বাংলাদেশের ই-স্বাস্থ্যসেবা ও যাচাইযোগ্য জাতীয় পরিচয়পত্রের সম্ভাব্য ভূমিকা

আজিজুন নাহার লিমা

আসছে ২০২১ সালে সুবর্ণজয়ন্তীতে পদার্পণ করতে চলেছে বাংলাদেশ। এর সাথে জড়িয়ে আছে বর্তমান সরকারের সোনার বাংলা গড়ার প্রতিশ্রুতি ‘রূপকল্প ২০২১’। এ রূপকল্প অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, সেবা এবং অন্যান্য খাতে আধুনিকায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিচিত হবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে আধুনিকায়ন বা ই-স্বাস্থ্যসেবা এই করোনাকালীন সময়ে হয়ে উঠছে সরকার ও জনসাধারণের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। এক্ষেত্রে যাচাইযোগ্য জাতীয় পরিচয়পত্রের ভূমিকা হতে পারে অত্যন্ত ইতিবাচক। এ বিষয়টি নীতিনির্ধারকসহ সকলের সামনে তুলে ধরতে গত ২৯ আগস্ট একটি ওয়েবিনার আয়োজন করেছিল তরুণ প্রজন্মের নীতি গবেষণামূলক প্লাটফর্ম ‘ইয়ুথ পলিসি ফোরাম (ওয়াইপিএফ)’।  

ওয়েবিনারটিতে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ভারতের সফল 'আধার প্রকল্প' এর আলোকে বাংলাদেশের ই-স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে যাচাইযোগ্য জাতীয় পরিচয়পত্রের সম্ভাব্য ভূমিকা, এর সফলতার অন্তরায় এবং তা থেকে উত্তরণের উপায়সমূহ। এতে আলোচক হিসেবে ছিলেন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান 'প্রাভা হেল্থ' এর কর্ণধার সিলভানা কাদের সিনহা, 'ডিজিটাল হেল্থকেয়ার সল্যুশন্স' এর কর্ণধার সাজিদ রহমান এবং বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি বিভাগের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মাহদী মাশরুর মতিন। এছাড়াও ছিলেন ওয়াইপিএফ এর তিনজন তরুণ গবেষক আলিসা সারাসার্ন, মার্জিয়া নিজাম ও মোহাম্মদ ইহসানুল কবির। সঞ্চালনায় ছিলেন এস এম ফারাবী।  

শুরুতেই আলোচনা করা হয় ভারতের আধার প্রকল্প নিয়ে, যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ বায়োমেট্রিক আইডি সিস্টেম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এতে একটি ইউনিক আইডেন্টিটি নাম্বার দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে সকলকে দেওয়া হবে স্বাস্থ্য সেবা, পেনশন সেবা ও অন্যান্য অনেক সামাজিক সুবিধা। এই আইডেন্টিটিকে তুলনা করা যায় বাংলাদেশের ইউনিক জাতীয় পরিচয়পত্র সুবিধার সাথে। পরিচয়পত্র যাচাইযোগ্য করা সম্ভব হলে তা ই- স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মূল উপাদান হয়ে উঠতে পারে। এই ইউনিক আইডেন্টিটির প্রযুক্তিগত দিক ও চ্যালেঞ্জসমূহ তুলে ধরেন আলিসা সারাসার্ন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘এনআইডি ও অন্যান্য ডাটাবেজের ক্ষেত্রে অন্যতম উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে তথ্যের গোপনীয়তা’।  উঠে আসে এস্তোনিয়া, বতসোয়ানা, থাইল্যান্ড ও কোরিয়ার ই-হেল্থ সেবার সফলতার উদাহরণ। 

এরপরেই ই-স্বাস্থ্যসেবায় ইউনিক আইডেন্টিটি ব্যাবহারের সামাজিক-অর্থনৈতিক দিকসমূহ নিয়ে গবেষণালব্ধ তথ্য উপস্থাপন করেন মার্জিয়া নিজাম। তিনি বলেন, " ইউনিক আইডির অভাবে বিশ্বের ১.১ বিলিয়ন মানুষ অনেক প্রয়োজনীয় সামাজিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে"।  বিশ্বব্যাপী ইউনিক আইডেন্টিটির অত্যন্ত প্রয়োজন সামাজিক ও অর্থনৈতিক  সুবিধা গ্রহণ, লিঙ্গ-সমতা আনয়নের জন্য। কারণ, ইউনিয়ন আইডেন্টিটি নেই এমন মানুষের মধ্যে অধিকাংশ হচ্ছেন নারী। এতে তারা উন্নতি ও সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। ইউনিক আইডেন্টিটি ব্যাবহারের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা তুলে ধরে মার্জিয়া বলেন, "সর্বনিম্ন ডাটা নিয়ে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার কিভাবে করা যায়, ডেটার অপব্যবহার রোধে এ বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে।" 


এ পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে যাচাইযোগ্য জাতীয় পরিচয়পত্র সুবিধা- অসুবিধা তুলে ধরেন ইহসান উল কবির। তিনি প্রথমে বাংলাদেশের বর্তমান স্বাস্থ্যসেবায় ইলেকট্রনিক ব্যবস্থাসমূহ ও তার অপ্রতুলতার বর্ণনা দেন। গবেষণার তথ্যমতে, ৬২% স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের মধ্যে ই-স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান রয়েছে, তাদের মধ্যে এর প্রতি  ইতিবাচক মনোভাব আছে ৫৯% এর। তিনি বলেন, "স্বাস্থ্যসেবাক্ষেত্রে সাইবার-ক্রাইম প্রতিরোধে পর্যাপ্ত আইন নেই।" তার বক্তব্যে তিনি প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরের জন্য ব্যবহার উপযোগী ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। 

এরপর আলোচনাটি গড়ায় প্রশ্নোত্তর পর্বে। বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে কি ধরনের ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে সিলভানা কাদের সিনহা বলেন,  প্রাভা হেল্থে প্রত্যেক রোগীর জন্য ইউনিক আইডেন্টিফায়ার রয়েছে। আলাদা কার্ড রয়েছে। নিজস্ব ডাটাবেজে তথ্য সংরক্ষণ করা হয়, যাতে রোগীদের যেকোনো সময় যেকোনো কাজে প্রবেশাধিকার রয়েছে । এসব তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করেন তারা। একই প্রশ্নের উত্তরে সাজিদ রহমান বলেন,  'ডিজিটাল হেল্থকেয়ার সল্যুশন্স' এরও নিজস্ব ডাটাবেজ ও ইউনিক আইডেন্টিটি সিস্টেম রয়েছে৷ ডাটাবেজ যাতে হ্যাকড না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে রয়েছে একটি বিশেষজ্ঞ দল। তারা উভয়েই মনে করেন যে যাচাইযোগ্য জাতীয় পরিচয়পত্র ই- স্বাস্থ্যসেবায় চমৎকার ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এই জাতীয় কার্যক্রমে সংযুক্ত হতেও আগ্রহ প্রকাশ করেন তারা। মাহদী মাশরুর মতিনকে প্রশ্ন করা হয় বর্তমান প্রচলিত অবস্থাকে প্রসারিত করে সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবায় তা কাজে লাগানো সম্ভব কিনা। এর উত্তরে তিনি ইতিবাচক মতামত দেন৷ তিনি মনে করেন এজন্য প্রথমেই দরকার পরিচয়পত্রে আরোকিছু তথ্য সংযুক্ত করা, যেমন ফোন নাম্বার বা ইমেইল আইডি৷ এক্ষেত্রে সমস্যা হিসেবে তিনি বলেন যে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরী হয় নির্দিষ্টভাবে ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে। একে অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্যকরণের দায় স্বাভাবিকভাবেই নিতে চাননা নির্বাচন কমিশন। তাই এর বহুব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারি নীতিমালা বা আইনের বিকল্প নেই৷ 

এ পর্যায়ে আলোচনা হয় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যবীমার ব্যাপারে। বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে কোনো স্বাস্থ্যবীমা প্রকল্প নেই। সিলভানা কাদের সিনহা ও সাজিদ রহমান উভয়েই স্বাস্থ্যখাতে বীমা ব্যবস্থাকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে আখ্যা দেন। 

প্রযুক্তি গ্রহণে সেবা প্রদান ও গ্রহণকারীদের অনীহার কারণ সন্ধান করেন তারা। সাজিদ রহমান বলেন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডাটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা আমলাতান্ত্রিক ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় সেবাপ্রদানকারীরা অনীহা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে সিলভানা কাদের সিনহা মনে করেন রোগীরা ইলেকট্রনিক সেবা গ্রহণে খুব একটা অনাগ্রহী নয়। 

জাতীয় ডাটাবেজে জনগণের দেওয়া তথ্য নিরাপদ কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে মাহদী বলেন, বর্তমানে ডাটাবেজে কোনো গোপনীয়তা লঙ্ঘনজনিত ইস্যু নেই। তথ্যের নিরাপত্তার জন্য নিয়মিত ভিএপিডি (ভালনারেবলিটি অ্যাসেসমেন্ অ্যান্ড পেনিট্রেশন টেস্টিং) পরিচালিত হয়। 

আলোচনার শেষ পর্যায়ে ইউনিক আইডেন্টিটি তৈরির ক্ষেত্রে মাহদী বলেন, ‘এই আইডেন্টিটির নানা ইস্যু সমাধানের জন্য সরকারের অনেক সংস্থাকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে আর এর নির্দেশ আসতে হবে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে।’ উপস্থিত প্রত্যেকে ই-স্বাস্থ্যসেবায় যাচাইযোগ্য ইউনিক পরিচয়পত্র নিয়ে কাজ করতে সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়ের সম্মিলিত কার্যক্রম নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। 

উল্লেখ্য, ওয়েবিনারটি Youth Policy Forum এর ফেসবুক পেজে লাইভ অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজনের মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ছিল বণিক বার্তা।

শিক্ষার্থী, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন