আলোকপাত

উন্নয়নে দেশীয় সম্পদ-প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার প্রসঙ্গে

এম আর খায়রুল উমাম

বিশ্বকে জানার জন্য সীমাহীন কৌতূহল, অজানাকে জানার একাগ্র পথচলায় বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার। সবকিছুর প্রকৃত লক্ষ্য মানবকল্যাণ। বিজ্ঞানকে যদি মানবকল্যাণে ব্যবহার করতে হয় তাহলে প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে ভাবনার কোনো সুযোগ নেই। প্রযুক্তি হচ্ছে বিজ্ঞানের প্রায়োগিক শাখা। পৃথিবী এবং তার প্রকৃতি সম্পর্কে মানবমনের চিন্তাভাবনাগুলো পরীক্ষণ, পরিদর্শন অনুসন্ধানের মাধ্যমে আহরিত জ্ঞান ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগের দায়িত্ব প্রযুক্তির, এটাই প্রযুক্তির কাজ। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির যৌথ প্রয়াস মানুষের জীবন-জীবিকাকে সহজ করেছে। উন্নত করেছে। সীমিত সম্পদের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করে সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সভ্যতার বিবর্তন ঘটিয়েছে। উন্নত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, যোগাযোগ বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি করে চলেছে। সামাজিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য বিজ্ঞান প্রযুক্তি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থেকে নতুন নতুন ভাবনার বিস্তার ঘটিয়ে জীবনযাত্রাকে সাবলীল রাখতে প্রতিনিয়ত নতুন মাত্রা যোগ করেছে। প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের কারণে একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির উন্নত থেকে অতি উন্নত অবস্থান। তবে নিজস্ব কৃষ্টি, ইতিহাস, সমাজ, বিশ্বায়ন, রাজনীতিতে প্রযুক্তির অবস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে বিশ্বের এগিয়ে যাওয়াই কাম্য। মোদ্দাকথা, নিজস্ব বলয়ের মধ্যে থেকেই আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই দেশ এগিয়ে যাবে, কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর ইতিহাসের হাতে হাত রেখে। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহ খুব কম দেখানো হয়। সর্বত্রই প্রবণতা প্রচুর উৎসাহ দেখা যায় দেশী প্রযুক্তি ব্যবহার না করে ধার করা বিদেশী প্রযুক্তি ব্যবহারের। তবে ব্যতিক্রম দেখা যায় সমাজের নিম্নস্তরে। আমাদের সমাজের নিম্নস্তরে কিছু দেশীয় প্রযুক্তির নানা ব্যবহার কৌশল প্রতিনিয়ত দেখতে পাওয়া যায়, যা আধুনিক অনেক প্রযুক্তিবিদকে বোকা বানিয়ে দেয়। তার পরও সমাদরের পরিবর্তে দেশীয় প্রযুক্তির কপালে জোটে অবহেলা। আমাদের রাজনীতির দায়িত্ব ছিল সমাজকে প্রযুক্তিমনস্ক করে গড়ে তোলা। অগ্রসর প্রযুক্তির যথোপযুক্ত সুযোগ নিয়ে মানুষের সংকটের কার্যকর সমাধান করার উদ্যোগ রাজনীতিকেই নিতে হবে।

কিছু সাধারণ বিষয় আছে, যা জানার জন্য কাউকে জিজ্ঞেস করতে এখনো লজ্জা পাই। তেমন বিষয়ের মধ্যে একটা রাজনীতি। আগে শুনতাম, রাজনীতি হচ্ছে রাজার নীতি। এর অনেক পরে এসে নতুন করে জেনেছি রাজার নীতি নয়, নীতির রাজা হচ্ছে রাজনীতি। দ্বন্দ্বটা আজও কেটেছে তা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি না। দেশের রাজনীতির দিকে তাকালে দ্বন্দ্বটা আরো গভীরে চলে যায়। বুঝতে পারি না দেশের রাজনীতিতে নীতির রাজা বিরাজ করে কিনা? অর্জিত স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে রাজনীতিকে মেলাতে গিয়ে যখন দেখি কাজীর খাতায় যা আছে, গোয়ালে তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন সন্দেহ গভীর হয়, দ্বন্দ্বটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। স্বাধীনতা আজ স্বজাতির শাসন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আস্ফাালনে সীমাবদ্ধ। বহুজনের কল্যাণ, বহুজনের মঙ্গলের নীতি-কৌশল রাজনীতিতে আজ আর অবশিষ্ট নেই। ক্ষুদ্র অনুগামী গোষ্ঠীর কল্যাণেই আজ রাজনীতি পরিচালিত। অথচ বহুজনের কল্যাণ চিন্তা না থাকলে বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া যাবে না, প্রযুক্তিমনস্ক হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। ফলে উন্নয়নের পরশ সবাইকে স্পর্শ করে না, বৈষম্যের সৃষ্টি করে। প্রজাতন্ত্রের মালিকরা আজ ভুলতে বসেছে, তারাই দেশের প্রকৃত মালিক। রাজনৈতিক মহল প্রযুক্তির অঙ্গীকার জনগণের প্রত্যাশিত ইচ্ছার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হলে সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি ত্বরান্বিত হবে। 

দেশের উন্নয়নের সিংহভাগ অর্থই ব্যয়িত হয় কারিগরি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। কিন্তু জনগণের কষ্টার্জিত করের অর্থ প্রযুক্তিভিত্তিক কোনো ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগে বরাদ্দ করা যুক্তিযুক্ত কিনা তা বিবেচনার দাবি রাখে। যেকোনো প্রযুক্তিভিত্তিক প্রস্তাবনা প্রকৃত দেশ জাতির জন্য কল্যাণকর কিনা, তা ব্যয়বহুল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রথমে যাচাই-বাছাই জরুরি। কিন্তু দেশের সর্বত্র অর্থ ব্যয়ের দিকে নজর দিলে সংকটের চেয়ে মানসিকতার অভাব প্রবল বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে আমাদের দেশে বিশেষজ্ঞদের কোনো অভাব নেই, সবাই বিশেষজ্ঞ। কোনো কাজই তারা নিজেরা পারে না, অথচ বিদেশী জনবল ব্যবহার করে করা হলে তা বুঝে নেয়ায় বিশেষজ্ঞের অভাব হয় না। আর এই বোঝার মধ্যেই রয়েছে সব গণ্ডগোল। কোনো উদ্যোগে যদি অর্থের পরিমাণ বিশাল হয় তাহলে দ্রুত লাভের আশা দেখিয়ে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা হয়ে যায়। কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ, যানবাহন, খাদ্য, প্রকৃতি পরিবেশ সর্বত্র দায়বদ্ধতা জবাবদিহিতাহীন বিদেশী ফর্মুলার উদ্যোগের ছড়াছড়ি। নিজেদের কৃষ্টি-কালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য বিবেচনা করে উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা হয়েছে এমনটা দেখা যায় না। প্রযুক্তিমনস্ক রাজনীতি, বিজ্ঞানমনস্ক রাজনীতির মধ্যে থাকার সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে অবস্থা থেকে মুক্তির পথ পাওয়া সম্ভব ছিল। দেশের রাজনীতি নিজেদের যেকোনো উদ্যোগ বিচার-বিশ্লেষণের জন্য বিজ্ঞান প্রযুক্তির প্রজ্ঞায় সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজায় প্রচেষ্টারত হলেই জনগণকে প্রযুক্তি নির্মিত সমাজ উপহার দিতে সক্ষম হতো। বিশ্বের প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব উদ্যোগের ভিত রচনা করতে নিজস্ব কর্মশক্তির ওপর বিশ্বাস রেখে রাজনৈতিক সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনির্মাণ সাধন প্রয়োজন। স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের সব কর্মকাণ্ড সফল করতে হলে বিজ্ঞান প্রযুক্তির সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।

আমাদের দেশটা নদীমাতৃক। সারা দেশে জালের মতো বিছিয়ে আছে নদী। নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে জনপদ। জীবন-জীবিকায় সহায়ক সুপেয় পানিপ্রাপ্তির নিশ্চয়তার সঙ্গে যাতায়াত ব্যবস্থার সহজলভ্যতা বিবেচনা করে নদীর ধারে গড়ে উঠেছে বিশ্বের বিখ্যাত সব নগর। নদীর সুবিধাগুলো আমাদের রাজনীতি শুধু অবহেলা করেছে তা- নয়, সচেতনভাবে অবজ্ঞা করেছে। বিশ্বব্যাপী সবাই জানে নৌপথ অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে সুলভ নিরাপদ। তার পরও দেশের রাজনীতি জালের মতো বিছিয়ে থাকা নদীর সুবিধা নিয়ে নৌপথ গড়ে না তুলে ব্যয়বহুল সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় দ্বিতীয় সুলভ নিরাপদ রেল পরিবহনকে অবহেলা করে তা বৃদ্ধি না করে সংকোচন করা হয়েছে। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। নৌপথ, রেলপথ উন্নয়ন সাধনের উদ্যোগ আজও আন্দোলনের মধ্যে আটকে আছে। এতে জনগণ সুলভ নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সড়কের ওপর চাপ বাড়ছে, যাতে নির্মিত সড়কগুলো জীবনকালে পাচ্ছে না।

সবুজ বিপ্লব ঘটাতে গিয়ে প্রকৃতিকে ধ্বংস করা হয়েছে। জলাভূমি নষ্ট করা হয়েছে, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করা হয়েছে, বনভূমি বিরান করে দেয়া হয়েছে। ধান একমাত্র খাদ্য বিবেচিত হওয়ায় আমরা মাছের কথা ভুলেই গেছি। তাই সমুদ্র থেকে মাছ ধরে প্রোটিনযুক্ত খাদ্যের একটা বিরাট উৎস সৃষ্টি করার ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ পর্যন্ত দেখা যায় না। রাসায়নিক সার কীটনাশক ব্যবহার কী ভয়ংকরভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে চলেছে তা আজ সর্বজনবিদিত।

উন্নয়নের উদ্যোগগুলো নির্ধারিত সময়ে ব্যয়ে শেষ করার কোনো বাস্তব ব্যবস্থাপনা দেশে দেখা যায় না। স্বাধীন মানুষ নিজের কাজ বিবেচনায় অর্থ ব্যয়ে আন্তরিক থাকে। সবসময় প্রচেষ্টারত থাকে টাকার কোনো কাজ টাকার কমে করতে। কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবনে ভাবনার কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। দেশে প্রায় সব বড় বড় উদ্যোগ টাকার কাজ টাকা এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা আরো অনেক বেশি টাকায় শেষ করা হয়। শুধু তা- নয়, এসব উদ্যোগ জীবনকাল পায় না। লক্ষ্য উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়, জাতির ঘাড়ে একের পর এক লোকসানের বোঝা চাপে। দেশের একাধিক সার কারখানার নির্মাণকাজ নির্ধারিত ব্যয় সময়ের কয়েক গুণ বেশি অর্থে শেষ করা হয়েছে। একাধিক সেচ উদ্যোগ, সড়ক নির্মাণ, সেতু নির্মাণ প্রভৃতি উদ্যোগের একই অবস্থা। আমাদের পাট শিল্প, চিনি শিল্প, ইস্পাত শিল্প রাসায়নিক শিল্পের মতো অনেক শিল্প লোকসানের অজুহাতে বন্ধ করা হয়েছে। তিন শিফটের পরিবর্তে এক শিফট চালানো হয়েছে, যথাসময় কাঁচামাল সরবরাহ করা হয়নি, আধুনিকীকরণ করা হয়নি। সময়ে সার কারখানায় উৎপাদন হয় না, তাই আমদানি করতে হয়, ফলে বাজারে সারের মূল্য বৃদ্ধি পায়। আবার কোনো সেচ উদ্যোগই লক্ষ্যমাত্রার সেচ সুবিধা দিতে পারেনি। পুরো প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে জনগণ আজ বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে দেশের সব উদ্যোগের এটাই স্বাভাবিক পথ, এটাই তাদের ভবিতব্য। ব্যক্তিজীবনে যা কাম্য, রাষ্ট্রীয় জীবনে তার লেশমাত্র নেই।

দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকে যদি সার্বিক জনকল্যাণে নিবেদিত করতে হয়, তাহলে প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সঠিক প্রযুক্তি নির্বাচন করে আন্তরিকতার সঙ্গে ব্যবহার করার পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। বিশ্বে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন হচ্ছে, তা থেকে নিজেদের জন্য কল্যাণকরগুলো খুঁজে প্রয়োগ করতে হবে। এটা করা না হলে প্রযুক্তির অপব্যবহার হতে বাধ্য, যা অভিশাপ হিসেবে মানুষের জীবনে নেমে আসে। আমাদের দেশে প্রযুক্তির অভিশাপের অনেক উদাহরণ চোখের সামনে ভাসছে। অতীতে যেমন ছিল, এখনো তা সমানভাবে দেখা যাচ্ছে। পৃথিবীর অন্যতম ব্যয়বহুল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নির্মাণ চলমান থাকাকালীন তার জীবনকাল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের ঝিকরগাছায় নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে, যার নিচ দিয়ে বর্ষা মৌসুমে নৌকা চলাচলের উচ্চতা রাখা হয়নি। যশোর-খুলনা মহাসড়ক দশকের পর দশক চলাচলের অনুপযোগী রয়ে গিয়েছে।

প্রযুক্তি প্রকৃতই একটা সৃজনশীল ধারণা। ধারাবাহিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রশিক্ষকের মাধ্যমেই সঠিক প্রযুক্তির প্রয়োগ সম্ভব। প্রতিভার বিকাশ সঠিক প্রয়োগ যেকোনো উদ্যোগকে লক্ষ্যে পৌঁছতে সহযোগিতা করতে পারে। এখন রাজনৈতিক মহলকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কেমন বাংলাদেশ চায়।

 

এম আর খায়রুল উমাম: প্রকৌশলী

সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন