দ্রুত অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে রূপগঞ্জে

সাইফ সুজন ও আল ফাতাহ মামুন

রাজধানীতে জমির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। শিল্প-কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠেছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ। গত কয়েক বছরে শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতগতিতে বাড়ছে এখানকার জনসংখ্যাও। সুযোগ পেয়ে ভিড় জমিয়েছে আবাসন খাতের প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক ভুইফোঁড় অনেক ব্যবসায়ী। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন আবাসন ব্যবসার সম্প্রসারণে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে কংক্রিটে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ছে জনপদটি। চলতি শতকের শুরুতেও এখানে কংক্রিটে আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ ছিল ১৯৭ হেক্টর। এরপর গত দুই দশকে এখানে কংক্রিটে আচ্ছাদিত ভূমির আয়তন বেড়েছে প্রায় ৮০০ শতাংশ।

স্থানীয়রা বলছেন, ঢাকায় জমির দাম এখন আকাশচুম্বী। রাজধানীসংলগ্ন এলাকা হিসেবে শিল্প মালিক আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠেছে রূপগঞ্জ। এক সময় এখানে ইটের ভাটা ছিল অনেক বেশি। সে সময় ফসল হতো অনেক কম। বর্তমানে ইটের ভাটার সংখ্যা কমে এলেও পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানো যায়নি। বরং এখানকার শিল্পায়ন বৃদ্ধি আবাসন ব্যবসা সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে নগরায়ণও হচ্ছে দ্রুতগতিতে। একই সঙ্গে কমে আসছে রূপগঞ্জের সবুজ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণও।

জার্নাল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টে (জেইএসডি) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে রূপগঞ্জে নগরায়ণের ফলে কংক্রিটে আচ্ছাদিত ভূমির আয়তন ছিল ৫৩ হেক্টর। ১৯৯৫ সালে তা দাঁড়ায় ৭৬ হেক্টরে। ২০০০ সালে চলতি শতকের গোড়ায় এর আয়তন ছিল ১৯৭ হেক্টর। ২০১০ সালে তা দাঁড়ায় ৬২৭ হেক্টরে। এরপর ২০১৭ সালে জনপদটিতে কংক্রিটে আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ দাঁড়ায় হাজার ৭৬৬ হেক্টরে। সে হিসেবে ২০০০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে রূপগঞ্জে কংক্রিটে আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ বেড়েছে ৭৯৬ শতাংশেরও বেশি।

অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়েছে এখানকার জনসংখ্যাও। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৫০ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জনসংখ্যা ছিল হাজার ৬৮২। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এখানে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্থিতিশীল ছিল - শতাংশে। গত শতাব্দীর শেষ দশকে রূপগঞ্জে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক শ্লথ হয়ে আসে। ২০০০ সালে এসে এলাকাটিতে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় মাত্র দশমিক ৮৮ শতাংশ। তবে ২০০১ সালের পর তা আবার গতিশীল হয়ে ওঠে। ২০০২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এখানকার বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১০ শতাংশের বেশি। তবে কয়েক বছর ধরে তা সামান্য শ্লথ হয়েছে। রূপগঞ্জে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২০১৯ সালে ছিল দশমিক ৭৪ শতাংশ। এরপর ২০২০ সালে দশমিক ১৯ সর্বশেষ গত বছর দশমিক ৪৪ শতাংশ হারে বেড়েছে রূপগঞ্জের জনসংখ্যা।

রূপগঞ্জের তারাবো ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, এলাকায় প্রচুর শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। এলাকার ফসলি জমি কমে আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য বেড়েছে অনেক। স্থানীয়রা জানান, আগে এসব এলাকায় পাটকলের সংখ্যা ছিল বেশি। বর্তমানে পোশাক সুতা কারখানার আধিপত্য রয়েছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাড়লেও যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নে পিছিয়ে রয়েছে রূপগঞ্জ। রূপগঞ্জের উত্তর দিকে সিলেট মহাসড়ক পূর্ব দিকে চট্টগ্রাম মহাসড়ক হলেও রূপগঞ্জের ভেতরে তেমন রাস্তাঘাট সম্প্রসারণ না হওয়ায় জনভোগান্তি রয়েছে।

বিষয়ে জানতে চাইলে রূপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান ভূইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, শিল্প-কারখানার পাশাপাশি রূপগঞ্জে গত এক দশকে ব্যাপক হারে আবাসন ব্যবসা বেড়েছে। এক্ষেত্রে কৃষিজমির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এখানে ক্রমেই আবাসন ব্যবসা বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই ভুইফোঁড় প্রতিষ্ঠানও রয়েছে অনেক। এতে জনগণ প্রতারিত হওয়ার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে।

স্থানীয়রা বলছেন, স্বাধীনতার আগে রূপগঞ্জের শিল্পায়ন সীমাবদ্ধ ছিল পাট সুতার কারখানার মধ্যেই। বাংলাদেশ অধ্যায়েও নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এখানে শিল্পায়নের গতি ছিল খুবই ধীর। গত শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে দ্রুত শিল্পায়িত হতে থাকে এলাকাটি। এরপর গত দুই দশকে ছোট-বড় মিলিয়ে হাজারো নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে রূপগঞ্জে। এর মধ্যে গাজী গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, আম্বর গ্রুপ, বাংলাক্যাট, রবিনটেক, স্কয়ার, বাংলাদেশ মেলামাইনসহ পোশাক স্পিনিংয়ের বড় বড় কারখানাও রয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে অর্থনৈতিক অঞ্চলও।

দেশের সবচেয়ে বড় কাপড়ের বাজার গাউছিয়া মার্কেট অবস্থিত রূপগঞ্জে। বিপণি বিতানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান ভূইয়া দিপুর পরিবার এখানে বসবাস করছে দীর্ঘদিন ধরে। এলাকাটির দ্রুত পরিবর্তনকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন তিনি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই রূপগঞ্জ শিল্প এলাকা হিসেবে খ্যাত। গাউছিয়া কটন মিলসহ বেশকিছু কটন জুট মিল আগে থেকেই ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এখানে ব্যবসা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমান সময়ে এসে বলতে পারি, রাজধানী ঢাকার সঙ্গে রূপগঞ্জের জীবনমানের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা হওয়ার কারণে এখানে পূর্বাচল প্রজেক্ট হচ্ছে, বাণিজ্য মেলা চলে এসেছে, অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে পূর্বাচলকে ঘিরে হয়তো বিভিন্ন দূতাবাসও এদিকে চলে আসবে। এখানের ব্যবসায়িক পরিবেশ ভালো হওয়ায় দেশের সব ব্যবসায়ীর প্রথম নজর থাকে এদিকে।

তিনি আরো বলেন, এক সময় রূপগঞ্জে ছিল শত শত ইটভাটা। ইটভাটার কারণে এখানে কোনো ফসল হতো না। এখানে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কারণে একদিকে বেকারত্ব সমস্যার যেমন সমাধান হয়েছে, তেমনি ছোট ছোট দোকানপাটের মাধ্যমেও মানুষ স্বাবলম্বী হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে গত দুই দশকে রূপগঞ্জে বড় পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। 

এলাকাটির দ্রুত সম্প্রসারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ- (রূপগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য এবং বস্ত্র পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বণিক বার্তাকে বলেন, এখানে বেশ আগে থেকেই পাট সুতার জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্র ছিল। তবে বাঙালিরা আগে চাকরিজীবী হওয়ায় এসব ব্যবসায় স্থানীয়রা বেশি সুবিধা করতে পারেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাঙালিরা ব্যবসায়ী হওয়া শুরু করল। এতে আগে রূপগঞ্জে ছোট ছোট কারখানা ছিল, কিন্তু গত দুই দশকে বেশ বড় বড় শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে এখানে। বিদ্যুৎ গ্যাস সংযোগের সহজপ্রাপ্যতার কারণে ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠেছে রূপগঞ্জ। এছাড়া এখানে জায়গাজমি বেচাকেনার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় না। বিশেষ করে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের কারণে গত ১০ বছরে এখানকার চিত্র দ্রুত বদলেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিও হচ্ছে।

 প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি আমির হুসাইন স্মিথ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন