ডোনার কনফারেন্সে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী

রোহিঙ্গা বোঝা টেনে নেয়ার অবস্থায় নেই বাংলাদেশ

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য বড় বোঝা। বাংলাদেশ বোঝা আর টেনে নেয়ার অবস্থায় নেই বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। গতকাল রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থায়নের খোঁজে আয়োজিত ডোনার কনফারেন্সে কথা বলেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর যৌথভাবে ডোনার কনফারেন্স ফর রোহিঙ্গা রিফিউজি শীর্ষক বৈঠক আয়োজন করে। ভার্চুয়াল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেনি মিয়ানমার।

ডোনার কনফারেন্সের শুরুতে বক্তব্য রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বাইগান। এরপর যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ এশিয়া এবং কমনওয়েলথ বিষয়ক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লর্ড তারিক আহমেদ, ইইউর সংকট ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কমিশনার জেনিজ লেনারকিক, ইউএনএইচসিআরের কমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি এবং জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক জরুরি ত্রাণ সমন্বয়ক মার্ক লৌকক প্রারম্ভিক বক্তব্য দেন। এরপর রোহিঙ্গা নিয়ে একটি ভিডিও চিত্র দেখানো হয়। পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিরা তাদের বক্তব্য রাখেন। আর দাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে আইওএম, ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপি, ইউএনডিপি, ব্র্যাক বাংলাদেশ, এপিআরআরএন এবং বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন।

বৈঠকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, চার বছর আগে রোহিঙ্গারা যখন নিজ দেশের মানুষের হাতে নির্যাতন, গণহত্যার মুখে পালিয়ে আসছিল তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সীমান্ত খুলে দিয়ে তাদের জীবন রক্ষা করেছিলেন। মানবিক সহযোগিতা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এগিয়ে আসার আগেই ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে খাদ্য, বাসস্থান, নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে প্রাথমিকভাবে সহযোগিতা করেছিল বাংলাদেশ। বিশাল জনসংখ্যা সীমিত সম্পদ নিয়ে যে কঠিন কাজটি বাংলাদেশ করেছে, তা অন্য কোনো দেশ ঐচ্ছিকভাবে নিজ কাঁধে তুলে নেবে না। কিন্তু বাংলাদেশ তখন থেকেই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আসছে।

বাংলাদেশ এখন আর রোহিঙ্গা বোঝা টেনে নেয়ার মতো অবস্থায় নেই জানিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে তারা সাময়িকভাবে এখানে রয়েছে। তাদের আশ্রয় দেয়ায় আমাদের সমাজ, নিরাপত্তা, সম্পদ, অর্থনীতি পরিবেশে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা পরিমাপযোগ্য নয়। কিছু ক্ষেত্রে তা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার মতো নয়। সংশ্লিষ্টদের জানাতে চাই, নিরাপত্তা ইস্যুতে আমরা আপস করার মতো অবস্থায় নেই। দ্রুত সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের অবশ্যই তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে।

বৈঠকে থাইল্যান্ডের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখাইন পরিস্থিতিকে জটিল মন্তব্য করে বলেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ মিয়ানমারের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় যে চুক্তি রয়েছে তা মহামারীর পর শুরু হওয়া প্রয়োজন।

যুক্তরাষ্ট্রে উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বাইগান বলেন, বাংলাদেশসহ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে যেসব রোহিঙ্গা রয়েছে, তাদের জন্য টেকসই সমাধান সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজতে হবে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির বাংলাদেশে। এখন পর্যন্ত তাদের জন্য ১২০ কোটি ডলার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বৈঠকেও ২০ কোটি ডলার দেয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ এশিয়া এবং কমনওয়েলথ বিষয়ক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লর্ড তারিক আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গার কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর চাপ পড়েছে। যে অর্থায়ন খোঁজা হচ্ছে, তা শুধু রোহিঙ্গাদের জন্য নয়, কক্সবাজারে স্থানীয় জনগণের উন্নয়নেও ব্যয় করা হবে।

ইইউর সংকট ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কমিশনার জেনিজ লেনারকিক বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আমাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। শুধু মানবিক সহায়তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। এর দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজতে হবে।

রোহিঙ্গাদের সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাবাসনই প্রধান সমাধান জানিয়ে ইউএনএইচসিআরের কমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেন, কুতুপালং ক্যাম্পে আমি কয়েকবার গিয়েছি। ২০১৭ সালে সংকটের শুরুতে স্থানীয় বাংলাদেশীরা যেভাবে মানবিক সহায়তা করেছে তা অভূতপূর্ব। ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২২০ কোটি ডলার মানবিক সহায়তা পাওয়া গিয়েছে। প্রতি বছর গড়ে লক্ষ্যমাত্রার ৭০-৭৫ শতাংশ অর্থ এসেছে। তবে বছর মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশেরও কম সহযোগিতা পাওয়া গিয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে মার্ক লৌকক বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে এখনো প্রচুর রোহিঙ্গা মিয়ানমারের ভেতরে ক্যাম্পে এবং বাস্তুচ্যুত অবস্থায় রয়েছে। তাদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে না। ফলে সমস্যার মূল কারণ নিয়ে মিয়ানমার যাতে মনোযোগী হয়, সে বিষয়ে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। কফি আনান কমিশন প্রতিবেদন দিয়েছে তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে। এখন পর্যন্ত এর নগণ্য অনুসরণ করা হয়েছে। আমাদের সমাধানের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

এদিকে গতকাল দাতাদের বৈঠকে বসার আগে বাংলাদেশে থাকা লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গার জন্য কোটি ৭৫ লাখ পাউন্ড সহযোগিতার ঘোষণা দেয় যুক্তরাজ্য। ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশন থেকে জানানো হয়, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব অনুদানের ঘোষণা দেন। সময় রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন করায় দায়ীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টিও জানানো হয়। এছাড়া রোহিঙ্গাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে না নিতে বিশ্বকে আহ্বান জানান যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন