এক বছরে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ বেড়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি

হাছান আদনান

সরকারের বাজেট ঘাটতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। গত ডিসেম্বর শেষে উৎস থেকে নেয়া সরকারের ঋণের পরিমাণ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে শুধু ২০২১ পঞ্জিকা বর্ষেই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ব্যাংক খাত থেকে ট্রেজারি বিল-বন্ড বিক্রির মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থের পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র বিক্রিসহ অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে জনগণের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে সরকার।

প্রতি বছরই সরকারের বাজেট বড় হচ্ছে। কিন্তু বাজেটের আকারের সঙ্গে সংগতি রেখে রাজস্ব আয় বাড়াতে পারেনি সরকার। ফলে বাজেটের আকার বড় হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারী হচ্ছে ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য লাখ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও বাজেটের লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকাই রাখা হয়েছে ঘাটতি বাজেটের খাতায়। দেশের জিডিপির দশমিক শতাংশই বর্তমানে ঘাটতি বাজেট। ঘাটতি বাজেট পূরণের জন্য বিদেশী উৎসের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও ঋণ নেয় সরকার। এর মধ্যে জনগণের কাছ থেকে সরাসরি ঋণ নেয়া হয় সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে। আর পরোক্ষ ঋণ নেয়া হয় ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ট্রেজারি বিল-বন্ড বিক্রির মাধ্যমে।

এক দশক আগে ২০১০ সালে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেয়া মোট ঋণের পরিমাণ ছিল লাখ ১৫ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। পাঁচ বছর পর ২০১৫ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় লাখ ২১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকায়। ২০২০ সাল শেষে তা বেড়ে হয় লাখ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। গত বছর এর পরিমাণ দাঁড়ায় লাখ ১৫ হাজার ৭১৮ কোটি টাকায়। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে সরকারের নেয়া প্রত্যক্ষ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে লাখ ৫৩ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। আর ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ট্রেজারি বিল-বন্ড বিক্রি করে সরকার লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিয়েছে। সব মিলিয়ে গত এক বছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ বেড়েছে লাখ ১৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতার কারণেই সরকারের ঘাটতি বাজেটের আকার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ঘাটতি বাজেটের আকার যত বড় হবে সরকারের ঋণও তত বাড়বে। মুহূর্তে বাজেটের অন্যতম বড় ব্যয়ের খাত হয়ে উঠেছে ঋণের সুদ পরিশোধ। বিদ্যমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে সরকারের ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকবে। দিনশেষে জনগণকেই সরকারের ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

অর্থনীতিবিদ . আহসান এইচ মনসুরও মনে করেন, রাজস্ব আদায়ে সরকারের ব্যর্থতার কারণেই প্রতি বছর ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ বাড়ছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিশ্বের কোনো দেশই এত কম রাজস্ব আয় দিয়ে চলে না। বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত শতাংশে নেমে এসেছে। এটি বাড়ানো সম্ভব না হলে অভ্যন্তরীণ বিদেশী উৎস থেকে সরকারের ঋণ বাড়বেই। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত অন্তত ২০-২২ শতাংশে উন্নীত করতে না পারলে সংকটের কোনো সমাধান হবে না।

তবে সরকারের ঋণ-জিডিপি অনুপাত এখনো অনেক বেশি হয়ে যায়নি উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, জিডিপির আকার বিবেচনায় নিলে এখনো সরকারের ঋণ নেয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আহরণের হার না বেড়ে উল্টো প্রতি বছরই কমছে। পরিস্থিতি চলতে থাকলে বাজেটের আকার বড় করে কোনো লাভ হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১০ সালের ডিসেম্বর শেষে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের মোট ঋণ ছিল লাখ ১৫ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। ঋণের মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ছিল মাত্র ৫২ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকার ঋণ। বাকি ৬৩ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা ছিল সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য খাত থেকে। ২০২১ সাল শেষে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ লাখ ১৫ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে নেয়া সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল লাখ ২০ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য খাত থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল লাখ ৯৪ হাজার ৮০১ কোটি টাকা।

অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ বাড়ায় বাবদ সরকারের সুদ ব্যয়ও বাড়ছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সুদ পরিশোধ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে খাতে ৬৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছিল সরকার। চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত লাখ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। ঘাটতির  অর্থসংস্থানে বৈদেশিক উৎস থেকে লাখ হাজার ২২৮ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। বাকি লাখ ১৩ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ নেবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি এবং সঞ্চয়পত্র অন্যান্য ব্যাংক-বহির্ভূত খাত থেকে ৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। তবে রাজস্ব আহরণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ায় অর্থবছর শেষে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ আরো বড় হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো . মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার ঋণ করতেই পারে। কিন্তু ঋণটি সাশ্রয়ী কিনা সেটি দেখা দরকার। যে উৎস থেকে কম সুদে ঋণ পাওয়া যায়, সেখান থেকে ঋণ নিতে হবে। আবার সরকারের নেয়া ঋণ কোন খাতে ব্যয় হচ্ছে সেটিও দেখতে হবে। ঋণের ব্যবহার যথাযথ না হলে সেটি জনগণের দায় বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো সুফল বয়ে আনে না।

মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, আকারের দিক থেকে সরকারের বাজেট অনেক বড় হয়েছে। কিন্তু সরকারের রাজস্ব আয়ের বড় একটি অংশ ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। সরকারের কর-জিডিপি অনুপাত শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। নেপাল-ভুটানের মতো দেশেও কর-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, আকার বড় হওয়া থেকে শুরু করে অর্থনীতির অনেক সূচকেই ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। তবে এটি ঠিক, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আমরা শুল্ক কর আদায় করতে পারছি না। কারণে বাজেটের ঘাটতি বড় হচ্ছে। যেকোনো ঋণই দায় তৈরি করে। সুদসহ ঋণ আমাদেরই পরিশোধ করতে হবে। কোনো দেশেই ঘাটতি বাজেট অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। পরিস্থিতি চলতে থাকলে সংকট গভীর হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন