করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ : সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির অনন্য ব্যর্থতার নেপথ্যে

বণিক বার্তা ডেস্ক

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তার রোধে প্রায় সব দেশই রীতিমতো যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। যদিও অধিকাংশ দেশেই ভাইরাস সংক্রমণের তীব্রতা কমেছে। তবে এই যুদ্ধে অনেকে ভুল করেছে। সাধারণ মানুষ সেই ভুলের মাশুল দিয়েছে প্রাণ দিয়ে। ভুল করা তারপর তা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে নিতে অনেক দেশের বহু প্রাণক্ষয় হয়েছে ঠিকই। কিন্তু বিশ্বের অন্য ধনী দেশের মতো সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সবচেয়ে বাজেভাবে ভাইরাস মোকাবেলা করছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে সবচেয়ে বেশি মূল্যও দিতে হচ্ছে। দেশে টানা চার মাস ধরে সমানে সংক্রমণ বাড়ছে। খবর ডেকান হেরাল্ড।

কভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রথম সবচেয়ে মারাত্মক ভুলটি করেছে চীন। এই নভেল করোনাভাইরাস সম্পর্কে সতর্ককারী চিকিৎসকদের কণ্ঠরোধ করেছে এবং উহান থেকে সেটিকে বাইরে ছড়িয়ে পড়তে একপ্রকার সহায়তা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

এর পরের ঝড়টি এসেছে ইউরোপে। এবং যথারীতি ইউরোপের অনেক সরকারপ্রধানই প্রথমে বিষয়টিকে হালকাভাবে নিয়েছে। ফলে ব্যাপক বিস্তার এবং প্রাণহানি ঘটেছে। আর এখন প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে এসেছে এমন আত্মবিশ্বাস থেকে সামাজিক তত্পরতা অনেকটা উন্মুক্ত করে দেয়ার কারণে জাপান, কানাডা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশে নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে।

প্রথম যখন নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হলো তখন যুক্তরাষ্ট্রের চেহারা ছিল দরিদ্র দেশগুলোর মতো। ধনী এবং পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির মহামারী মোকাবেলায় এমন লেজেগোবরে অবস্থা নাগরিকদেরও লজ্জিত করেছে। পরিস্থিতিকে অনেকে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশ ব্রাজিল, পেরু দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অভিবাসী অধ্যুষিত বাহরাইন ওমানের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

অধিক প্রাদুর্ভাবের অনেক দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোয়ও বিশেষ করে গরিব দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার হওয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ বেশি লক্ষ করা গেছে। শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ এবং লাতিন জনগোষ্ঠী তিন গুণ বেশি আক্রান্ত হয়েছে।

ভাইরাস সংক্রমণের এই বৈষম্যমূলক চিত্রের ব্যাখ্যা খুঁজতে সারা বিশ্বের বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস। এসব সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনে প্রধান দুটি বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রথমত, নভেল করোনাভাইরাসের মতো বৈশ্বিক মহামারী মোকাবেলা করতে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এমন একটি বড় দেশ, বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, পাশাপাশি সরকারি নিয়ন্ত্রণের ওপর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রাধান্য দেয়ার ঐতিহ্যে অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হয়েছে।

রাষ্ট্রের ওপর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রাধান্য দেয়ার ঐতিহ্য যুক্তরাষ্ট্রে একটি অসম, বৈষম্যমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করেছে। ফলে চিকিৎসা খাতকে অন্য ধনী দেশগুলোর তুলনায় বেশি নাজুক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। সেসব দেশের তুলনায় দেশে শিশুমৃত্যুর হার এবং ডায়াবেটিস রোগীর হার বেশি এবং প্রত্যাশিত আয়ুও কম।

একই কথা বলেছেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের স্কুল অব পাবলিক হেলথের ভাইস ডিন এপিডেমিওলজিস্ট . জ্যারেড বেটেন। তিনি বলেন, আমাদের উদারনৈতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেক ভালো কথা বলা যায়। কিন্তু এর ফলাফল হলো সামগ্রিকভাবে আমরা সফল হতে পারিনি।

দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে যেটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেটি সম্পর্কে কথা বলতে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বেশ অস্বস্তি বোধ করেছেন। কারণ দলীয় রাজনীতির নোংরা কে গায়ে মাখতে চায়! তাদের অধিকাংশই একমত যে ট্রাম্প প্রশাসনের অব্যবস্থাপনার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের হাল।

অন্যান্য উচ্চ আয়ের দেশ এবং বাকি বিশ্বের খুব কম দেশের রাষ্ট্রনেতাই মহামারী মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করেছেন। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন উপেক্ষা করেছে। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, এই ভাইরাস তেমন কিছু নয়। দ্রুতই এটা চলে যাবে। মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রশ্ন করে গেছেন। অনেক অঙ্গরাজ্যের প্রশাসনকে ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে দিতে উৎসাহিত করেছেন, সেই সঙ্গে চিকিৎসা নিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়েছেন। এই সুযোগে হু হু করে বেড়েছে সংক্রমণ। সম্প্রতি জনসমক্ষে তিনি এমন সব পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন, যা মানুষকে মহামারীকে ভয়ংকর কিছু মনে না করতে প্রেরণা দেবে।

অনেক রিপাবলিকান গভর্নর ট্রাম্পকে অনুসরণ করেছেন। কেউ কেউ অবশ্য বিজ্ঞানকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। ডেমোক্র্যাট গভর্নররা বৈজ্ঞানিক পরামর্শ শুনেছেন কিন্তু ভাইরাসের বিস্তার রোধে তাদের সবার গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিরবচ্ছিন্ন যথাযথ ছিল না।

জনস হপকিনস সেন্টার অব হেলথ সিকিউরিটির এপিডেমিওলজিস্ট কেইটলিন রিভার্স বলেন, যেসব দেশ করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সমর্থ হয়েছে তাদের চমত্কার কৌশল এবং সত্যিকার একটা ভিশন ছিল। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই আমাদের সে রকম কিছু আছে কিনা, অন্তত তেমন কিছু প্রকাশ করা হয়নি এখনো।

ট্রাম্পের এসব অব্যবস্থাপনা অবহেলার কারণে যেভাবে ভাইরাস সংক্রমণের পথ তৈরি হয়েছে সেটির সংক্ষিপ্ত তালিকা করলে যা দেখা যায়: কাযকর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার অভাবচীনে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর দিকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও প্রবাসী মার্কিন নাগরিকরা ঠিকই আসতে পেরেছেনদুই মাসে ৪০ হাজার নাগরিক দেশে ফিরেছেন, পরীক্ষা ব্যবস্থা বারবার ভেঙে পড়া, মাস্ক বিষয়ে বিভ্রান্তিকর পরামর্শ, ভাইরাস অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের অসামঞ্জস্যপূর্ণ কথাবার্তা।

এসব কারণে অন্য ধনী দেশগুলোর তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে মৃত্যুহার বেশি। পৃথিবীর মাত্র শতাংশ জনসংখ্যার দেশ হলেও করোনায় মোট মৃত্যুর ২২ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রের।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন