এলএনজির অর্থ জোগানই এখন পেট্রোবাংলার সবচেয়ে বড় চাপ

আবু তাহের

বিশ্ববাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম ক্রমেই বাড়ছে। জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ ঠিক রাখতে বর্তমানে বাড়তি মূল্যেই পণ্যটি আমদানি করতে হচ্ছে পেট্রোবাংলাকে। সংস্থাটির বাবদ ব্যয়ও বেড়েছে কয়েক গুণ। সব মিলিয়ে বর্তমানে গ্যাস খাতে মোট ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশ অর্থই চলে যাচ্ছে এলএনজি আমদানিতে। চলতি বছরও পণ্যটি আমদানি করতে বিপুল অংকের অর্থ গুনতে হবে সংস্থাটিকে। এলএনজি আমদানিতে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে গিয়ে পেট্রোবাংলা এখন বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) পাঠানো এক চিঠিতে সম্প্রতি পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৮৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের মাত্রা ঠিক রাখতে হলে বছরে হাজার ৭৮৫ এমএমসিএম (মিলিয়ন ঘনমিটার) গ্যাস আমদানির প্রয়োজন পড়বে। চলতি অর্থবছরে পরিমাণ এলএনজি আমদানি করতে মোট ব্যয় হবে ৩২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। সে হিসেবে প্রতি এমএমসিএম এলএনজির দাম পড়বে ৩৬ টাকা ৬৯ পয়সা। এর সঙ্গে পরিচালন ব্যয়, কর, ব্যাংক চার্জ, রিগ্যাসিফিকেশনসহ আনুষঙ্গিক সব খরচ যোগ হলে এলএনজিতে মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৪৪ হাজার ২৬৫ কোটি টাকায়, যা গ্যাস খাতে পেট্রোবাংলার রাজস্ব চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশ। চলতি অর্থবছরে গ্যাস খাতে সংস্থাটির রাজস্ব চাহিদার পরিমাণ ধরা হয়েছে ৬৫ হাজার ২২৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

পেট্রোবাংলা বলছে, এলএলজি আমদানিতে ব্যয়ের যে হিসাব দেখানো হয়েছে, তা সব ধরনের খরচ যুক্ত করে। হিসাব মূলত দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানি চুক্তি স্পট মার্কেটের হিসাব ধরে করা হয়েছে। মূল্যের ওঠানামা হলে খরচ বাড়তে পারে, আবার কমেও যেতে পারে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, এলএনজি আমদানিতে আমরা যে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি, তা ৩০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। স্পট মার্কেটের বর্তমান মূল্য দীর্ঘমেয়াদি আমদানির চুক্তিমূল্য হিসাব করে এলএনজির খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি একটি সম্ভাব্য হিসাব। বাজার পরিস্থিতির ওপর ব্যয় নির্ভর করছে। তবে আমরা হিসাব করছি চলতি অর্থবছরে কোথায় কতটুকু গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিগুলো থেকে পাওয়া গ্যাসের বাইরে আমাদের কতটুকু প্রয়োজন সেটিও হিসাব করে দেখা হচ্ছে।

দেশে দৈনিক ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। গ্যাস খাতের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এর মধ্যে এলএনজি থেকে পাওয়ার কথা ৮৫ কোটি ঘনফুট। যদিও বর্তমানে দুটি রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের একটি নষ্ট হওয়ায় মোট সরবরাহে এলএনজির অবদান ১৫ শতাংশের ওপরে তোলা যাচ্ছে না।

এলএনজি আমদানির পাশাপাশি চলতি অর্থবছরে স্থানীয় বিদেশী (আইওসি) কোম্পানির উত্তোলিত গ্যাস ক্রয় বাবদ রাজস্ব চাহিদারও হিসাব তৈরি করেছে পেট্রোবাংলা। সেখানে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে এলএনজি আমদানি ব্যয়ের বাইরে গ্যাস খাতে সংস্থাটির মোট ব্যয়ের বাকি ২০ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে গ্যাস উত্তোলন পরিচালন ব্যয়ে। অর্থ দিয়ে নিজস্ব ব্যয়ের পাশাপাশি বিদেশী উত্তোলনকারী কোম্পানির (আইওসি) কাছ থেকে গ্যাস ক্রয়, স্থানীয় কোম্পানির উত্তোলন ব্যয় রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) অপারেশনাল চার্জের খরচ নির্বাহ করা হবে।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে স্থানীয় কোম্পানি বাপেক্স, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির গ্যাস উত্তোলনের ব্যয় বাবদ সংস্থাটির রাজস্ব চাহিদার পরিমাণ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে আইওসিগুলোর মধ্যে শেভরন তাল্লোর উত্তোলনকৃত গ্যাস ক্রয় বাবদ রাজস্ব চাহিদা হাজার ৫০২ কোটি টাকা। স্থানীয় কোম্পানি আইওসিগুলো মিলে চলতি অর্থবছরে ১৫ হাজার ৪৮২ এমএমসিএফ (মিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস উত্তোলন করবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলএনজির বাড়তি মূল্যের চাপ গোটা সরবরাহ ব্যবস্থাপনার ওপর পড়ছে। বাড়তি মূল্যের কারণে সৃষ্ট ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে এখন অযৌক্তিকভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা চলছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, এলএনজি আমদানি কখনই যে জ্বালানি সরবরাহের সুষ্ঠু পথ নয় সেটি আমাদের বুঝতে হবে। যে অর্থ দিয়ে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে তার অর্ধেক অর্থ দিয়ে আমরা যদি গ্যাস এক্সপ্লোরেশনে যেতে পারি তাহলে সেটি আমাদের জন্য ভালো হবে। তাতে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর গ্যাস পাওয়া গেলে আমদানীকৃত এলএনজি দিয়ে আমাদের পরিকল্পনা সাজাতে হবে না।

অন্যদিকে পেট্রোবাংলা বলছে, দেশে গ্যাস সরবরাহ ঠিক রাখতে এলএনজি আমদানির আপাতত কোনো বিকল্প নেই। আর এজন্য অর্থ প্রয়োজন। অর্থের নিশ্চয়তা পেতে হলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই। বর্তমানে এলএনজি আমদানিতে অর্থ বিভাগের কাছ থেকে বারবার অর্থ বরাদ্দ পেতে বিলম্ব হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ জোগান দিতে গিয়ে ভর্তুকি ব্যয় নিয়েও চাপে পড়ছে অর্থ বিভাগ। অবস্থায় সার, গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়াতে সংশ্লিষ্টদের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এসব খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে অর্থ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে।

বিইআরসিতে পাঠানো ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, চলতি অর্থবছরে পেট্রোবাংলার রাজস্ব চাহিদা ৬৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। অর্থকে গ্যাসের মূল্যের সঙ্গে হিসাব করলে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ২০ টাকা ৩৫ পয়সার কিছু বেশি।

খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে এলএনজির আমদানিনির্ভরতায় খুব একটা ভালো ফল নাও আসতে পারে। মূলত পরিকল্পনা দিয়ে দেশের অনুসন্ধান কার্যক্রমকে এক পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। ২০১০ সালের পর থেকে দেশে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। পর্যাপ্ত জরিপের ফল হাতে না থাকায় বিদেশী অনুসন্ধান কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করা যায়নি। ২০১৬ সালের পর বেশ কয়েকবার মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভের জন্য দরপত্র আহ্বান করেও তা পিছিয়ে দিতে হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমার ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হওয়ার পরও সেখানে কোনো অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো যায়নি। দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের সক্ষমতাকেও কাজে লাগানো যায়নি।

এদিকে আমদানি মূল্যের চেয়ে কম দামে গ্যাস বিক্রি করায় এলএনজিতে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে পেট্রোবাংলাকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হাজার কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে আড়াই হাজার কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে হাজার ৮১২ কোটি চলতি অর্থবছরে এলএনজি আমদানিতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে হাজার কোটি টাকা।

প্রসঙ্গত, দেশে বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এর বাইরে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করা হয়। ২০২০ সালের নভেম্বরের পর থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৫টি কার্গো আমদানি করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন