কৃষি

অপুষ্টি মোকাবেলায় জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান প্রসঙ্গে

ড. সুরজিত সাহা রায়

দানাদার শস্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও অপুষ্টিজনিত অদৃশ্য ক্ষুধায় ভুগছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনগোষ্ঠী। ২০১৮ সালের জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ২১ দশমিক শতাংশ এবং হতদরিদ্রের হার ১২ দশমিক শতাংশ। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে খর্বতার হার ৩১ শতাংশ (বিডিএইচএস ২০১৯) ৫০ শতাংশেরও বেশি জনসংখ্যার সুষম খাবারের ঘাটতি রয়েছে। ভিটামিন , ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক আয়রনের অভাব উল্লেখযোগ্য। পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪১ শতাংশ শিশু জিঙ্কের অভাবে ভুগছে। ১৫-১৯ বছর বয়সী মেয়েদের প্রায় ৪৪ শতাংশ অপুষ্টির কারণে বেঁটে বা লম্বায় কম। অপুষ্টির ঘাটতি মেটাতে না পারলে স্থূলতা অসংক্রামক রোগের প্রবণতা বাড়তে পারে। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে মিল রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের অবসান, ক্ষুধার অবসান উন্নত পুষ্টিমান অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

মানবদেহের জন্য জিঙ্ক খুব প্রয়োজনীয় একটি খনিজ উপাদান। মানবদেহের ৩০০টি এনজাইমের সঙ্গে জিঙ্ক সরাসরি কাজ করে, যেগুলো দেহের অনেক বিপাকীয় কাজে অংশ নেয়। জিঙ্কের অভাবে মুখের রুচি নষ্ট হয়, স্বাদ গন্ধ নষ্ট হয়, ওজন কমে যায় অথবা মুটিয়ে যায়, চুল পড়ে যায়, হজমে সমস্যা হয়, জটিল ধরনের অবসাদগ্রস্ততা দেখা দেয়, বন্ধ্যত্ব দেখা দেয়, হরমোনের সমস্যা হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, মনোযোগ স্মরণশক্তি কমে যায়, ত্বকের ক্ষত সারতে দেরি হয় এবং স্নায়বিক দুর্বলতা দেখা দেয়। মানবশরীর জিঙ্ক সংরক্ষণ করে রাখতে পারে না বিধায় প্রতিদিনই একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের ১১ মিলিগ্রাম এবং নারীর মিলিগ্রাম জিঙ্ক গ্রহণ করতে হবে। গর্ভবতী মায়েদের দৈনিক ১১ মিলিগ্রাম, দুগ্ধদানকারী মায়েদের ১২ মিলিগ্রাম জিঙ্ক প্রয়োজন এবং শিশুদের দৈনিক চাহিদা - মিলিগ্রাম জিঙ্ক।

লাল মাংস জিঙ্কের ভালো উৎস। ১০০ গ্রাম গরুর মাংসে দশমিক মিলিগ্রাম জিঙ্ক থাকে, যা দৈনিক চাহিদার ৪৪ শতাংশ মেটায়। ১০০ গ্রাম ছোট চিংড়ি দৈনিক চাহিদার ১৪ শতাংশ মেটায়। ১০০ গ্রাম রান্না কার ডাল মেটাতে পারে চাহিদার মাত্র ১২ শতাংশ। বাদামে প্রচুর জিঙ্ক আছে। ২৮ গ্রাম বাদাম চাহিদার ১৫ শতাংশ, পনির ২৮, এক কাপ দুধ এবং একটি ডিম শতাংশ জিঙ্কের চাহিদা মেটাতে পারে। মাংস, ডিম, দুধ, পনির, বাদাম, চিংড়ি দামি খাবার হওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে। লাল মাংস চিংড়িতে কোলেস্টেরল বেশি থাকায় বয়স্ক মানুষ ডাক্তারের পরামর্শে এসব খাবার এড়িয়ে চলেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খাদ্যের মাধ্যমে পুষ্টির জোগান স্লোগান সামনে রেখে আমাদের বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ছয়টি জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট একটি ধানের জাত এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট একটি জিঙ্কসমৃদ্ধ গমের জাত উদ্ভাবন করেছেন। উদ্ভাবিত জিঙ্কসমৃদ্ধ জাতগুলোয় প্রতি কেজি চালে ২২ থেকে ২৭ মিলিগ্রাম জিঙ্ক থাকে, যেখানে সাধারণ চালে থাকে মাত্র ১৫ মিলিগ্রাম জিঙ্ক। প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম জিঙ্কসমৃদ্ধ চালের ভাত খেলে একজন ভোক্তা প্রতিদিন -১০ মিলিগ্রাম জিঙ্ক পেতে পারে, যা দৈনিক চাহিদার প্রায় সমান।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বিশ্বে সর্বপ্রথম ২০১৩ সালে জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত ব্রি ধান-৬২ উদ্ভাবন করে। এরপর একে একে ব্রি ধান-৬৪, ব্রি ধান-৭২, ব্রি ধান-৭৪, ব্রি ধান-৮৪ এবং সর্বশেষ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উচ্চ জিঙ্কসমৃদ্ধ ব্রি ধান-১০০ অবমুক্ত করে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট জিঙ্কসমৃদ্ধ বিনা ধান ২২ নামের ধানের জাত এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০১৭ সালে বারি গম-৩৩ উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশে গত বছর অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে বোরো মৌসুমে ব্রি ধান-৭৪ ব্রি ধান-৮৪-এর আবাদ হয়েছে যথাক্রমে ৫৭ হাজার ২৪৫ হাজার ৮২৯ হেক্টর জমিতে। বছর জাত দুটির আবাদ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃহত্তর বরিশাল জেলার লোকেরা মোটা চাল পছন্দ করে বিধায় ওই অঞ্চলে ব্রি ধান-৭৪-এর আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যান্য জেলায় মোটা চালের বাজারমূল্য কম থাকা সত্ত্বেও অধিক ফলন, রোগবালাই জীবনকাল তুলনামূলক কম হওয়ায় কৃষকদের মাঝে জাতটি আবাদে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জিঙ্কসমৃদ্ধ হওয়ায় জাতের চালের ভাত খাওয়ার ব্যাপারে সারা দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। কৃষক তার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ধান সিদ্ধ করে ভ্যানচালিত কলে চাল করে নিজেরা খান এবং অতিরিক্ত চাল স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। কিন্তু ব্যাপক সচেতনতা না থাকায় এবং জাতগুলো নতুন হওয়ায় এখন পর্যন্ত আলাদা করে পরিচিত না হয়ে ওঠার কারণে বাজারে জিঙ্কসমৃদ্ধ কোনো জাতের চাল আলাদা করে কিনতে পাওয়া যায় না বাংলাদেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে। তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণে চাষ হওয়ায় ভোলা, বরিশাল ঠাকুরগাঁও জেলার কিছু এলাকায় অবশ্য আলাদা করে জিঙ্কসমৃদ্ধ চাল পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাপারে আরো বেশি সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন এবং জিঙ্কসমৃদ্ধ চাল সরকারি বিভিন্ন খাদ্যসহায়তা কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

 

. সুরজিত সাহা রায়: ভারপ্রাপ্ত পরিচালক

কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা



এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন