নববর্ষ উদযাপন, শব্দদূষণ ও একজন শিশু উমায়েরের মৃত্যু

রুহিনা ফেরদৌস

কিছুদিন আগে একটা বিজ্ঞাপন খুব চোখে পড়ে। বিজ্ঞাপনটি ভারতের। সুপারশপে কেনাকাটার সময় মায়ের কাছে আতশবাজি কেনার বায়না ধরে এক শিশু। সামনে দীপাবলির দিন, চারদিকে সাজ সাজ মৌসুম। নানা রকমের আলো জ্বলবে, আতশবাজি ফুটবে, হই-হুল্লোড় হবে, আকাশ ঝলমল করে আলো-শব্দ ছড়িয়ে পড়বে চারপাশে।

শিশুটি তাই আতশবাজি কিনতে চায়। কিন্তু সন্তানের এ বায়নার কাছে হার মানেন না মা। ভারতে দীপাবলি ঘিরে যত আতশবাজি পোড়ানো হয়, তাতে বিশেষ করে দিল্লিতে ভয়াবহ দূষণ তৈরি হয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই এমনটা হচ্ছে সেখানে। আগে থেকেই দিল্লির বাতাসে দূষণের মাত্রা বেশি। বিশেষ করে শীতের সময়টায় দিল্লির পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোয় ফসল উত্তোলনের পর খড় পোড়াতে মাঠে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে বাতাসে ভর করে দূষণ ছড়িয়ে পড়ে দিল্লিতে। তাছাড়া খড় পোড়ানোর মৌসুম ও দীপাবলির উৎসব কাছাকাছি সময়ে হয়। দেখা যায় প্রতি বছর দীপাবলির পর দিল্লির দূষণ আরো বেড়ে যাচ্ছে। তাই দিল্লিতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আতশবাজি পোড়ানো। সেই নিষেধাজ্ঞার সূত্র ধরে এ বিজ্ঞাপন।

বিজ্ঞাপনটির গল্প এখানে শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু খানিক পর দেখা যায় সুপারশপের এক বিক্রেতা শিশুটিকে কাগজের পটকা চিনিয়ে দিচ্ছেন। ব্যস, মজা পেয়ে যায় শিশুটি। শুধু মৃদু শব্দ। কোনো ধরনের দূষণ না করে দীপাবলির উৎসব উদযাপনের কী চমৎকার বার্তা দেয়া। শুরু হয় স্কুলে, পার্কে, দোকানে, রাস্তায়, গলিতে, মোড়ে কাগজের পটকা ফাটিয়ে দীপাবলি উদযাপনের।

বিজ্ঞাপনের শেষ দৃশ্যটি আরো চমৎকার। ভোরে ময়লা ঝাড়ু দিতে এসে অবাক হয়ে যায় সিটি করপোরেশনের লোকটি। কোথাও কোনো ময়লা-আবর্জনা-পোড়া বারুদ নেই! পরিচ্ছন্ন-পরিষ্কার  চারপাশ।

একদিকে কভিড-১৯-এর নতুন ধরন নিয়ে শঙ্কা, অন্যদিকে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজন। এ ধরনের একটা অবস্থার মধ্য দিয়েই এবার ২০২২ সালকে বরণ করা হলো বিশ্বব্যাপী। ঢাকায়ও আতশবাজি পোড়ানো হলো। বিভিন্ন ধরনের পটকা (কাগজের না)  ফুটানো হলো। ফানুস ওড়ানো হলো।

নতুন বছরের সকাল নাগাদ খবর এল যে ঢাকায় প্রায় ৭ থেকে ১০টি জায়গায় ফানুসের কারণে আগুন লেগেছে। ফেসবুকে তো ঘুরেফিরে একটা ভিডিও ভীষণ ভাইরাল হয়েছে যে দুটো বিল্ডিংয়ের মাঝখানে আগুন জ্বলতে থাকা একটা ফানুস আটকে আছে। বাইরে থেকে লোকজন চিৎকার করছে, বাড়ির বাসিন্দাদের বিষয়টি জানানোর চেষ্টা করছে।

খ্রিস্টীয় নববর্ষ উদযাপনের সময় আতশবাজি পোড়ানো ও ফানুস ওড়াতে গিয়ে পুরান ঢাকার ধোলাইখাল এলাকার কয়েকটি দোকানে আগুন লাগার কথাও খবরে পড়েছি। এ ঘটনায় কারো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ডাকতে হয়েছে।

রাত ১২টা বাজার আগে থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা বাড়ির ছাদে আতশবাজি পোড়াতে শুরু করেন, ফানুসও ওড়ান। পুরান ঢাকার ধোলাইখাল বড় মসজিদের সামনের পাঁচতলা একটি ভবন থেকে কিছু ফানুস উড়িয়েছিল ভবনের বাসিন্দারা। ওই ফানুস ওপরে না উঠে নিচে নেমে যায়। পরে তা ভবনের বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে জড়িয়ে গেলে আগুনের সূত্রপাত হয়। সেই আগুন থেকে ভবনটির পাশের গাড়ির টায়ারের কয়েকটি দোকানে ছড়িয়ে পড়ে।

শুধু পুরান ঢাকা নয়, রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, ডেমরা, সূত্রাপুর, লালবাগ ও কেরানীগঞ্জে আগুন লাগার পর সেখানে ছুটতে হয় ফায়ার সার্ভিসের। অধিকাংশ জায়গায় আগুন লেগেছে বাসার ছাদে।

তবে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটেছে ইউসুফ রায়হানের পরিবারে। জন্মগতভাবেই হৃদযন্ত্রে ছিদ্র ছিল ইউসুফ রায়হানের চার মাস বয়সী শিশু উমায়েরের। রাজধানীর মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল তাকে। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টার আগেভাগে চারদিকে শুরু হয় নতুন বছর বরণের প্রস্তুতি। বিশেষ করে প্রায় প্রতিটি ভবনের ছাদ থেকে আতশবাজি ও পটকা ফুটানোর শব্দ সুস্থ কোনো মানুষের জন্যও স্বাভাবিক ছিল না।

যদিও বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন কারণে নতুন বছর বরণের উৎসবে নানা বিধিনিষেধ জারি রাখা হচ্ছে। তাই সংগত কারণেই রাজধানীবাসীর নতুন বছর উদযাপনের স্থল হয়ে উঠেছে বাড়ির একমাত্র ছাদটি।

ইউসুফ রায়হান ৩১ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে তার ফেসবুকে লেখেন, ‘কী বিকট শব্দ! আমার ছোট বাচ্চাটি এমনিতে হার্টের রোগী। আতশবাজির প্রচণ্ড শব্দে বাচ্চাটি আমার ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠে। খুব ভয় পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। খুব আতঙ্কে রাত পার করছি।’

শিশু উমায়ের আগে থেকেই শ্বাসকষ্টে ভুগছিল। এরপর আতশবাজির বিকট শব্দের কারণে সে সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। পরদিন সকাল থেকে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে ভর্তির ৩ ঘণ্টা পর মৃত্যু হয় তার। শিশুটি রাতের আতশবাজি ও পটকার বিকট শব্দের কারণেই অসুস্থ হয়ে মারা গেছে নাকি আগে থেকেই অসুস্থ ছিল বলে তার এমন করুণ পরিণতি হয়েছে, তা নিয়ে তর্ক চলে না। উমায়েরের মতো একটি অসুস্থ শিশু থেকে থেকে বিকট শব্দ শুনে যাচ্ছে, ভয়ে বারবার কেঁপে উঠছে—এটাই তো যথেষ্ট আমাদের জন্য।

উৎসবে অংশ নেয়া, উদযাপনে শামিল হওয়া মানুষের জীবনের অংশ। উৎসব, উদযাপন না থাকলে জীবন তো একঘেয়ে। তবে সবকিছুরই তো পরিমিতি থাকা আবশ্যক।

গত ৪ নভেম্বর যেমন দিল্লিতে দীপাবলির উৎসবের পর বায়ুর মান বিপজ্জনক স্তরে নেমে যায়। পরদিন সকালে দিল্লির আকাশ ছিল ধোঁয়ায় ধূসর। এদিকে নতুন বছরের দ্বিতীয় দিনেই বিশ্বের সবচেয়ে বায়ুদূষণের নগরীতে পরিণত হয়েছে ঢাকা। বিশ্ব বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজুয়ালের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত রোববার দুপুর ১২টায় বায়ুমান সূচকে ২০৮ স্কোর নিয়ে খুবই অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে রাজধানীর বাতাস। বেলা ৩টায় স্কোর বেড়ে হয় ২২৪। দূষণে ফের শীর্ষ দূষিত বিশ্বের ৯১ শহরের মধ্যে ১ নম্বরে উঠে আসে ঢাকার নাম। কয়েক বছর ধরে বায়ুদূষণে শীর্ষে চলে আসছে ঢাকা মহানগরী। এর আগে ১২ ডিসেম্বর বায়ুদূষণে শীর্ষ হয় ঢাকা।

আমরা যদি বর্ষবরণ করতে গিয়ে বায়ুদূষণ করি, ফানুস ওড়াতে গিয়ে ঘরবাড়ি-বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দিই কিংবা মুহুর্মুহু আতশবাজির বিকট শব্দ সৃষ্টি করে শিশু ও বয়স্কদের অসুস্থ করে তুলি তাহলে এমন উৎসব উদযাপনের লাগাম টানা জরুরি। তাছাড়া আমরা কি শুধু ইউসুফ রায়হানদের পরিবারকে সীমাহীন ক্ষতির মুখে ফেলছি, আমরা ক্ষতি করছি চারপাশের প্রাণ-প্রকৃতিরও।

লেখক: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন