সংক্রমণ বাড়ছে, তবু বিধিনিষেধ পালনে অনাগ্রহ

নিজস্ব প্রতিবেদক

সংক্রমণ রোধে ১১ দফা বিধিনিষেধের মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনে আগ্রহী নয় অনেকেই ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবারো ঊর্ধ্বমুখী। চার সপ্তাহ ধরে ধারা অব্যাহত রয়েছে। ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাসটির নতুন ধরন ওমিক্রনের কারণে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির পরামর্শের আলোকে ১১ দফা বিধিনিষেধ জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সারা দেশে বিধিনিষেধ প্রতিপালনের জন্য মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কাজও শুরু করেছে। তবে গণপরিবহনসহ ঘরের বাইরে এসব বিধিনিষেধ মানার ক্ষেত্রে এখনো ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এতে দেশে করোনা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

সরকারের জারি করা ১১ দফা বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, গণপরিবহনে যাত্রী বহন করতে হবে ধারণক্ষমতার অর্ধেক। মাস্ক ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ করা হয়েছে। দোকান, শপিং মল বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা এবং হোটেল-রেস্তোরাঁসহ জনসমাগমের সব স্থানে মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিধিনিষেধ অনুযায়ী অফিস-আদালতসহ ঘরের বাইরে অবশ্যই মাস্ক পরিধান, রেস্তোরাঁয় বসে খাবার গ্রহণ আবাসিক হোটেলে থাকার জন্য করোনার টিকা সনদ প্রদর্শন করতে হবে। বিধিনিষেধ না মানলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অর্থদণ্ড কারাদণ্ডের বিধানও রাখা হয়েছে।

ঢাকা উত্তর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর অধিকাংশ হোটেল রেস্তোরাঁয় মাস্ক পরে প্রবেশকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। প্রবেশপথে রয়েছে স্যানিটাইজারও। তবে ভোক্তার কাছে টিকা সনদ আছে কিনা, তা যাচাই করাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানছে না কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, টিকা সনদ দেখানোর ক্ষেত্রে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়নি। ফলে কেবল হোটেল রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ দেখতে চাইলেও বেশির ভাগ মানুষ তা দেখাতে পারে না। এছাড়া রেস্তোরাঁর মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপও দেখা যায়নি।

একইভাবে জনসমাগম সীমিত করার বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা থাকলেও সারা দেশে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। নির্দেশনা মানাতে স্থানীয় প্রশাসনেরও পদক্ষেপে ঘাটতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এখনই সতর্ক না হলে সামনে পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করতে পারে।

সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নের তৃতীয় দিনে গতকাল রাজধানীসহ সারা দেশে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হতে দেখা গেছে। ছুটির দিন হওয়ায় ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় প্রচণ্ড ভিড় ছিল। বেশির ভাগেরই মুখে ছিল না মাস্ক। নির্দেশনার নিয়ম অমান্যকারীকে আইনের আওতায় আনার কথা বলা হলেও মাঠে তেমন কোনো তত্পরতা চোখে পড়েনি।

একইভাবে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে গণপরিবহন পরিচালনার কথা বলা হলেও রাজধানীর বাসে চালক-সহকারীদের মাস্কসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি। মাস্ক পরছে না যাত্রীরাও। সড়ক পরিবহন মালিকদের সমিতি বাসের চালক কর্মীদের মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক জানিয়ে সব পরিবহনকে চিঠি দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, মাস্ক না পরা যাত্রীকে বাসে তোলা হবে না। চালক-শ্রমিককেও পরতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। বাসে স্যানিটাইজার রাখতে হবে। তবে এসব নিয়ম বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। আবার যত আসন তত যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনা দেয়া হলেও তা মানছে না বেশির ভাগ গণপরিবহনই।

নভেল করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ মানা না হলে চরম মূল্য দিতে হবে বলে মনে করেন সরকার গঠিত করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সারা দেশের সব জায়গায় না হোক, সরকারের উচিত অন্তত শহরাঞ্চলের জনসমাগম ঠেকানো। কেননা এখন শহরাঞ্চলেই করোনার সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে। বাজার, গণপরিবহনসহ বাকি বিষয়ে সরকারের কঠোর হওয়া উচিত। সরকার এখন বলছে, বিধি না মানলে লকডাউন দেয়া হবে। লকডাউন বিষয়টি সরকারের সংস্থাগুলোকে আজও বোঝানো গেল না। দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছে দুই বছর হলো, এখনো কেন পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।

গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিষয়ে ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাস-লঞ্চ মালিকরা তা করছেন না। দেশের কোনো ক্রান্তিকালেই খাতটিকে সরকার নিয়মের মধ্যে ঠিক রাখতে পারেনি।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, লকডাউন দিলে দেশের ক্ষতি। তাই সরকার সেদিকে যেতে চায় না। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি। গতকাল দুপুরে মানিকগঞ্জে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সিটি স্ক্যান ইউনিট উদ্বোধন শেষে এসব কথা বলেন তিনি।

মন্ত্রী বলেন, করোনা সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলছে। সরকারের ১১ দফা বিধিনিষেধ না মানলে দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। তাই সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

প্রতিদিন সংক্রমণের হার - শতাংশ বাড়ছে উল্লেখ করে জাহিদ মালেক বলেন, অবস্থায় সবাইকে মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সবাইকে টিকা নিতে হবে। দেশে টিকার কোনো ঘাটতি নেই। এরই মধ্যে সোয়া ১৪ কোটি ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। প্রায় ৭০ লাখ শিক্ষার্থী টিকা পেয়েছে। বাণিজ্য মেলাসহ অনেক স্থানে সামাজিক অনুষ্ঠানে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। এটা খুবই উদ্বেগজনক। নিজের জন্য, দেশের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। মাস্ক পরার কোনো বিকল্প নেই। মাস্ক পরতে হবে যাতে আমরা সংক্রমিত না হই।

গতকাল সর্বশেষ আরো হাজার ৪৪৭ জনের শরীরে ভাইরাসটির সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। সময় আরো সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। এতে সর্বশেষ নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বিবেচনায় শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৩৫ শতাংশে।

সর্বশেষ শনাক্তদের নিয়ে দেশে মোট করোনা রোগী ১৬ লাখ ১২ হাজার ৪৮৯ জন। আর মারা গেছে ২৮ হাজার ১৩৬ জন। সর্বশেষ আরো ২৯৪ জন করোনা রোগী সুস্থ হয়ে ওঠায় মোট সুস্থতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৫২ হাজার ৬০০। ফলে দেশে বর্তমানে সক্রিয় কভিড রোগীর সংখ্যা ৩১ হাজার ৭৫৩।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন