পর্যালোচনা

স্টার্টআপ ফান্ড: গন্তব্য ভালো পথ কি সঠিক?

শওকত হোসেন

বাংলাদেশ ব্যাংক দুটি স্টার্টআপ ফান্ড তৈরির জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিয়ে গত ২৯ মার্চ ২৬ এপ্রিল পরিপত্র জারি করেছে। উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। এছাড়া ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে তাদের বার্ষিক নিট মুনাফার শতাংশ দিয়ে স্টার্টআপ তহবিল গঠন করতে। উদ্যোগের উদ্দেশ্য হিসেবে পরিপত্রে বলা হয়েছে, সহজলভ্য ব্যাংকঋণ/বিনিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি এবং স্বকর্মসংস্থান আবশ্যক বিবেচনায় দুটি স্টার্ট ফান্ড গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

নির্দেশনা অনুসরণ করার পর ৬১টি ব্যাংকে শতাধিক (কিছু ব্যাংক নিট লসে আছে, তারা চাইলে হয়তো একটি ফান্ড করতে পারবে) স্টার্টআপ ফান্ড তৈরি হবে, আশা করা যায়। খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু যে পথ বা পদ্ধতি বেছে নেয়া হয়েছে, তাতে কি গন্তব্যে পৌঁছা যাবে? ব্যাপারটা খোলাসা করার জন্য একটা কৌতুক বলি।

এক লোক রাত্রে রাস্তার ধারে কী যেন খুঁজছিল। পাশে ফুটপাতে আরেক লোক অনেকক্ষণ ধরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। তার কৌতূহল হলো প্রথম লোকটার ব্যাপারে। জানতে চাইল, কী খুঁজছেন আপনি? প্রথম লোকটা বলল, আমার গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস পকেট থেকে পড়ে গেছে। এখন পাচ্ছি না।

কী জিনিস, বলা যাবে? তাহলে আমিও একটু খুঁজি। আপনাকে সাহায্য করতে পারি কিনা, দেখি!

আমার আইডি কার্ড।

দ্বিতীয় লোকটাও এসে খুঁজতে লাগল। অনেকক্ষণ খুজল। পেল না। একসময় দ্বিতীয় লোকটা বলল, জিনিসটা ঠিক কোন জায়গায় পড়েছে, একটু নির্দিষ্ট করে দেখান তো, তাহলে খুঁজতে সুবিধা হবে।

প্রথম লোকটা হাত দিয়ে যে জায়গা দেখাল, সেটা প্রায় ১৫-২০ হাত দূরে।

দ্বিতীয় লোক অবাক হয়ে বলল, আপনি হারিয়েছেন ওইখানে আর খুঁজছেন এইখানে। এভাবে খুঁজলে কি কোনো দিন আপনার হারানো জিনিস পাবেন?

প্রথম লোক যা বলল তা শুনে দ্বিতীয় লোক স্তব্ধ। প্রথম লোক বলল, এখানে ল্যাম্পপোস্টের নিচে আলো আছে, খুঁজতে পারছি। ওইখানে তো অন্ধকার। ওইখানে কীভাবে খুঁজব?

স্টার্টআপকে অর্থায়ন করাটা উদ্দেশ্য কিন্তু মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে ব্যাংককে। স্টার্টআপের প্রয়োজন পুঁজি আর ব্যাংক চরিত্রগতভাবে ডেট বা ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান। দুটি দুই মেরুর। পুঁজি বিতরণের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান আছেফান্ড ম্যানেজার বা তহবিল ব্যবস্থাপক। অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট রুল ২০১৫-এর অধীনে তারা নিবন্ধিত। তাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বা বিসেক। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান ব্যতিরেকেও কিন্তু অর্থায়ন করে থাকে, যেমন গৃহ নির্মাণ ঋণ, করোনা প্রণোদনার ঋণ এমএফআইদের মাধ্যমে বিতরণ করছে। এমএফআইরা মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি বা এমআরএ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

যদিও পরিপত্রে ঋণ সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগ শব্দ যুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু গোটা পরিপত্রের যে ভাব বা স্পিরিট, তাতে ঋণের কথাই ফুটে ওঠে। কিছু অনুচ্ছেদ উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক:

অনুচ্ছেদ অনুসারে, গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ/বিনিয়োগ পরিশোধের মেয়াদ: গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের মেয়াদ হবে বছর। ব্যাংকার গ্রাহক সম্পর্ক স্টার্টআপ উদ্যোগের ধরন বিবেচনায় গ্রেস পিরিয়ড নির্ধারণ করা যাবে, তবে তা বছরের বেশি হবে না। ঋণ/বিনিয়োগ পরিশোধের লক্ষ্যে ত্রৈমাসিক বা ষাণ্মাসিক ভিত্তিতে কিস্তি নির্ধারণ করা যাবে। এখানে সাব টাইটেলে ঋণ/বিনিয়োগ উল্লেখ থাকলেও বিষয়বস্তুতে শুধু ঋণ বলা হয়েছে।

বিনিয়োগ যদি পুঁজি হয়, তাহলে কিন্তু পরিশোধযোগ্য নয়। কারণ বিনিয়োগ করা হয় কোম্পানির শেয়ারের বিনিময়ে। কোম্পানি আইন ১৯৯৪ অনুসারে, কোম্পানি তার নিজের শেয়ার কিনতে পারে না। ব্যাংকের বিনিয়োগ পরিশোধ করতে হলে তো স্টার্টআপকে তার শেয়ার ব্যাংক থেকে কিনে নিতে হবে বা টাকা দিয়ে শেয়ার ফেরত নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্টার্টআপকে তুলনা করা যায় শিশুর সঙ্গে, যার বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন আরো পুষ্টি তথা খাদ্য। সেক্ষেত্রে তার কাছ থেকে টাকা ফেরত নেয়া মানে ওই শিশুর দেহ থেকে রক্ত নেয়া। এমন পরিস্থিতিতে শিশুসম স্টার্টআপ কীভাবে বাঁচবে? সব দেখে মনে হয়, অনুচ্ছেদ ঋণের কথা মাথায় রেখেই লেখা হয়েছে। স্টার্টআপের টাকা ফেরত আসে তিনটি পদ্ধতিতে। উদ্যোক্তা (কোম্পানি নয়) নিজে, তার উদ্বৃত্ত টাকা থাকলে অথবা অন্য কোনো উৎস থেকে টাকা এনে বিনিয়োগকারীর শেয়ার কিনে নেন। স্টার্টআপ ভালো করলে আইপিওতে যেতে পারে অথবা অন্য কোনো কোম্পানি স্টার্টআপটি কিনে নিতে পারে। ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ভাষায় এটিকে (বিনিয়োগকারীর টাকা ফেরত পাওয়া) বলে এক্সিট। সিলিকন ভ্যালির তথ্য অনুসারে, আইপিও এর চেয়ে মার্জার একুইজিশনের মাধ্যমে (২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত আইপিও ৭৭১টি মার্জার একুইজিশন ৯০২৩টি) এক্সিট বেশি হয়।

অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ/বিনিয়োগের বার্ষিক সরল  সুদ/মুনাফার হার হবে  সর্বোচ্চ শতাংশ। অনুচ্ছেদে যদিও সুদ মুনাফা দুটো শব্দই উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু মুনাফা তো নির্দিষ্ট হারে হয় না। তদুপরি লোকসান হলে কী হবে, তার কোনো নির্দেশনা নেই। স্টার্টআপে ফেল বা ব্যর্থতার হার অনেক বেশি। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের প্রফেসর শিখর ঘোষ ২০০৪ থেকে ২০১০ সালের ভিসি ফান্ড পাওয়া হাজারটি স্টার্টআপের ওপর গবেষণা করে দেখেছেন, ফেইলিউরের হার ৭৫ শতাংশ। তার মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ স্টার্টআপে বিনিয়োগকারীর টাকা সম্পূর্ণভাবে মারা গেছে। বাকি ৪৫ শতাংশ তাদের বিনিয়োগকারীর টাকা ফেরত দিতে পেরেছে, কেউ কেউ সামান্য কিছু লাভও দিয়েছে। যাদের সফল বলা হয়েছে, অর্থাৎ ২৫ শতাংশ স্টার্টআপ, তাদের ফরমাল এক্সিট হয়েছে, অর্থাৎ কেউ কিনে নিয়েছে বা আইপিও হয়েছে। এত লোকসানের পরও ফান্ড ম্যানেজাররা আশায় থাকেন (এবং সেজন্য প্রাণপণ খাটেন), একটি ইউনিকর্ন বা বিলিয়ন ডলার কোম্পানির, যা পোর্টফোলিওর অন্য সব ব্যর্থ স্টার্টআপের ক্ষতি পুষিয়ে দেবে। হয়তো ভালো লাভও বয়ে আনবে। অনেক ফান্ড ব্যবস্থাপক ইউনিকর্নের দেখা পায়। অনেকে পায় না। যে ফান্ড ব্যবস্থাপক যত ভালোভাবে তার পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা করতে পারে, সে তত বিনিয়োগ আকর্ষণ করে। এটাই ফান্ড ব্যবস্থাপনার রুল অব দ্য গেম।

অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অনুমোদিত ঋণ এককালীন বিতরণ করা যাবে না। প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনান্তে ঋণ বিনিয়োগের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত হয়ে ন্যূনতম তিন কিস্তিতে বিতরণ করতে হবে। পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করতে হলে শেয়ার কল অনুযায়ী টাকা প্রদান করতে হয়, প্রকল্পের অগ্রগতির সঙ্গে সংযুক্তির অবকাশ নেই। শেয়ারহোল্ডাররা রাজি হলে পুরো টাকা একসঙ্গেও দিতে হতে পারে।

অনুচ্ছেদ ১০ অনুসারে ঋণ/বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গ্যারান্টি বা শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ বা কারিগরি প্রশিক্ষণের সনদকে জামানত হিসেবে বিবেচনা করা যাবে। ব্যাংক পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করলে ওই স্টার্টআপের উদ্যোক্তাদের মতো ব্যাংকও একজন শেয়ারহোল্ডার বৈ কিছু নয়। সুতরাং ব্যাংক অন্যদের কাছ থেকে জামানত চাইতে পারে না। জামানত ঋণের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, পুঁজির ক্ষেত্রে নয়। স্টার্টআপের ক্ষতি হলে ব্যাংক সেই ক্ষতি তার শেয়ারের আনুপাতিক হারে ভাগ করে নিতে হবে। অবশ্য লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে ব্যাংকের দায় তার বিনিয়োজিত শেয়ারের টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ সর্বোচ্চ ক্ষতি, তার বিনিয়োজিত টাকা পুরোটাই জলে যেতে পারে।

অনুচ্ছেদ ১২ অনুযায়ী ঋণ/বিনিয়োগ প্রস্তাব ব্যাংকের নিজস্ব ঋণ নীতিমালা অনুযায়ী অনুমোদিত হবে। ব্যাংকদের ঋণ নীতিমালা আছে। পুঁজি বিনিয়োগ নীতিমালা কি আছে? ঋণ আর পুঁজি বিনিয়োগ নীতিমালা সম্পূর্ণ আলাদা। তাছাড়া শুধু নীতিমালা থাকলেই হবে না, পুঁজি বিনিয়োগের আলাদা দক্ষ লোকবল প্রয়োজন। আলাদা মাইন্ড সেট প্রয়োজন। ঋণের তুলনায় পুঁজি বিনিয়োগে অধিক ঝুঁকি নিতে হয়। স্টার্টআপের ক্ষেত্রে মনিটরিংয়ে অধিক সময় দিতে হয়। পর্ষদের সেই ইচ্ছা মনোবৃত্তি থাকতে হয়। স্টার্টআপ থেকে রিটার্ন অনেক দেরিতে আসে। সেই ধৈর্য পর্ষদের না থাকলে এটি একটি পণ্ডশ্রমে পরিণত হবে। 

স্টার্টআপে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু ঝুঁকি হ্রাসে মনোযোগ দিলে হয় না। কোনো সুযোগ যেন হাত ফসকে না যায়, তাও বিবেচনা করতে হয়। সেই হাত ফসকানো স্টার্টআপটি হয়তো বিলিয়ন ডলার কোম্পানিতে পরিণত হতে পারে। বিনিয়োগকারীদের তখন আফসোসে মাথা কুটতে হয়।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে চাইলে পূর্ব দিকে যেতে হবে। পশ্চিম বা দক্ষিণে নয়। এই পুনঃঅর্থায়ন তহবিল ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাহিত হলে ঋণ হিসেবেই বিতরণ হবে। কারণ তাদের কাজ ঋণ দেয়া। আর ব্যাংক যদি পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করতে যায়, সেক্ষেত্রে অপচয় হতে পারে। কারণ পুঁজি বিনিয়োগ ব্যাংকের দক্ষতার জায়গা নয়। মেডিসিনের চিকিৎসককে শল্য চিকিৎসা করতে বললে রোগী মারা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কে দায় নেবে?

ভারতে স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (সিডবি) ফান্ড অব ফান্ড পদ্ধতিতে বিভিন্ন এসএমই  ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে বিনিয়োগ করছে। ২০১৬ সালে ভারত সরকার ১০ হাজার কোটি টাকার একটি ফান্ড অব ফান্ড গঠন করেছে, যা থেকে পর্যন্ত ১২০টি ফান্ডে হাজার ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ফান্ড অব ফান্ড হিসেবে কাজ করতে পারে। নিবন্ধিত অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ম্যানেজারদের ফান্ডে বিনিয়োগ করতে পারে।

 

শওকত হোসেন: অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ; ম্যানেজিং পার্টনার, ভেলোসিটি এশিয়া

পরিচালক, লাইট ক্যাসল পার্টনার্স

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন