বাংলাদেশী ব্যাংকের সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্যিক সম্পর্ক চায় চীনা ব্যাংকগুলো

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশে আমদানি পণ্যের এক-চতুর্থাংশই আসে চীন থেকে। গত অর্থবছরেও দেশটি থেকে প্রায় হাজার ৩০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। অন্যদিকে চীনের বাজারেও বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। দুই দেশের বাণিজ্যের পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পর্কও এখন দ্রুতগতিতে জোরদার হচ্ছে। দেশটির ব্যাংক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেন বাড়াতে আগ্রহী। তবে লেনদেনগুলো ডলার বা অন্য কোনো মুদ্রার পরিবর্তে নিজস্ব মুদ্রায় সম্পন্ন করতে আগ্রহী চীনারা।

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ২০১৮ সালেই চীনা মুদ্রা ইউয়ানে (রেনমিনবি) বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাব চালুর অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই বছরের ১৪ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বৈদেশিক বাণিজ্যের অনুমোদনপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলো ডলার, পাউন্ড স্টার্লিং, ইউরো, ইয়েন কানাডীয় ডলারের পাশাপাশি ইউয়ানেও হিসাব খুলতে পারবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই নির্দেশনা জারির পর দেশের বেশকিছু ব্যাংক চীনা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ইউয়ানে হিসাবও খুলেছে।

শুরুতে বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি চীনা ব্যাংকগুলো। কিন্তু বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রায় হিসাব চালু করা নিয়ে চীনের বড় অনেক ব্যাংকই এখন তত্পর হয়ে উঠেছে। চীনা অনেক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানই নিয়ে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে প্রস্তাব দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে।

তবে বিষয়টিকে দেশের ব্যাংকাররা দেখছেন বাড়তি বিড়ম্বনা হিসেবে। বাংলাদেশী অন্তত এক ডজন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, চীনা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে তারা ইউয়ানে হিসাব চালুর প্রস্তাব পেয়েছেন। এক্ষেত্রে চীনা ব্যাংকগুলো ঋণপত্রের (এলসি) কমিশনে ছাড় দেয়া থেকে শুরু করে বড় অংকের ঋণ দেয়ার প্রস্তাবও দিচ্ছে। তবে দেশের ব্যাংক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বিষয়টি নিয়ে বেশ সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে।

এক্ষেত্রে ব্যাংক নির্বাহীদের যুক্তি হলো, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। দেশটিতে বাংলাদেশের বার্ষিক রফতানি সব মিলিয়ে বিলিয়ন ডলারও নয়। ইউয়ানে ঋণপত্র খুললে বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোকে দায় পরিশোধ করতে হবে ডলার দিয়ে ইউয়ান কিনে।

যদিও চীনা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রায় হিসাব চালু ঋণপত্র খোলার বিষয়ে উৎসাহ দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, চীন আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচারে অনেক আগেই আমরা ব্যাংকগুলোকে চীনা মুদ্রায় ক্লিয়ারিং হিসাব চালুর অনুমোদন দিয়েছি। এরই মধ্যে অনেক ব্যাংক ধরনের হিসাব চালুও করেছে। চীনা ব্যাংকগুলো এখন নিজস্ব মুদ্রায় ক্লিয়ারিং হিসাব চালু ঋণপত্র খোলার বিষয়ে অনেক আগ্রহী। অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশের ব্যাংকগুলোর জন্য চীনা ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের সুযোগ রয়েছে।

বৈদেশিক বিভিন্ন মুদ্রায় ক্লিয়ারিং হিসাব চালুর অনুমোদন থাকলেও দেশের ব্যাংকগুলোকে যেকোনো ঋণপত্রের দায় পরিশোধ করতে হয় ডলার বা ইউরোয়। দুটির বাইরে অন্য কোনো বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণপত্রের দায় পরিশোধের সুযোগ নেই। দেশের রফতানি বাণিজ্যের পাশাপাশি রেমিট্যান্সের অর্থেরও সিংহভাগ আসে ডলারে। আবার বাংলাদেশের আমদানি ঋণপত্রের বৃহৎ অংশের দায়ও ডলারে পরিশোধ করা হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক কূটনৈতিক দ্বৈরথে অস্থিতিশীল এবং নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে ডলারের বাজার। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শ্লথতাও ডলারের অবস্থানকে দুর্বল করে তুলেছে। অবস্থায় বিশ্ববাজারে আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ইউরো। দেশের ব্যাংকগুলোও এখন ডলারের চেয়ে ইউরোয় দায় পরিশোধে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে।

সম্প্রতি চীনের বৃহত্তম প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ে তার গ্রাহকদের ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে ডলারের চেয়ে ইউরোকে বেশি প্রাধান্য দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসায়িক বিরোধের জেরে ডলারে লেনদেন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে কোম্পানিটি।

চীনাদের সঙ্গে বাংলাদেশীদের ব্যবসায়িক লেনদেনের প্রায় ৯৫ শতাংশই হয় চীনের বৃহৎ চার ব্যাংকের মধ্যস্থতায়। ব্যাংক চারটি হলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না, এগ্রিকালচার ব্যাংক অব চায়না, ব্যাংক অব চায়না চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক। চীনের বৃহৎ ব্যাংকগুলো বিশ্বেরও সবচেয়ে বড় ব্যাংক। বৈদেশিক বাণিজ্যের অনুমোদনপ্রাপ্ত বাংলাদেশের প্রায় সব ব্যাংকের সঙ্গেই চার ব্যাংকের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। তবে চীনা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে দেশের ব্যাংক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগ হিসাবই পরিচালিত হয় ডলার বা ইউরোয়।

চীনা ব্যাংক থেকে ইউয়ানে হিসাব চালুর প্রস্তাব পাওয়ার বিষয়টি বণিক বার্তাকে নিশ্চিত করেছেন বেসরকারি খাতের দ্য সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন, ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম। তারা জানিয়েছেন, এর আগেও চীনের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রস্তাব এসেছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তা বেড়েছে।

বিষয়ে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বণিক বার্তাকে বলেন, চীনের পাঁচটি ব্যাংকের সঙ্গে রেনমিনবিতে ইসলামী ব্যাংকের হিসাব চালু রয়েছে। এখন নতুন করে আরো কয়েকটি ব্যাংক থেকে হিসাব চালুর প্রস্তাব এসেছে। আমরা প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করছি। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হলে চীনা মুদ্রায় ক্লিয়ারিং হিসাব চালুতে আমাদের আপত্তি নেই।

তবে বড় ধরনের লেনদেন না থাকলে চীনের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রায় হিসাব চালু করে কোনো লাভ নেই বলে মনে করছেন সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিদেশী ব্যাংকের সঙ্গে ডলার বা ইউরোয় হিসাব চালু করলে সেটি ব্যাংকের জন্য লাভজনক। কারণ বিদেশী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে চালু করা হিসাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখতে হয়। ডলারে জমা রাখলে সেটির বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সোয়াপ করা যায়। কিন্তু চীনা মুদ্রায় জমা থাকলে সেটির জন্য সোয়াপ করা যায় না।

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, এনসিসি ব্যাংকের এমডির দায়িত্বে থাকাকালে আমি চীনের একটি ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসায়িক বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়েছিলাম। তখন ওই ব্যাংকের পক্ষ থেকে চীনা মুদ্রায় ক্লিয়ারিং হিসাব চালুর প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, চীনা মুদ্রায় হিসাব চালু করলে লাভের চেয়ে আমাদের ক্ষতিই বেশি হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন