পোশাকপণ্য বিপণনে জড়িত প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব

বদরুল আলম

আশির দশকে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের শুরু থেকেই পণ্য বিপণনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বায়িং হাউজ মালিকরা। পণ্যের বিপণনে ক্রেতার সঙ্গে সংযোগ দরকষাকষির কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে ক্রয়াদেশ ধরার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাই পালন করে আসছেন তারা। তবে পোশাকপণ্য বিপণনে নিয়োজিত এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিয়েই দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। পোশাক ম্যানুফ্যাকচারার প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বিজিএমইএ বায়িং হাউজগুলোর সংগঠন বিজিবিএর মধ্যে দ্বন্দ্ব ক্রমেই আরো ঘনীভূত হচ্ছে।

দেশে রফতানিমুখী পোশাক শিল্পের শুরুতে আন্তর্জাতিক ক্রেতাগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ তৈরি দরকষাকষিতে খুব একটা পারদর্শী ছিলেন না পোশাক শিল্প মালিকরা। সুযোগে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উত্থান ঘটে বায়িং হাউজ ব্যবসার। বর্তমানে কারখানা কর্তৃপক্ষ বিপণন দক্ষতা বাড়লেও বায়িং হাউজের ভূমিকা হারিয়ে যায়নি। বরং আইনের আলোকে নিবন্ধনের মাধ্যমে কর্তৃত্ব স্থাপন করে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বায়িং হাউজ ব্যবসার ওপর সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি না থাকায় অনেক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। দেশের বায়িং হাউজগুলোতে বিপুল পরিমাণ বিদেশী কাজ করেন, যাদের কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যায়।

দেশের বাইরে যাওয়া অর্থের বেশির ভাগটাই যায় অবৈধ পন্থায়। আবার বায়িং হাউজের গাফিলতিতে পণ্য প্রস্তুতকারক কারখানা কর্তৃপক্ষ ক্রেতার মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এতে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু সমস্যার মূলে থাকা বায়িং হাউজকে কোনো জবাবদিহিতায় আনা সম্ভব হয় না। সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বছর দুই আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বায়িং হাউজ সংক্রান্ত একটি খসড়া নীতিমালাও প্রণয়ন করে।

এদিকে ২০১৮ সালেই বস্ত্র আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বস্ত্র শিল্পের সংজ্ঞা নির্ধারণসহ নির্ধারণ হয় বস্ত্র শিল্পের পোশাক কর্তৃপক্ষ। বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বস্ত্র পরিদপ্তরের মাধ্যমে বায়িং হাউজ নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতাও সৃষ্টি হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রজ্ঞাপন জারি করে নিবন্ধনের পদ্ধতি অনুসরণের দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। সেখানে বলা হয় বায়িং হাউজ হিসেবে নিবন্ধন পেতে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক সংগঠনের সদস্যপদের সনদপত্র থাকতে হবে। চলতি বছর আগস্ট আবারো একটি পরিপত্রের মাধ্যমে বলা হয় সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক সংগঠন বলতে বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনকে (বিজিবিএ) বোঝাবে।

সংগঠন বলতে বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনকে (বিজিবিএ) বোঝাবে এমন পরিপত্র জারি হওয়ার আগে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ তাদের সনদের মাধ্যমে সংগঠনটির আওতায় থাকা হাজার ৫০০ বায়িং হাউজ নিবন্ধন প্রাপ্তির প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল।

২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর বস্ত্র পাট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০০২ সাল থেকে বিজিএমইএ বায়িং হাউজগুলোকে সহযোগী সদস্য হিসেবে নিবন্ধন/সনদ প্রদান করছে। বর্তমানে বিজিএমইএর সহযোগী সদস্যভুক্ত বায়িং হাউজের সংখ্যা প্রায় হাজার ৫০০। ২৮ আগস্ট ২০১৯ সালে বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত বায়িং হাউজগুলোকে বস্ত্র অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন প্রদানের জন্য পত্র প্রেরণ করা হয় কিন্তু বস্ত্র অধিদপ্তর বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত কোনো বায়িং হাউজকে নিবন্ধন দেয়নি, এমনকি তাদের আবেদনপত্রও জমা নেয়নি।

এদিকে চলতি বছর ১২ জুলাই বস্ত্র পাট মন্ত্রণালয় বরাবর পত্র বা চিঠি পাঠায় বিজিবিএ। সেখানে বলা হয়, গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং সংগঠন থেকে তাদের সহযোগী সদস্যদের বায়িং হাউজ নিবন্ধনের আবেদন করেছেন। করোনা মহামারীতে বায়িং হাউজ নিবন্ধনের ইস্যু আবারো মন্ত্রণালয়ের সম্মুখে উপস্থাপন করেছে, যা বেআইনি নীতিগর্হিত একটি কাজ। সংগঠনটির হাজার ৫০০ বায়িং হাউজ তাদের সহযোগী সদস্য বলে দাবি করেছে, বস্তুত তাদের হালনাগাদ ওয়েবসাইটে ৩০০ বায়িং হাউজের হদিস পাওয়া যায়, যার মধ্যে ৮৮টি বায়িং হাউজ বিজিবিএতে যোগ দিয়েছে। বায়িং হাউজ গার্মেন্ট বিপণনে জড়িত, তারা বিদেশী ক্রেতাদের কাছ থেকে গার্মেন্ট অর্ডার সংগ্রহ করে তাদের ডিজাইন এবং চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনকারী কারখানা নির্বাচন করে।

ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানা ক্রেতাদের পছন্দ নির্দেশমতো প্রস্তুতের পর গার্মেন্ট রফতানি হয় এমন তথ্য উল্লেখ করে বস্ত্র পাট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বিজিবিএ বলেন, এভাবেই বিপণন করে বিজিবিএ এবং ম্যানুফ্যাকচারিং করে বিজিএমইএ বিকেএমইএ। দুটি ভিন্ন ব্যবসা সংগঠন কখনই একে অন্যের সহযোগী সদস্য আইনসংগত হতে পারে না। অবস্থায় ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগী সদস্য বায়িং হাউজকে বস্ত্র আইন ২০১৮ অনুযায়ী কোনো ধরনেরই নিবন্ধনের সুযোগ নেই বিধায় আবেদনটি গ্রহণ না করার জন্য অনুরোধ করা হলো। এরপর গত ২৮ জুলাই -সংক্রান্ত আইনি নোটিসের উদ্যোগও গ্রহণ করেছে বিজিবিএ।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে তাদের আবেদন বিবেচনায় নেয়ার জন্য। এদিকে বস্ত্র অধিদপ্তর থেকে বলা হচ্ছে, বায়িং হাউজ সদন দেয়ার সংশ্লিষ্ট সংগঠন বিজিবিএ। বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশন বলে আগে কিছু ছিল না, বিজিএমইএই সহযোগী সদস্য বানানোর মাধ্যমে বায়িং হাউজকে স্বীকৃতি দেয়া শুরু করে। পরে বিজিবিএ যখন সংগঠন হিসেবে ভূমিকা পালন করতে আবেদন করে, তখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে তাদের অনুমতি দেয়া হয়নি। নিয়ে মামলা হলে তা স্টে করে রাখা হয়। এরপর ২০১৮-তে নিবন্ধনের কর্তৃত্ব বিজিবিএর হাতে যায়। এদিকে বিজিএমইএর আওতায় আছে ১৫০০ বায়িং হাউজ।

প্রসঙ্গে বিজিএমইএ পরিচালক শহিদুল হক মুকুল বণিক বার্তাকে বলেন, কথা হলো এখন করোনাকাল আমাদের সহযোগী সদস্য যে বায়িং হাউজগুলো আছে, সেগুলোকে আবারো নিবন্ধন নিতে হবে। এক্ষেত্রে দুটি সংগঠনই কাজ করতে পারলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বস্ত্র অধিদপ্তর বলছে কর্তৃত্ব বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনের। বিষয়টির আইনগত দিকগুলো খতিয়ে দেখেই বিস্তারিত মন্তব্য করা ঠিক হবে। আমাদের আইনজীবীর সঙ্গে নিয়ে পরামর্শ করা হবে।

বিজিবিএ সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন বলেন, দুই সংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ বায়িং হাউজের স্বার্থ সুরক্ষাসংশ্লিষ্ট। বিজিএমইএর সহযোগী সদস্য বায়িং হাউজগুলোর কোনো স্বার্থ রক্ষা হয় না। এমনকি সংগঠনটির নির্বাচনে ভোটাধিকারও নেই বায়িং হাউজগুলোর। প্রধানত ম্যানুফ্যাকচারিং সংগঠনের আওতায় বিপণন কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্য হওয়ায় স্বার্থ সংঘাত তৈরি হয়েছে। এদিকে বস্ত্র আইন অনুসরণ করে বায়িং হাউজের স্বীকৃতির কর্তৃত্ব বিজিবিএর। আমরা চাই আইনের মাধ্যমে বায়িং হাউজ কার্যক্রমগুলো সুশৃঙ্খল হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন