পর্যালোচনা

ইউক্রেন যুদ্ধ যেভাবে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলছে

আব্দুল্লাহ মামুন,জোসেফ গ্লাউবার, ডেভিড লাবোর্ড

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গম ভোজ্যতেলের পাশাপাশি সারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের বৈশ্বিক বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ওপর এর ব্যাপক প্রভাবও পড়ছে। বাংলাদেশ এসব পণ্যের আমদানির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। বর্তমানে চলমান বাণিজ্য সংকোচনের কারণে দেশটি ক্রমবর্ধমান খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার শঙ্কার মুখোমুখি।

রাশিয়া ইউক্রেন সংঘাত বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী ১৬৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ। জনসংখ্যার ৩৮ শতাংশই কৃষি মত্স্য খাত এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত। দেশের অপুষ্ট জনসংখ্যার হার ২০০০ সালে ১৬ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালে দশমিক শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। যদিও কভিড-১৯ মহামারী দেশটির খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়েছে। তবে সরকারের কিছু পদক্ষেপের কারণে দেশটি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) সমীক্ষা অনুসারে, মাঝারি বা গুরুতর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি গ্রামীণ পরিবারের অনুপাত ২০২০ সালের প্রথম দিকে ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৪৫ শতাংশ হয়েছে। যদিও ২০২১ সালের শেষের দিকে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি পরিবারের সংখ্যা প্রাক-মহামারী পর্যায়ে ফিরে এসেছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এখনো নানা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে ২০২২ সালের মার্চে দেশটির অভ্যন্তরীণ সারের বাজারে অস্থিরতার পাশাপাশি প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। আজকের নিবন্ধে আমরা রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিকভাবে রফতানি বিধিনিষেধের মুখোমুখি হওয়া বেশ কয়েকটি পণ্যে বাংলাদেশের বাণিজ্য নির্ভরতা, ক্রমবর্ধমান আমদানির আর্থিক প্রভাব এবং খাদ্যনিরাপত্তায় সৃষ্ট চাপ কমানোর জন্য সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলো নিয়ে আলোচনা করব।

বাংলাদেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনার ঝুঁকি

ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশকে তিনটি উপায়ে প্রভাবিত করেছে। প্রথমত, গমের বাজার। যদিও বাংলাদেশের মানুষের ক্যালরি গ্রহণের ক্ষেত্রে চালের ওপর ঐতিহাসিকভাবে উচ্চনির্ভরতা রয়েছে (মোট ক্যালরির প্রায় ৬৮ শতাংশ), তার পরও গম একটি ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উৎস হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে আবির্ভূত হয়েছে, বর্তমানে মানুষের মোট ক্যালরির প্রায় শতাংশের জোগান আসছে গম থেকে। ২০০০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দেশে গম ব্যবহার তিন গুণ বেড়েছে এবং বাংলাদেশ তার গমের চাহিদার ৮০ শতাংশেরও বেশি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করে। ২০০৫ সাল থেকে রাশিয়া ইউক্রেন থেকে পণ্যের বেশির ভাগ অংশ আমদানি করে বাংলাদেশ। বর্তমানে গমের মোট আমদানির অর্ধেকেরও বেশি রাশিয়া ইউক্রেন থেকে (চিত্র: ) আসে। গম আমদানির উৎসগুলো এখন ব্যাহত হওয়ায় বাংলাদেশকে বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে হবে। বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশ ভারত অস্ট্রেলিয়া থেকে গম কিনেছে। ভারত চলতি বছর গমের ভালো উৎপাদন প্রত্যাশা করছে এবং দেশটি ইঙ্গিত দিয়েছে, ভারত চলতি বছর বিশ্ববাজারে ১০ মিলিয়ন টন গম সরবরাহ করতে সক্ষম হবে।

দ্বিতীয়ত, ভোজ্যতেলের বাজার। বিশ্বে সূর্যমুখী তেলের চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশই ইউক্রেন রাশিয়া সরবরাহ করে। বাংলাদেশ সূর্যমুখীর তেল উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আমদানি না করলেও যুদ্ধ পুরো ভোজ্যতেলের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। বাংলাদেশ ভোজ্যতেলের চাহিদার প্রায় সবটাই হয় কাঁচা বা প্রক্রিয়াজাত পণ্য (প্রাথমিকভাবে পাম তেল সয়াবিন তেল) অথবা আমদানীকৃত তৈলবীজ (রেপসিড সয়াবিন) আকারে আমদানি করে, যা অভ্যন্তরীণভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।

প্রধান ভোজ্যতেল রফতানিকারকদের আরোপিত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাও বাংলাদেশের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের পাম তেল আমদানির ৮০ শতাংশই আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। ইন্দোনেশিয়া চলতি বছরের মার্চ থেকে পাম তেল তার সহপণ্য রফতানিতে শুল্ক বাড়িয়েছে, যা বিশ্ববাজারে মোট সরবরাহ সীমিত করতে পারে। এদিকে বাংলাদেশের সয়াবিন আমদানির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই আর্জেন্টিনা সরবরাহ করে। ১৩ মার্চ আর্জেন্টিনা সয়াবিন তেল খাবারের রফতানি সীমিত করতে কঠিন বিধিনিষেধ আরোপ করে। ৩১ মার্চ বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে, রফতানির অনুমতি দেয়। তবে সেই পণ্যগুলোর ওপর রফতানি কর ৩১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৩ শতাংশ করা হয়েছে। এসব কারণে ভোজ্যতেলের দাম রেকর্ড সর্বোচ্চে পৌঁছেছে এবং বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশগুলোর আমদানি ব্যয় বাড়িয়েছে। আমরা যদি শস্য তৈলবীজ উভয় বাজারেই প্রভাবের কথা বিবেচনা করি, তাহলে রফতানি বিধিনিষেধ-সংক্রান্ত ট্র্যাকিং টুল ইঙ্গিত দেয়, বাংলাদেশের মোট আমদানীকৃত ক্যালরির ৩৮ শতাংশ ধরনের পদক্ষেপের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, যা ডলার মূল্যে মোট আমদানির এক-চতুর্থাংশের সমান।

তৃতীয়ত, সারের খরচ। বাংলাদেশের কৃষি, বিশেষ করে ধান উৎপাদন ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল। বছরে প্রতি হেক্টরে গড় ২৮৬ কেজি সার ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ বছরে দশমিক মিলিয়ন টনেরও বেশি সার আমদানি করে। দেশে নাইট্রোজেনের চাহিদার ৩১ শতাংশ, ফসফেটের চাহিদার ৫৭ শতাংশ এবং পটাশ চাহিদার ৯৫ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। রাশিয়া বেলারুশ বিশ্বের প্রধান সার রফতানিকারক দেশ। যুদ্ধের কারণে রাশিয়াকে লক্ষ্য করে রফতানি নিষেধাজ্ঞা বাজারগুলোর স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করেছে। বাংলাদেশ তার পটাশ সারের চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশ (রাশিয়া থেকে ৩৪ শতাংশ এবং বেলারুশ থেকে ৪১ শতাংশ) আমদানি করে। যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশকে সম্ভবত অন্যান্য দেশ থেকে সার আমদানি করতে হবে এবং এতে ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। এতে দেশে সারের ব্যবহার কম হবে, বিশেষ করে নাইট্রোজেনভিত্তিক সারের ব্যবহার হ্রাস পাবে; যা চাল উৎপাদন হ্রাস করতে পারে এবং চাল আমদানির চাহিদা বাড়বে।

উপরন্তু, বাংলাদেশ তার ভুট্টা সয়াবিনের চাহিদার ৪৪ শতাংশ আমদানি করে (FAOSTAT খাদ্য ব্যালান্স শিটের ওপর ভিত্তি করে গণনা) এবং পণ্যগুলোর বৈশ্বিক দামও বাড়ছে। এটি বাংলাদেশের খাদ্যের বাজারকে প্রভাবিত করবে, যেমন হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু মাছ উৎপাদনের খরচ বাড়াবে। কৃষির উপখাতগুলো মহামারীর কারণে এরই মধ্যে দুর্বল হয়ে পড়েছে। আগামী মাসগুলোয় প্রাণিজ পণ্যের সহজলভ্যতা হ্রাস এবং গম, ভোজ্যতেল চালের মতো প্রধান পণ্যের উচ্চমূল্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় দেশের খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে।

খাদ্যপণ্যের জোগান নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে। এটি আর্থিক রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং মুদ্রাবাজারে প্রভাব ফেলবে। আমরা এরই মধ্যে টাকার অবমূল্যায়নের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে আমদানি ব্যয় আরো বেড়ে উঠবে। এতে ভোক্তাদের অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করতে হবে। কারণ বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম দুর্বল মুদ্রা বিনিময় হার দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং জনসাধারণের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করবে। মনে রাখতে হবে দেশে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ কিন্তু বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে সরকারও অভ্যন্তরীণ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎস থেকে ব্যাপক ঋণ গ্রহণ করছে।

সামষ্টিক অর্থনীতি সরকারি নীতির ওপর প্রভাব

অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও এরই মধ্যে দেশীয় খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। যদিও ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সরকারি হিসাবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দশমিক শতাংশের মধ্যেই রয়েছে, যা তুলনামূলকভাবে সহনীয় পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত দেয়। তবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) একটি প্রতিবেদনে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের উচ্চমূল্যের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে (যদিও চালের দাম এখন পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে) 

চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) বাণিজ্য ঘাটতি ৮২ শতাংশেরও বেশি বেড়ে ১৮ দশমিক বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ হিসাবে দেখা যাচ্ছে অপেক্ষাকৃত উচ্চ রফতানি প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও আমদানি ব্যয় ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় ৪৬ শতাংশ বেড়েছে। আমদানির তালিকায় রয়েছে চাল, গম, সার সবজি; যার ব্যয় দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশকে ২০২২-২৩ সালে দশমিক মিলিয়ন টন গম এবং দশমিক মিলিয়ন টন ভুট্টা আমদানি করতে হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। (চিত্র: )

বাংলাদেশ কীভাবে দরিদ্র কৃষকদের ওপর ক্রমবর্ধমান মূল্যের প্রভাব হ্রাস এবং সরবরাহ সমস্যা মোকাবেলা করতে পারে?

সরকার খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি (ওএমএস), খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি (এফএফপি) ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিংসহ (ভিজিএফ) ব্যাপক পাবলিক ফুড ডিস্ট্রিবিউশন প্রোগ্রাম (পিএফডিএস) পরিচালনা করে আসছে। শুধু এফএফপি প্রোগ্রামেই ৫০ লাখেরও বেশি দরিদ্র পরিবারকে খাদ্যশস্য সরবরাহ করে সরকার, যার বার্ষিক ব্যয় ৩৮০ মিলিয়ন ডলার। মহামারীর প্রথম বছরে জনসাধারণের মধ্যে খাদ্য বিতরণের পরিমাণ প্রাক-মহামারী সময়ে দশমিক মিলিয়ন টন (২০১৮-১৯) থেকে দশমিক মিলিয়ন টনে উন্নীত করা হয়েছে। এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩৩ লাখ টন খাদ্যশস্য বিতরণের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১৫ লাখ টন বিতরণ করেছে। (চিত্র: )

সাম্প্রতিক মাসগুলোয় কভিডের কারণে আয় হ্রাস উচ্চ বেকারত্ব অনেক পরিবারকে নতুন করে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এটি সরকারের খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি, বিশেষ করে ওএমএসের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে বাধ্য করেছে। গত মার্চে আরো এক কোটি পরিবারকে স্বল্পমূল্যে সয়াবিন তেল, চিনি, ছোলা মসুর ডাল সরবরাহের যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা দেশের ক্রমবর্ধমান খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা সমস্যারই ইঙ্গিত দেয়।

এদিকে সারের জন্য সরকারি ভর্তুকি ২০২১-২২ সালে রেকর্ড সর্বোচ্চ দশমিক বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা বাজেটে নির্ধারিত বিলিয়ন ডলারের ভর্তুকির তিন গুণ। কৃষকরা বিভিন্ন ধরনের সারের বাজারমূল্যের ৭০ শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশ সরকারি ভর্তুকি পেয়ে থাকেন। দেশে মোট দশমিক মিলিয়ন টন সারের চাহিদা রয়েছে। বাজারে সরবরাহ বিঘ্ন ঘটায় কৃষকরা এখন সময়মতো সার পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। সারের ঘাটতি বসন্তে আউশ ধান, জুলাইয়ে আমন এবং শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধান রোপণে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।

নীতি সুপারিশ

দরিদ্রদের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সরকারের নীতিনির্ধারণী লক্ষ্য হওয়া উচিত। যদিও চাল উৎপাদন পূর্বাভাস (ইউএসডিএ তথ্য অনুসারে ২০২২-২৩ সালে ৩৬ দশমিক মিলিয়ন টন চাল উৎপাদন হবে) কিছুটা অনুকূল অবস্থার ইঙ্গিত দেয়। তা সত্ত্বেও বিদেশ থেকে লাখ টন চাল সংগ্রহ করতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে গম ভুট্টার কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ আমদানি অনিশ্চিত, যেমনটি সারের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যাচ্ছে। এখন দেখার বিষয় বাংলাদেশ কীভাবে পণ্যগুলোর বর্তমান উচ্চমূল্য এবং সরবরাহ ঘাটতি মোকাবেলাপূর্বক খাদ্যনিরাপত্তা বজায় রাখতে পারে।

মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকারের উচিত দেশীয় আন্তর্জাতিক উভয় বাজারমূল্যের গতি-প্রকৃতি প্রবণতা পর্যবেক্ষণ এবং খাদ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

আইএফপিআরআইয়ের গবেষণায় দেখা গেছে মহামারীর প্রাথমিক পর্যায়ে এফএফপি কর্মসূচির আওতায় খাদ্য বিতরণে দুর্বলতা ছিল, যার মধ্যে প্রকৃত উপকারভোগীদের সঠিকভাবে নির্বাচন করতে না পারা এবং অন্যান্য বিষয়ের চাহিদার তুলনায় কম বরাদ্দের সমস্যা অন্যতম। যেহেতু সরকার এখন খাদ্য বিতরণে মানুষের সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাই সুবিধাভোগীদের সঠিকভাবে নির্বাচন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে প্রক্রিয়াটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্বচ্ছতার সঙ্গে বাস্তবায়নে এটি জরুরি। নিয়মিত তদারকি এবং -জাতীয় কর্মসূচির কার্যকর মূল্যায়ন সরবরাহে ঘাটতি এবং অদক্ষতা সম্পর্কে সরকারকে আগাম সতর্ক হতে সহায়তা করতে পারে। সারের সুষ্ঠু বিতরণ নিশ্চিতে অনুরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন।

বাজার স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করার জন্য কিছু স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ বিবেচনা করা যেতে পারে। সরকারের উচিত ওএমএস এবং অন্যান্য কর্মসূচির মাধ্যমে ভোক্তাদের সহায়তা অব্যাহত রাখা। খাদ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকার এরই মধ্যে আমদানি শুল্ক মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) কমিয়েছে। সরকারের পদক্ষেপকে আমরা উৎসাহজনক বলে মনে করি। বিদ্যমান কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের প্রয়োজন, বিশেষ করে সারে প্রদত্ত ভর্তুকিসংক্রান্ত নীতির সংস্কার। কারণ -জাতীয় নীতিগুলো পরিবেশগত আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে টেকসই নয়।

উপসংহার

চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট পুরো বিশ্বের খাদ্যনিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশও এর শিকার। সরবরাহ শৃঙ্খল স্বাভাবিক রাখতে হলে অধিক দামে পণ্য আমদানি করতে হবে, যা বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আরো সংকুচিত করবে। ফলে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রসারিত করতে সরকারের হাতে খুব কম বিকল্প থাকবে।

এদিকে খাদ্যের বাইরে বিশ্ববাজারের সমস্যাও দেশের অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এতে দেশের বস্ত্র পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলে অনেক দরিদ্র পরিবারের আয় চাকরি নতুন করে ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সিনথেটিক প্রাকৃতিক তন্তু (গত দুই বছরে তুলার দামের ৭২ শতাংশ বৃদ্ধি) উভয় পণ্যের মূল্য এমন সময়ে বেড়েছে যখন মহামারীতে বিশ্বব্যাপী এর চাহিদা হ্রাস পেয়েছিল। এখন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে অর্থপ্রাপ্তি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। 

উদ্বেগগুলো এরই মধ্যে কভিড মহামারী থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে বাধাগ্রস্ত করবে। সন্দেহ নেই, এর ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনে অগ্রগতি বিলম্বিত হবে। অবস্থা থেকে উত্তরণে আইএমএফ বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সহায়তা প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে পরিচালিত কার্যক্রম, ভর্তুকি অব্যাহত রাখা, বাজার স্থিতিশীল এবং খাদ্য সার বিতরণ কর্মসূচির কার্যকারিতা দ্রুত মূল্যায়নের জন্য সরকারের একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন।


আব্দুল্লাহ মামুনসিনিয়র রিসার্চ অ্যানালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট

জোসেফ গ্লাউবার: সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট

ডেভিড লাবোর্ড: সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন