রফতানি খাত

গতি ফিরে পেতে যুক্তরাষ্ট্র-জার্মানিই বাংলাদেশের ভরসা

নিজস্ব প্রতিবেদক

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত মহামারীর প্রাদুর্ভাবে স্থবির হয়ে পড়েছিল বৈদেশিক বাণিজ্য। এর আগে দেশের রফতানি বাণিজ্যের প্রধান দুই গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র জার্মানি। মহামারীর প্রভাব কাটিয়ে রফতানিতে গতিশীলতা ফেরাতে এখন দুই দেশের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে, যার ইঙ্গিত মিলছে সরকারের হালনাগাদকৃত পরিসংখ্যানে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকে বহির্বিশ্বে রফতানীকৃত পণ্যের ৮৫ শতাংশই পোশাক। পোশাক রফতানির ৩৫ শতাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্র জার্মানিতে। ফলে মহামারী দেখা দেয়ার আগে রফতানির ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল দুই দেশ। রফতানিতে প্রবৃদ্ধির ধারা ফিরিয়ে আনতে মুহূর্তেও বাংলাদেশের প্রধান ভরসা হয়ে উঠেছে দেশ দুটি।

রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শীর্ষ রফতানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্য গিয়েছে ১৮০ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার ডলারের। যেখানে গত অর্থবছরের (২০১৯-২০) একই সময়ে পণ্য রফতানি হয়েছিল ১৬১ কোটি ১৬ লাখ ডলারের। হিসেবে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মার্কিন বাজারে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ৪৩ শতাংশ।

দ্বিতীয় বৃহৎ গন্তব্য জার্মানিতে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ৫৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশটিতে মোট ১৪৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করেছিল বাংলাদেশ। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পণ্য রফতানি হয়েছে ১৫৩ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছে ইপিবি। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মোট ৯৮৯ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে মোট পণ্য রফতানি হয়েছিল ৯৬৪ কোটি ৭৯ লাখ ৯০ হাজার ডলারের। হিসেবে মহামারীর মধ্যেও চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রফতানি বেড়েছে দশমিক ৫৮ শতাংশ।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রচলিত প্রধান বাজারগুলোই রফতানি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। সময়ে দেশের রফতানি পণ্যের ৮৯ শতাংশই গিয়েছে শীর্ষ ২০ গন্তব্যে। যুক্তরাষ্ট্র জার্মানিতে গিয়েছে মোট রফতানীকৃত পণ্যের ৩৪ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে দুই বাজারের ওপর নির্ভর করেই কভিড-১৯-এর প্রভাবজনিত মন্দা থেকে পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত পাচ্ছে বাংলাদেশের রফতানি খাত।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, রফতানি খাতের প্রধান পণ্য পোশাক। মূলত পণ্যটিই রফতানির গতি-প্রকৃতির মূল চালক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। মহামারীজনিত মন্দা কাটানোর বিষয়টিও অনেকটা এর ওপরেই নির্ভর করছে। সেক্ষেত্রে এখানকার পোশাকের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র জার্মানিতে যদি রফতানির ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলেই দেশের রফতানি খাতের পুনরুদ্ধার হবে, নইলে হবে না। সর্বশেষ তিন মাসে দুই বাজারে রফতানির পরিসংখ্যান থেকে এমন ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে।

তাদের মতে, যে দেশ বা অঞ্চলেরই হোক না কেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভোক্তা বা গ্রাহকের ক্রয়ের অভ্যাস ক্ষমতা একটি বড় নিয়ামক। তাই ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা থাকলে সেটার ব্যবহার করতে হবে।

এক্ষেত্রে বড় বাজারগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরে তারা বলছেন, জাপান মোটেও কম ধনী না, কিন্তু দেশটির ভোক্তারা এত বেশি পরিমাণে পোশাক কেনে না। পোশাক সবচেয়ে বেশি ক্রয় করে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা। এক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক ক্রয়াভ্যাস। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন জাপান বাদ দিলে বড় বাজারগুলোর মধ্যে থাকে ভারত। কিন্তু ভারত নিজেই পোশাক প্রস্তুতকারক-রফতানিকারক আবার বাংলাদেশের প্রতিযোগীও। আবার তুরস্কও বাংলাদেশের প্রতিযোগী। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ায় জনসংখ্যা কম হওয়ায় দেশটির ক্রয়াদেশগুলোও ছোট আকারের।

বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের সিইও আলী আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে আপাতত পণ্য বহুমুখীকরণের বিষয়টি দৃশ্যমান না। সামনের দিনগুলোয়ও রফতানিতে বর্তমান সক্ষমতাই অব্যাহত থাকবে। কারণ অনেক ধাক্কা খেয়েও আমরা একটি পণ্যের ওপর নির্ভর করেই টিকে আছি। এখন জানা যাচ্ছে, পোশাকের ক্রেতারা যে ক্রয়াদেশগুলো বাতিল করেছিলেন, তার অধিকাংশই পুনর্বহাল করছেন; কিন্তু শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে দাম কমিয়ে দেয়ার পাশাপাশি ক্রয়াদেশের পরিমাণও কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। পোশাক বাজারে এখনো ক্রেতা আধিপত্যই শক্তিশালী। আমার মনে হয়, ভবিষ্যতেও স্বল্পমেয়াদে আমরা অবস্থায় চলতেই বাধ্য হব। অর্থাৎ পোশাকের ওপর নির্ভরশীলতা আর ওই দুই বাজার নির্ভরশীলতা। এজন্যই পণ্যের পাশাপাশি বাজারেরও বৈচিত্র্যকরণ প্রয়োজন। এছাড়া আর উপায় নেই। একই সময়ে দুদিকেই মনোযোগী হতে হবে।

পোশাক খাতসংশ্লিষ্টদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির পোশাক বাজারই এখন রফতানির পুনরুদ্ধার বা অস্তিত্ব রক্ষার চাবিকাঠি। বাকি বাজারগুলোয় রফতানির আকার অনেক ছোট। বাজারগুলোয় রফতানির পরিমাণ ইতিবাচক বা নেতিবাচক যা- হোক না কেন, তা তেমন অর্থবহ কিছু না। জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যদি ভালো পারদর্শিতা বজায় রাখা যায় বা দেশগুলো থেকে ক্রয়াদেশ যদি ভালো পাওয়া যায়, তাহলেই দেশের পোশাক খাত ইতিবাচক ধারায় প্রবেশ করবে। দুই বাজারে যদি আসন্ন শীতে কোনো বড় প্রভাব পড়ে, তাহলে বাংলাদেশী পোশাক খাতের সমস্যা আরো বাড়বে। অন্যান্য বাজারে যা- সমস্যা থাকুক, দেশের পোশাক খাতের পুনরুদ্ধারের বিষয়টি দুই বাজারের ওপরই নির্ভর করছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পোশাক গোটা বিশ্বের মানুষের মৌলিক চাহিদা। তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে পোশাকের যে মাথাপিছু ব্যবহার, তা বিশ্বের অনেক দেশেই নেই। বাংলাদেশে ২০-২৫ বছর সময় ধরে এক পোশাকের ব্যবহারের ঘটনা শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের পোশাকের প্রধান বাজারগুলোয় এক পোশাক পরে ফেলে দেয়ার অভ্যাসের ঘটনাও শুনতে পাওয়া যায়। তাদের ক্রয়াভ্যাসই হলো পুরনোটা ফেলে দিয়ে নতুন ব্যবহার করা। এজন্য ওরা বেশি কেনে। আর বেশি কেনে বলেই আমরা সেখানে বেশি বিক্রি করতে পারছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন