি শ্রমিক আসত। তাদের বিঘা প্রতি হাজার টাকা দিলেই ধান কেটে দিত। এবার তারা আসেনি। এজন্য ধান কাটা যাচ্ছে না। স্থানীয় শ্রমিকদের দিয়ে ধান কাটতে গেলে তারা বিঘাপ্রতি হাজার টাকা দাবি করছে। আবার তাদের শিডিউল নিতে হচ্ছে। এবার এমনিতেই ঝড়ে ফলন কম হয়েছে। এর মধ্যে যদি তাদের অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ফসল ঘরে তুলি আমাদের লোকসান গুনতে হবে। এজন্য উপায় না পেয়ে বাইরের কৃষি শ্রমিকদের জন্য অপেক্ষা করছি। এভাবে বেশি দিন দেরি হলে বৃষ্টিতে ফসল পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। তাই আমাদের দুশ্চিন্তার মধ্যে সময় কাটছে।

নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ী) উপপরিচালক শামছুল ওয়াদুদ বণিক বার্তাকে বলেন, দুই দফা ঝড়-বৃষ্টিতে ফসল আক্রান্ত হওয়ায় এবার আমাদের বোরো ধানের ফলন কিছুটা কম হবে। জেলার সব মাঠের ৮০ শতাংশ ধান পেকেছে। যেহেতু এখনো আবহাওয়া খারাপ তাই দেরি না করে দ্রুত ধান কেটে ফসল ঘরে তুলতে কৃষকদের প্রতিনিয়ত পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে আমাদের ২৫ শতাংশ জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। শ্রমিক সংকটের কারণে এবার কৃষক ফসল ঘরে তুলতে একটু সমস্যায় পড়েছেন।

তিনি বলেন, প্রতি বছর পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আমাদের এখানে বোরো মৌসুমে কৃষি শ্রমিক আসেন। এবার তারা আসতে পারেননি। কারণ একই সময় ওই অঞ্চলগুলোয় একসঙ্গে ধান পেকেছে। আমাদের এখানে বোরোর রেকর্ড পরিমাণ আবাদ হয়। তাই ফসল ঘরে তুলতে স্বাভাবিকভাবেই বাইরের শ্রমিকের প্রয়োজন বেশি পড়ে। শ্রমিক সংকট না থাকলে এতদিন প্রায় সব জমির ধানই কাটা শেষ হয়ে যেত।

ধান নিয়ে খুবই বিপদে আছি, চাষীদের একের পর এক দুর্ভোগ লেগেই আছে। গত মৌসুমে মসুর ডাল লাগিয়েছিলাম দেড় বিঘা জমিতে। বৃষ্টিতে তলিয়ে সব নষ্ট হয়ে গেছে। এবার তিন বিঘা জমিতে ধান চাষ করলাম, বৃষ্টির কারণে সব ধান বাড়ি আনা সম্ভব হয়নি। শুকনো ধান তলিয়ে পচে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে যশোর শহরতলি পুলেরহাট মাঠে অশনির প্রভাবে টানা কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়া জমি থেকে মুঠোবাঁধা ধান ডাঙায় আনার সময় কৃষক নজরুল শেখ আক্ষেপ করে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের বাড়ি যশোর সদর উপজেলার আরবপুর ইউনিয়নের মালঞ্চী গ্রামে। শুধু নজরুল শেখ নন, এমন বিপদে আছেন যশোরের আট উপজেলার আরো অনেক কৃষক।

যশোরের কৃষকরা জানান, ঈদের দিন থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি শুরু হয় জেলায়। এর পর টানা দুদিন কড়া তাপদাহের পর পাঁচদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি ঝড়ো বাতাসে জেলার বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

দিনাজপুরের হিলিতে অধিকাংশ জমির ধান পেকে যাওয়ায় ধান কাটা নিয়ে ব্যস্ত কৃষক। কিন্তু ধান কাটা শ্রমিক না পাওয়ায় শ্রমিকের বাড়তি মজুরির কারণে ধান কেটে ঘরে তোলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষকরা। কেউ কেউ নিজেরাই নিজেদের ধান কাটতে লেগে গেছেন। শ্রমিকের বাড়তি মজুরির কারণে উৎপাদন খরচ না ওঠার আশঙ্কা তাদের। এদিকে ধান কাটামাড়াইয়ের কাজে আধুনিক কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের পরামর্শ কৃষি অফিসের। 

নীলফামারী থেকে হিলিতে ধান কাটতে আসা শ্রমিক আমিনার রহমান বলেন, গত বছর ধান ভালো থাকায় আমরা মাঠ থেকে ধান কেটেছিলাম আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা করে তার পরও আমাদের পুষিয়েছে। কিন্তু এবার ঝড়বৃষ্টিতে ধান হেলে পড়ায় ধান কাটতে খুব সময় লাগছে।  যে কারণে - হাজার টাকা বিঘা ধান কেটেও পোষাচ্ছে না। হাকিমপুর উপজেলা কৃষি অফিসার . মমতাজ সুলতানা বলেন, ধান কাটা শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে কোনো কোনো এলাকায়। এক্ষেত্রে আমরা কৃষকদের আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য উদ্বুদ্ধ করছি।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার নওগাঁ, যশোর হিলি প্রতিনিধি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন