লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি: সময়ের আগে ঘুম ভেঙেছে যার

রুহিনা ফেরদৌস

ইচ্ছে ছিল লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে নিয়ে লেখাটা লিখব তার জন্মদিবসে। কিন্তু হলো না। দেশে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি, লকডাউন, মৃত্যু, বুকে পাথরের মতো চুরমার হয়ে শোক ভেঙে পড়ছে। এর মধ্যে  লিওনার্দোর জন্মদিনটাও এসে চলে গেল।

আজ লিওনার্দোর মৃত্যুদিন (২ মে) তাই আবার লিখতে বসা। ইতালির রেনেসাঁর সবচেয়ে প্রতিভাবান এ চিত্রশিল্পী মৃত্যুবরণ করেছেন ১৫১৯ সালে। একটু ভুল হয়ে গেল বোধহয়। লিওনার্দোকে শুধু চিত্রশিল্পী বললে ভুলই হবে। তিনি একাধারে ভাস্কর, স্থপতি, প্রকৌশলী, শরীরতত্ত্ববিদ, সঙ্গীতজ্ঞ, ভূতত্ত্ববিদসহ আরো অনেক কিছু। শুধু তো মোনালিসা, দ্য লাস্ট সাপার, ভিট্টুভিয়ান ম্যান, সালভাতর মুন্ডি কিংবা দ্য ভার্জিন অব দ্য রকস তার পরিচয় নয়। পাখির ওড়ার কৌশল নিয়ে শ-পাঁচেক স্কেচ এঁকেছেন। উড়োজাহাজের নকশা করেছেন। মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নিখুঁত ছবি এঁকে গেছেন আজ থেকে ৭০০ বছরের আগের বাস্তবতায় বসে। হাজারো অক্ষরে নোটবইয়ের পাতায় লিখে গেছেন তার দুর্দান্ত সব প্রকৌশলী ও দূরদর্শী চিন্তাভাবনাগুলো। কে না জানে কোডেক্সের কথা। ছোট একটা তথ্য দিচ্ছি। লিওনার্দোর এ নোটখাতা বর্তমানে সংগ্রহে আছে ধনকুবের বিল গেটসের কাছে।

  নোটবইয়ের পাতায় নিজের চিন্তাভাবনাগুলোকে এভাবে সাজিয়েছেন লিওনার্দো

ইতালির তুসকানের পাহাড়ঘেরা গ্রাম ভিঞ্চিতে জন্ম লিওনার্দোর। মা কাটেরিনা আর বাবা পিয়েরে দ্য ভিঞ্চি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের জাঁদরেল অধ্যাপক মার্টিন কেম্পের মতে, লিওনার্দোর মা ক্যাটেরিনা দি মিও লিপ্পি ছিলেন পিতা-মাতাহীন অনাথ গ্রাম্য এক মেয়ে। ফ্লোরেন্সের সম্ভ্রান্ত নোটারি ও পরবর্তী সময়ে চ্যান্সেলর পিয়েরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি কখনো। ধারণা করা হয়, লিওনার্দোর মায়ের পরিবারটি ছিল মূলত উত্তর আফ্রিকা থেকে আসা দাস পরিবার। শ্রেণীবৈষম্য আর সংস্কারের ধাঁধায় পড়ে লিওনার্দোর শৈশব অন্য শিশুদের মতো নির্মল কিংবা সহজ হয়নি। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ যেমন পাননি, তেমনি শৈশবেই মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। তাই মায়ের সঙ্গে লিওনার্দোর তেমন কোনো স্মৃতিও নেই, শুধু একটি ছাড়া।

আমৃত্যু লিওনার্দোর সঙ্গে থেকেছেন ফ্রান্সিস্কো মেলজি। ছবি আঁকতেন। লিওনার্দোর সেক্রেটারি হয়েও কাজ সামলেছেন। আর জিয়ান গিয়াকোমো ক্যাপ্রোতি দ্য ওরেনো ওরফে সালাই ছিলেন লিওনার্দোর ছাত্র, শিষ্য, সতীর্থ আর সব কাজের সহযোগী। হাত সাফাইয়ের অভ্যাস ছিল সালাইয়ের। মায়েস্ত্রোর কাছ থেকেই কমপক্ষে পাঁচ দফায় চুরি করেছেন। লিওনার্দোর অন্য ছাত্র ও শিক্ষানবিশরা অভিযোগও কম করেনি তাকে নিয়ে। কিন্তু লিওনার্দো আদর করে যার নাম দিয়েছেন সালাই, অর্থাৎ লিটল ডেভিল কখনো সঙ্গছাড়া করেননি তাকে। সালাই মাত্র ১০ বছর বয়সে লিওনার্দোর কাজের সাহায্যকারী হিসেবে যোগ দেন। তিনি ছবিও এঁকেছেন আন্দ্রে সালাই নামে। মোনালিসার অনুকরণে এঁকেছেন প্রডো মোনালিসা কিংবা মোন্না ভান্না। লিওনার্দোর অনেক ছবির মডেলও হয়েছেন। যেমন সেন্ট জন দ্য ব্যাপটিস্ট। ইতালির কিছু গবেষক তো এমনটাও দাবি করেন যে মোনালিসা ছবির মডেল মোটেও লিসা দেল জিয়োকন্দো নয়, সালাই। সমকামী বলে লিওনার্দোকে নিয়ে যে আলোচনা আছে, সালাইয়ের সঙ্গে তার তেমন এক ধরনের সম্পর্কের কথাও শোনা যায়।

  সেন্ট জন দ্য ব্যাপটিস্ট ও মোনালিসা

লিওনার্দোর প্রথম চাকরিটি ছিল কিন্তু নাট্য প্রযোজনার। কাজটি করতে করতে তিনি পারস্পেক্টটিভ ব্যবহারের কৌশলগুলো শিখেছিলেন। কীভাবে কোথায় কোন জিনিস রাখলে তা দর্শকের চোখে পড়বে ও ভিন্ন ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত হবে, সেসব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন মঞ্চে কাজ করতে গিয়ে; যার নিদর্শন আমরা দেখি তার দ্য লাস্ট সাপারে। টেবিলে কোথায় কীভাবে কোন খাবার কোন পানীয়র পাত্র রাখা হবে, যিশুর সহচরদের মুখভঙ্গি, অভিব্যক্তি কেমন হবে, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করে কাজে নেমেছিলেন তিনি। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে নানা ধরনের মানুষের মুখের স্কেচ এঁকে খুঁজে নিয়েছিলেন লাস্ট সাপারের মুখগুলোকে। তবে নাট্য প্রযোজক হিসেবেও নাম কুড়িয়েছিলেন, ফ্লাইং মেশিন আর উড়োজাহাজ স্ক্রু ব্যবহার করে শিল্পীদের (দেবদূত চরিত্রে যারা অভিনয় করেছিলেন) মঞ্চের ওপর থেকে নিচে নামিয়ে এনে চমকে দিয়েছিলেন দর্শকদের। কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যকার রেখাগুলোকে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বলেই নকশা করেছিলেন সত্যিকারের ফ্লাইং মেশিনের।

মা থেকে বিচ্ছিন্ন লিওনার্দোর শৈশব কেটেছে দাদা-দাদীর সঙ্গে। তবে ১২ বছর বয়সে ফ্লোরেন্সে এসে বাবার সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। দুই বছরের মধ্যে আন্দ্রেয়া ভেরোচ্চিওর স্টুডিওতে কাজ শেখার সুযোগ জুটে যায় বাবার টাকায়। ভেরোচ্চিও তখন ফ্লোরেন্সের নামকরা শিক্ষক, চিত্রকর। ছাত্রদের মধ্যে সবসময় তুমুল প্রতিযোগিতা চলত কে হবেন ভোরোচ্চিওর ফার্স্ট অ্যাপরেন্টিস। একদিন লিওনার্দোর কাজ দেখে ভেরোচ্চিও এ পদের জন্য দ্বিতীয় কারো কথা আর ভাবেননি। সে সময় তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন দ্য ব্যাপ্টিজম অব ক্রাইস্ট ছবিটি আঁকার জন্য। সহকারী শিল্পী হলেন লিওনার্দো। এ ছবিতে যে দুজন দেবদূত আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বামেরটা লিওনার্দোর আঁকা।

শিষ্য যে কখনো কখনো গুরুকেও ছাড়িয়ে যেতে পারেন, সে ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন লিওনার্দো। ছবিটি যখন সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, তখন বামের ওই দেবদূতে মুগ্ধ হয়ে গেলেন সবাই। কী প্রাণবন্ত নিখুঁত ছবি!

  দ্য ব্যাপ্টিজম অব ক্রাইস্ট

লিওনার্দো শুধু ছবি আঁকেননি। নতুন নতুন উদ্ভাবন আবিষ্কারে মেতে থেকেছেন। চিত্রকলার ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ছবি মোনালিসা। মানুষের আঁকা সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম। লিওনার্দোকে নিয়ে লিখতে বসে মনে হয়, তিনি যদি শুধু ছবিই আঁকতেন, তাহলে কী হতো! মোনালিসাকে লিওনার্দো যদি তার মতো করে শেষ (পারফেক্ট) করে যেতে পারতেন, তাহলে মোনালিসা দেখতে কেমন হতো? ১৫০৩ সালে আঁকতে শুরু করলেও জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত মোনালিসাকে এঁকেছেন। প্রায় ১৬ বছর ধরে একটি-দুটি করে তুলির টান দিয়েও তার কাছে মোনালিসা ছিল অসমাপ্ত এক শিল্প। লিওনার্দো এতটাই পারফেক্টশনিস্ট ছিলেন যে একটি স্কেচের অসংখ্য ভার্সন আঁকতেন। তার পরে তাতে রঙ-তুলির আঁচড় পড়ত। তিনি যেমন এঁকেছেন অনেক, তেমনি পুড়িয়েও ফেলেছেন অনেক ছবি।

   দ্য লাস্ট সাপার

ওই যে বলেছিলাম মায়ের সঙ্গে লিওনার্দোর একটি স্মৃতির কথা। তা হচ্ছে, শিশু লিওনার্দোকে দোলনায় রেখে মা যখন হাতের কাজ সারছিলেন তখন কোথা থেকে একটা বাজপাখি উড়ে এসে দোলনার ওপর বসে বারবার ডানা ঝাপটাচ্ছিল। কথিত আছে পাখিটা তার ডানা দিয়ে ছুঁয়ে দিয়েছিল তাকে। কোনোমতে পাখিটিকে তাড়িয়ে লিওনার্দোকে নিয়ে তার মা ছুটলেন গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক এক নারীর কাছে। কারণ তিনি ভবিষ্যত্ বলতে পারতেন। ওই বৃদ্ধা তাকে বলেছিলেন, তোমার এ সন্তান অভিশপ্ত। ও যা ভালোবাসবে, তা ধ্বংস করে ফেলবে। সারা জীবন একাকিত্ব বয়ে বেড়াবে।

হয়েছেও তা-ই। লিওনার্দোর আঁকা ছবির খুব যত্সামান্যই আজ টিকে আছে। কখনো বিয়ে করেননি। বন্ধুদের নিয়ে হইচই আড্ডা জমিয়ে রাখলেও সৃষ্টির ঘোরগ্রস্ত লিওনার্দোকে একাকিত্বও তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আজীবন।

  দ্য পোট্রেট অব জেনেভ্রা বেনচি

১৪৭৪ সালে জেনেভ্রা দি বেনচির ছবি আঁকার জন্য কমিশনপ্রাপ্ত হন লিওনার্দো। আমেরগো ইতালির ধনাঢ্য ব্যক্তি। কিছুদিনের মধ্যেই তার এ মেয়ের বিয়ে হবে। তাই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগেই পোর্ট্রেট আঁকার কাজটি শেষ করতে হবে লিওনার্দোকে। জেনেভ্রা ছিলেন বুদ্ধিমতী। লিওনার্দো আবিষ্কার করলেন হবু বর নিকোলিনির চেয়ে জেনেভ্রা বরং ফ্লোরেন্সের অ্যাম্বাসেডর বার্নার্ডো বেম্বোর সান্নিধ্য বেশি উপভোগ করেন। লিওনার্দো ছবিটি আঁকার কাজ শেষ করলে দেখা গেল জেনেভ্রা হাতে পাম ও লরেন (এক ধরনের গুল্ম) পাতা ধরে আছেন। ততদিনে বার্নার্ডোর সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে বেশ খুনসুটিও শুরু হয়েছে। লিওনার্দোর এমন কাজে ভীষণ ক্ষেপে গেলেন আমেরগো। কারণ বার্নার্ডোদের বংশের প্রতীক বা স্মারক চিহ্ন ছিল পাম ও লরেন পাতা। রেগেমেগে ছবির নিচের হাতের অংশটুকু কেটে ফেললেন আর টাকাকড়ি না দিয়েই তিরস্কার করে লিওনার্দোকে বিদায় করে দিলেন।

যদিও দ্য পোর্ট্রেট অব জেনেভ্রা বেনচি লিওনার্দোর সমাপ্ত কাজগুলোর একটি। তাই আমরা এখন যে চিত্রকর্মটি দেখি, সেখানে জেনেভ্রার হাতের সে অংশটুকু আর নেই।

ওই সময়টায় লিওনার্দো কাজ করছিলেন অ্যাডোরেশন অব দ্য মেজাই নিয়েও। কাজটি তাকে জুটিয়ে দিয়েছিলেন বাবা পিয়েরে দ্য ভিঞ্চি। জেনেভ্রার ছবির এমন পরিণতি নিয়ে যখন খুব বিষণ্ন তিনি, তখন আগস্টিনিয়ান সন্ন্যাসীদের প্রতিনিধিরাও তার অ্যাডোরেশন অব দ্য মেজাই নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই এ কাজও আর শেষ করা হয়নি তার।

  অ্যাডোরেশন অব দ্য মেজাইয়ের অসম্পূর্ণ চিত্রকর্মটি

ফ্লোরেন্স ছেড়ে  লিওনার্দো চলে গেলেন  মিলানে। ১৪৮২ সালের দিকে মিলানের ডিউক লুদোভিকো তাকে ঘোড়ার ভাস্কর্য তৈরির কথা বলেন, যাতে ফুটে উঠবে তার বাবার বীরত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের দৃশ্য। তার কথা অনুযায়ী লিওনার্দো ২৪ ফুট উচ্চতার একটি ভাস্কর্যের নকশা করেছিলেন। আর তা বানাতে চেয়েছিলেন ব্রোঞ্জ দিয়ে। চাহিদামতো প্রয়োজনীয় পরিমাণ ব্রোঞ্জ সরবরাহও করেছিলেন লুদোভিকো। কিন্তু ওই যে নিখুঁত করার ধাঁত, অনেক বেশি সময় নিতেন। এর মধ্যে বাদ সাধে ১৪৯৯ সালের যুদ্ধ। উপায় না পেয়ে একসময় লিওনার্দোকে দেয়া ব্রোঞ্জগুলো অস্ত্র তৈরির জন্য ফিরিয়ে নেন লুদোভিকো। শেষ রক্ষা হয় না। ফরাসিরা মিলানের দখল নিয়ে নেয়। লুদোভিকো বন্দি হন। সৈন্যরা লিওনার্দোর দ্য গ্রেট হর্সের মাটির তৈরি কাঠামোটি ভেঙে ফেলে।

  লিওনার্দোর আঁকা দ্য গ্রেট হর্স    

শিল্পী হিসেবে তার কনিষ্ঠ প্রায় রাফায়েল কিংবা মাইকেলেঞ্জেলোরা যখন ফ্লোরেন্স দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, লিওনার্দো তখন একের পর এক অসমাপ্ত কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে মাইকেলেঞ্জেলো যখন তার ডেভিড ভাস্কর্যের কাজ শেষ করে ফ্লোরেন্সে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছেন, লিওনার্দো তখন ফ্রান্সেস্কো দেল জিয়োকন্দোর কাছ থেকে কমিশনপ্রাপ্ত হয়েছেন তার স্ত্রী লিসা দেল জিয়োকন্দোর ছবি আঁকার জন্য। মোনালিসার শুরুটা এভাবে।

ক্ল্যাসিক যুগের মাস্টারদের কাজ থেকে লিওনার্দো অনুপ্রাণিত হয়েছেন কিন্তু তাদের অনুকরণ করেননি। মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিড দেখে তাই মন্তব্য করেছিলেন, তুমি তো সবসময় কাজে স্পিরিটের কথা বলো। কিন্তু ডেভিড তো চিত্রকলার ক্ল্যাসিক ধারার অন্ধ অনুকরণ ছাড়া কিছু হয়নি। আমি তোমার কাছ থেকে আরো বেশি কিছু আশা করেছিলাম।

মাইকেলেঞ্জেলোর অবশ্য উত্তরে বলেছিলেন, তুমি তোমার অসমাপ্ত কাজগুলো আগে সম্পন্ন করে দেখাও।

লিওনার্দো ও মাইকেলেঞ্জেলোকে নিয়ে দারুণ কিছু ঘটনাও রয়েছে। ফ্লোরেসের তত্কালীন শাসকরাও দুই শিল্পীর দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে উসকে দিয়েছিলেন বৈকি। ইতালির রেনেসাঁর এ মাস্টারদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা ছড়িয়ে দিতে ফ্লোরেন্সের পালাজো ভ্যাকিওর দেয়ালে লিওনার্দোকে কমিশন দেয়া হলো দ্য ব্যাটেল অব অ্যাঙ্গিয়ারি আঁকতে। ঠিক বিপরীত দেয়ালে মাইকেলেঞ্জেলোকে বলা হলো দ্য ব্যাটেল অব ক্যাসিনা আঁকার জন্য।

  দ্য ব্যাটেল অব অ্যাঙ্গিয়ারি ও দ্য ব্যাটেল অব ক্যাসিনা

মাইকেলেঞ্জেলো চেয়েছিলেন লিওনার্দোকে বিরক্ত করতে, কাজের সময় অহেতুক হইচই করে লিওনার্দোর মনোযোগ নষ্টও করেছেন খানিকটা। কিন্তু লিওনার্দো তো সবকিছুর ঊর্ধ্বে। প্রেম-ভালোবাসা-ঘৃণা-বিদ্বেষ কোনো কিছুই যেন স্পর্শ করত না এ শিল্পীকে। কাজ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন। রঙের সঙ্গে তেল মেশালে ছবিতে কেমন বাড়তি উজ্জ্বলতা যোগ হয় তা দেখিয়েছিলেন। পালাজো ভ্যাকিয়োর দেয়ালে ছবি আঁকার জন্য তাকে যখন স্বল্প সময় বেঁধে দেয়া হয়, তখন কাজ শুরু করতে গিয়ে দেখলেন দেয়াল থেকে এমনিতেই চুনকাম খসে পড়ছে। নতুন করে প্লাস্টার করার মতো সময়ও ছিল না, তাই করলেন কি রঙের মধ্যে মোম মিশিয়ে দিলেন। দেখলেন এভাবে করে রঙগুলো ঠিকঠাক লেগে থাকছে। কিন্তু এ এক্সপেরিমেন্ট  ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। হলোও তা-ই। কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল রঙ গলে স্কেচ ও ফিগারগুলো নষ্ট হতে শুরু করেছে।

বাবার মৃত্যু, কাজে মনোযোগ দিতে না পারা সবকিছু মিলে বিধ্বস্ত লিওনার্দো হঠাত্ এ কাজও ছেড়ে দেন। হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন কারো সঙ্গে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় মানায় না তাকে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, পরবর্তী সময়ে মাইকেলেঞ্জেলোও এ কাজ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন।

প্রায়ই একটি প্রশ্ন করতেন লিওনার্দো, আচ্ছা, আকাশের রঙ কেন নীল? অনুসন্ধানী ও উত্সাহী মন নিয়ে উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছেন মানুষের হূত্যন্ত্র কীভাবে কাজ করে? কিংবা পাখির ডানার উপরে-নিচে বাতাসের চাপের তারতম্য কেন হয়এসব প্রশ্নের।

               লিওনার্দোর আঁকা ছবির খুব যৎসামান্যই আজ টিকে আছে

লিওনার্দোর জীবনজুড়ে যেমন অনেক গল্প-ঘটনা-তর্ক আছে, তেমন তার মৃত্যুর মুহূর্ত ঘিরেও চালু আছে কিংবদন্তী। যেমন ফ্রান্সের রাজার কোলে তার মৃত্যু হয়েছে।

রাজা প্রথম ফ্রান্সিস ছিলেন লিওনার্দোর স্বজন মানুষ। এমন প্রতিভাকে শ্রদ্ধা-সমীহ দুটোই করতেন তিনি। তাই লিওনার্দোর মৃত্যুর সময় তার উপস্থিতির বিষয়টি স্রেফ নাকচ করে দেয়ার উপায় নেই। দ্য ডেথ অব লিওনার্দো দ্য  ভিঞ্চিফরাসি শিল্পী জেন-আগাস্টে ডমিনিক ইনগ্রেসের আঁকা এ চিত্রকর্মতে সে দৃশ্যটিকে ধারণা করে আঁকা হয়েছে।

ইতিহাস রচয়িতাদের অনেকে অবশ্য দাবি করেন, লিওনার্দোর মৃত্যুর সময় অ্যাম্বুয়াসের কাছাকাছি কোথাও ছিলেন না রাজা ফ্রান্সিস। গুরুত্বপূর্ণ রাজকাজে নিযুক্ত ছিলেন। দলিলে স্বাক্ষর করতে বসবেন, তার আগমুহূর্তে লিওনার্দোর অসুস্থতার খবর পেলে সব ফেলে তখনই ছুটে আসেন। যদিও ততক্ষণে মৃত্যুর কাছে হার মেনেছেন লিওনার্দো। শিল্পী ও লেখক জর্জিও ভাসারি, তাকে লিওনার্দোর সমসাময়িকও বলা যায়, অবশ্য বলে গেছেন মেলজি তাকে জানিয়েছিলেন যে রাজার কোলেই লিওনার্দোর মৃত্যু হয়েছে।

  শিল্পী ডমিনিক ইনগ্রেসের আঁকা দ্য ডেথ অব লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি

দ্য ডেথ অব লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছবিটি এঁকেছেন ডমিনিক ইনগ্রেস। লিওনার্দোর মৃত্যুর প্রায় ৩০০ বছর পর রোমে নিযুক্ত তৎকালীন ফরাসি রাষ্ট্রদূত কর্তৃক কাজটি করার জন্য তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন।

মৃত্যুর পর সেন্ট ফ্লোরেন্টিন গির্জার কাছে সমাহিত করা হয় তাকে। ফরাসি বিপ্লবের ক্ষত নিয়ে গির্জাটি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। আঠারো শতকের গোড়ার দিকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় গির্জাটি। তাই লিওনার্দোর সমাধিক্ষেত্রটিও আর শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।

সিগমুন্ড ফ্রয়েড লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি সম্পর্কে বলেছেন, বাকিরা যখন ঘুমাচ্ছিল অন্ধকারের মধ্যে, তখন একা জেগে উঠেছিলেন তিনি। সময়ের আগে ঘুম ভেঙেছে তার।

সত্যিই তো তাই, সময়ের অনেক আগেই ঘুম ভেঙেছিল লিওনার্দোর।

রুহিনা ফেরদৌস
: সাংবাদিক 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন