ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

স্মৃতি সতত: সুখের

শামীম আজাদ, সেলিম জাহান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বছর ১০০ বছরে পা রাখল। এই দীর্ঘ পথযাত্রার আমরাও তো একটি বালুকণা। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগের একটি সময়ে অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে পা রেখেছিলাম। আমি অর্থনীতিতে, শামীম আজাদ বাংলায়। দীর্ঘ পথ চলার এই যাত্রার প্রান্তে এসে আমাদের মনে হয়েছে এখন বোধহয় স্মৃতিচারণ করা দরকার, ফিরে যাওয়া দরকার সেই দিনগুলোয়। আমরা এর নাম দিয়েছি স্মৃতি সতত: সুখের

সেলিম জাহান: প্রথমেই দুজন লেখকের লেখা দিয়ে শুরু করছি। একজন হচ্ছেন বিমল কর, অন্যজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিমল কর বলেছিলেন, সবকিছুই যে পৃথিবীতে প্রকৃতির নিয়মানুসারে হয় তা কিন্তু নয়, একেবারেই নিচের গাছটিতে বা নিচের ডালটিতে প্রথম ফুল ফুটবে তা নয়, অনেক সময় ওপরের ডালটিতেও প্রথম ফুল ফোটে। মানুষের মনে স্মৃতিরাও ঠিক সেভাবে আসা-যাওয়া করে। প্রথমেই যে দূর অতীতের স্মৃতি আসবে, তারপর ক্রমানুক্রমিকভাবে অন্য স্মৃতিরা আসবে রকম ঠিক নয়। তাই আমাদের কথায়ও কোনো স্মৃতি আগে আসবে কোনো স্মৃতি পরে আসবে। দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই যে পোষ্ট মাস্টার গল্পে রতন বলছে যে তার মা-বাবাকে তার মনে নেই কিন্তু কোনো এক মধ্যাহ্নে তার ভ্রাতার সহিত সে একটি ছিপ লইয়া মাছ মাছ ধরা খেলিতেছিল সেই বর্ষার দিনটির কথা তাহার বেশ মনে আছে। আমাদের যে স্মৃতির ভাণ্ডার, তার কোনটা মনে পড়বে আর কোনটা যে মনে পড়বে না, তার কিন্তু কোনো ঠিক নেই। অতএব, দুটো নিয়েই আমাদের স্মৃতিচারণা শুরু। তবে একবারেই তো সব স্মৃতিচারণ করা সম্ভব হয়ে উঠবে না, সুতরাং বিভিন্ন সময় আমরা হয়তো বিষয়গুলো নিয়ে স্মৃতিচারণ করব। বিশেষ করে আমাদের স্মৃতিগুলো, আমাদের কথোপকথন নতুন প্রজন্ম যদি শোনে তাহলে হয়তো তাদের ভালো লাগবে।

সেলিম জাহান: শামীম, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর বাংলা বিভাগে কার সঙ্গে তোমার প্রথম বন্ধুত্ব হয়েছিল?

শামীম আজাদ: মনে আছে টিএসসিতে গিয়েছিলাম আমাদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে। আমি তখন শামীম তরফদার হিসেবে লিখতাম। পাশে যে মেয়েটি বসেছিল, তার নাম বাবলি হক। সেও লেখে। ভাব হয়ে গেল। আমার অন্যপাশে বসেছিল শেলী, এখনকার শেলী মীর্জা। আমরা তিনজন ৫০ বছরের বন্ধু।

সেলিম জাহান: ৬৯- আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখি তখন কিন্তু খুব উত্তাল সময়। সবে পাকিস্তানের লৌহমানব আইয়ুব খান পদত্যাগ করেছেন, ইয়াহিয়া খানের রাজত্ব শুরু হয়েছে, মোনায়েম খান অপসারিত। আমারই এক শিক্ষক মির্জা নুরুল হুদা বোধহয় তিনদিনের জন্য গভর্নর হয়েছিলেন। খুব সুন্দর একটা ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি আবার ফেরত এসেছেন শিক্ষক হিসেবে। তার কিছুদিন আগে, সবারই হয়তো মনে আছে সলিমুল্লাহ হলে তত্কালীন জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের দুর্বৃত্তরা মার্ক্সবাদী অর্থনীতির শিক্ষক প্রফেসর আবু মাহমুদকে প্রহার করেছিল। আবু মাহমুদকে প্রহার করার ফলে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের এক নেতা ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছিলেন, যার নাম ছিল পাঁচপাত্তুর। পাঁচপাত্তুর পকেটে সাপ পুরে রাখতেন এবং তা দিয়ে ভয় দেখাতেন।

তাকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কিংবদন্তি আছে। তখন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন সৈয়দ মোর্শেদ কামাল। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাকে জড়ানো হয় এবং জেলেও ঢোকানো হয়। তিনি আমাকে পাঁচপাত্তুর সম্পর্কে বলেছিলেন যে পাঁচপাত্তুর খুব সম্ভবত প্রিলিমিনারিতে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রিলিমিনারিতে যারা পড়তেন তারা বলতেন পার্ট ওয়ান এবং পার্ট টু। পাঁচপাত্তুর পার্ট ওয়ান পার্ট টুও পাস করেছিলেন। তাই তিনি নাকি সবাইকে বলে বেড়াতেন পাসড পার্ট টু। এভাবেই তার নাম হয় পাঁচপাত্তুর।

শামীম আজাদ: প্রথম যেদিন ক্লাস করতে গিয়েছি, দেখি এত বড় বড় সংখ্যার শ্রেণীকক্ষের নাম, যেমন ২০১৬, ২০১৭; আমি বুঝতে পারছিলাম না যে এই হাজার হাজার রুমের মধ্যে আমি আমার ক্লাস খুঁজে কীভাবে পাব! প্রথম দিন আমি কিন্তু ক্লাস করতে পারিনি, কমনরুমে চলে এসেছিলাম।

সেলিম জাহান: আমার ক্লাস ছিল কলা ভবনের দ্বিতীয় তলায়, ২০২৪ নম্বর রুমে ইংরেজি বিভাগের সঙ্গে। আমরা ক্লাসে গিয়েছি। আংকিক অর্থনীতির ক্লাস। ক্লাসে এলেন এক তরুণ যুবক। অত্যন্ত চৌকস অত্যন্ত সুদর্শন। তিনি ছিলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি সদ্য ইসলামাবাদ থেকে এমএ করে এসেছেন। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও এমএ করে এসেছেন তখন।

শামীম আজাদ: সেলিম, তুমি জানো ক্লাসে কিন্তু ছাত্রদের মুখোমুখি হওয়া একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। অনেক বেশি সাহস লাগে, কিছু কৌশলের প্রয়োজন হয়। ঢাকা কলেজে আমি পড়াতাম, শিক্ষার্থীরা ভীষণ মেধাবী ছিল, দুষ্টুমিতেও তারা সেরা ছিল। তাই আমি মনে করি, ক্লাসে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকেরই তৈরি হয়ে যেতে হবে।

সেলিম জাহান: আমার সতীর্থ শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। আমি কিন্তু ২৫ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই থেকে গেলাম। তাই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলাম বলার চেয়ে বলা ভালো, আমি সেখানে পড়েই ছিলাম। 

আমি ছিলাম সলিমুল্লাহ হলে, তখনকার সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। আমার বাবা যেহেতু হলেই থেকেছেন, তাই আমারও এখানে থাকা চাই। কিন্তু সে সময় যাদের পাস করে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তারা পাস করে না বের হওয়ায় সিট বরাদ্দ হলেও সিট পাওয়া যাচ্ছিল না। আমাদের তখন হাউজ টিউটর ছিলেন ইংরেজির প্রফেসর কেএমএ মুনিম আর প্রভোস্ট ছিলেন রসায়নের প্রফেসর মোফিজউদ্দীন আহমেদ। আমি যেহেতু তখনো সিট পাইনি, সাধারণত -জাতীয় সময় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন শিক্ষার্থীদের তাদের দলে টানতে চায়। তবে আগে থেকেই আমার ছাত্র ইউনিয়নের প্রতি সমর্থন ছিল এবং তাদের অনেককেই চিনতাম। আমার সাময়িকভাবে সিট পড়ল ১৪৩ নম্বর রুমে। সেখানে খুব অল্প সময় আমার সঙ্গে ছিলেন শহীদ লুত্ফুল আজিম। ২৫ মার্চ রাতে তিনি ওই রুমেই ছিলেন এবং তাকে শুধু হত্যা করাই হয় তা নয়, তার মরদেহ টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। বহুদিন সেখানে তার রক্তের দাগ ছিল।

শামীম আজাদ: যেকোনো কারণেই হোক তখন দেখা গেছে, যারা এমএ পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তারা তখনো হল ছেড়ে যেতে পারছিলেন না। তাই তখন একটা নিয়ম ছিল, বলা হতো ডাবলিং। সিনিয়র একজনের সঙ্গে তার রুমে গিয়ে থাকতে হতো। আমি চামেলি হলে ছিলাম, যা সুন্দর ছিল হলটা। অনেকটা চামেলি হাউজের মতো। তখন হলটি নিয়ে অনেক কিংবদন্তি শুনেছিএটা সাহেবদের সময়ে তৈরি। এখানে নাচ হতো। নূপুরের শব্দ শোনা যায়। বুটের আওয়াজ আসে। মনে আছে সিঁড়িগুলো ছিল কাঠের। আমি সেই চামেলি হলে প্রথম জায়গা পাই। কিন্তু হলে প্রবেশের আগে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে হয়। তো সবাই আমরা জড়ো হয়েছি। ওখানে মেহেরুন্নেসা চৌধুরী আপা ছিলেন।

সেলিম জাহান: তিনি কিন্তু বরিশালের। তখনকার দিনে তিনি গাড়ি চালাতেন। তার একটা ফিয়াট গাড়ি ছিল। তার ছেলে ফুয়াদ কিন্তু আমাদের ব্যাচের।

শামীম আজাদ: মেহেরুন্নেসা আপা হাতভর্তি স্বর্ণের চুড়ি পরতেন। ভীষণ সুন্দর ছিলেন দেখতে। তিনি ছিলেন আমাদের হাউজ টিউটর। তো প্রতিটি রুমে মেয়েদের নাম ধরে বরাদ্দ করা, আমার সঙ্গে ছিল পারুল ( আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আমাদের যে বন্ধুরা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, আমরা একদিন তাদের নিয়ে কথা বলব) পারুল আর আমি সেই টাঙ্গাইল কুমুদিনী কলেজ থেকে একসঙ্গে। আমরা দুজন দুজনের আঠা। পারুল, আমি সিমিন নামে আমার এক ছোটবেলার বন্ধু, কিন্তু মোট চারজনকে দেয়া হবে রুমে। আমরা তখন খুঁজছি যে কাকে নেয়া যায়, এই সময় শ্রাবণীকে পেলাম আমরা। শ্রাবণী আমাদের এখন ৫০ বছরের বন্ধু। মজার ঘটনা হলো, চামেলি হাউজে আমরা যখন গেলাম, রাতের বেলা আর আমাদের ঘুম হয় না। শুধু মনে হয়, এই বুঝি বুটের শব্দ পাব, নূপুরের শব্দ পাব। সেলিম এবার তুমি বলো তোমার রুমটা কেমন ছিল?

সেলিম জাহান: সলিমুল্লাহ হলের দুই দিকে দুটো ব্লক। আমরা বলতাম ইস্ট হাউজ ওয়েস্ট হাউজ। লম্বা টানা বারান্দা। প্রথম যেটা অর্থাৎ ১৪৩ নম্বর রুমে আমি খুব বেশি দিন ছিলাম না, বোধহয় দুই সপ্তাহের মতো ছিলাম। তারপর আমার স্থায়ী বরাদ্দ হলো ৩৩ নম্বর রুমে। আমাদের কক্ষে চারজনের থাকার ব্যবস্থা। ছিলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শাহাবুদ্দিন; লম্বা করে নায়কের মতো চেহারা। সলিমুল্লাহ হলে কোনো নাটকে তিনি নায়ক হতেন। আর একজন ছিলেন সালাম নামে, পড়তেন শিক্ষা গবেষণায়। আমার একেবারে ডান দিকে যিনি ছিলেন, তার কথা একটু বলতে চাই। তিনি ছিলেন কমরেড তাজুল ইসলাম। অর্থনীতিতে পড়তেন। পড়াশোনা শেষ করে আদমজীতে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেলেন। শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকার কারণে তিনি শ্রমিকদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করলেন। ১৯৮৪ সালে তাজুল ইসলামকে হত্যা করা হয়। মালিকপক্ষ তাকে হত্যা করে। কেন জানি না, এসব কিংবদন্তি মানুষকে আমি আমার সহপাঠী হিসেবে কিংবা কক্ষের বাসিন্দা হিসেবে পেয়েছি।

শিক্ষকদের প্রসঙ্গে আমি তো আনিসুল ইসলাম মাহমুদ দিয়ে শুরু করেছিলাম, এবার আমি ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দিয়ে শেষ করব। প্রথম ক্লাস শেষে দ্বিতীয় ক্লাস নিতে এলেন জাকির আহমেদ। তিনি আমাদের কৃষি অর্থনীতি পড়াবেন। তিনি পরে অর্থ সচিবও হয়েছিলেন। যাই হোক, শুক্রবার তখন বন্ধ ছিল না। ক্লাস হবে ৩০১৭-তে। যেসব শিক্ষক ৩০১৭-তে ক্লাস নিয়েছেন এবং যেসব ছাত্রছাত্রী সেখানে ক্লাস করেছেন, তারা জানেন এর চেয়ে খারাপ শ্রেণীকক্ষ কলা ভবনে আর নেই। কারণ শ্রেণীকক্ষের উপরের দিকে গম্বুজের মতো ছিল। শব্দ করলে প্রতিধ্বনি হতো এবং কিছুই শোনা যেত না। তৃতীয় দিন আমরা ক্লাসে গেছি। একজন শিক্ষক প্রবেশ করলেন। খুব লম্বা নন। মাথাভর্তি চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো। সে সময় টেরিনিন বলে একটা কাপড়ের খুব চল। খুব সম্ভবত স্যারের শার্টটি ছিল ওই কাপড়ে তৈরি। হাতে একটা ডাস্টার। তিনি ক্লাস নিতে শুরু করলেন। সবচেয়ে অন্য রকম ক্লাস ছিল সেটি। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের একটিও শব্দ নেই। শুধু শিক্ষকের কথা শোনা যাচ্ছে। আমার আজও মনে আছে ওয়াহিদ ভাই হেঁটে হেঁটে পড়াচ্ছেন। ডাস্টারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত এক হাত থেকে অন্য হাতে নিচ্ছেন। ব্যষ্টিক অর্থনীতির, বোধহয় তৃতীয় বা চতুর্থ পত্র পড়িয়েছিলেন। ওই যে তিনি পড়ালেন। আমি তার পরে ওই বিষয়ে আসলে আর কোনো বই পড়িনি। আমার জীবনে আমি যতজন শিক্ষক পেয়েছি, যাদের দ্বারা আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি, ছাত্র হিসেবে এবং পরবর্তীকালে শিক্ষক হিসেবে, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে আমি সবসময় একজন প্রতীক হিসেবে ধরে রেখেছি এবং তার মাপের কাছে যেতে চেষ্টা করেছি। পারিনি। কিন্তু চেষ্টা করেছি।

শামীম আজাদ: আমাদের শিক্ষকরা ভীষণ আধুনিক। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ স্যার কিন্তু এখন গান করেন, ছবি আঁকেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখনো তিনি সচল। আমার মনে হয় না, আমাদের মতো সৌভাগ্য অন্যদের হবে। শিক্ষকদের কথা বলতে গেলে আমি বেশি ভারাক্রান্ত হয়ে যাই। বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং দেশের সামগ্রিক আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের বাংলা বিভাগের শিক্ষকরা ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। সে কারণে ১৯৭১ সালে আমাদের বেশ কয়েকজন শিক্ষককে আমরা হারিয়েছি। সেলিম তুমি যখন শিক্ষকদের পড়ানোর কথা বলছিলে, আমার বারবার সেই শিক্ষকদের কথা মনে হচ্ছিল। মুনীর চৌধুরী স্যারের কথা মনে হচ্ছিল। মুনীর স্যার কোনো দিন ক্লাসে আমাদের রেজিস্টার করতেন না, কিন্তু তার ক্লাসে শিক্ষার্থীদের কোনো কমতি হতো না। স্যার যখন ক্লাসে প্রবেশ করতেন, মনে হতো তিনি একটা আবহ নিয়ে প্রবেশ করলেন। স্যার চেয়ার টেনে নিয়ে শ্রীকান্ত পড়াতে বসেছেন, কিছুক্ষণ পরেই আমাদের মনে হতো আমরা জলজ্যান্ত শ্রীকান্তকে দেখতে পাচ্ছি। স্যারের চশমার ভেতর থেকে তির্যক চোখ, গলার স্বর, ব্যাকব্রাশ করা চুল, পাঞ্জাবি, হাতের মণিবন্ধে ঘড়ি। স্যার বলে যাচ্ছেন, আমরা শুনছি। স্যারকে কখনো ক্লাস নিয়ন্ত্রণ করতে হতো না। বলতে হতো না পেছনে কেন শব্দ হচ্ছে। একনাগাড়ে স্যার পড়িয়ে যেতেন। আমরা একনিষ্ঠভাবে শুনতাম। ক্লাস শেষে স্যার বেরিয়ে যাওয়ার আগে মনে হতো, ক্লাসটা কেন আর একটু দীর্ঘ হলো না।

সেলিম জাহান: মুনীর স্যারের সাইকেল নিয়ে তোমার একটা লেখা ছিল।

শামীম আজাদ: হ্যাঁ, বলি এটা। আমাদের সে সময়টাকে তো আমরা বলি সাদাকালো সময়। আমরা বলি ষাটের দশকের ঢাকা, পিউর ঢাকা। এখন যেমন অনেকেই পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হয়ে সাইকেল চালাচ্ছেন। তখন কিন্তু অনেকেই সাইকেল চালাতেন। মুনীর স্যার একটা সাইকেলে করে আসতেন। আমি বলছি মুক্তিযুদ্ধের আগের কথা। স্যার পাজামার ফ্লেয়ারটাকে আটকে রাখার জন্য একটা আংটা ব্যবহার করতেন। সাইকেলের সামনে একটা বেতের ঝুড়ি রাখতেন। কলা ভবনে মূল সিঁড়ি দিয়ে উঠলে দ্বিতীয় তলায় বাংলা বিভাগ। আমাদের বিভাগের আধিকারিক ছিলেন তালেব ভাই। কোনো কাজ থাকলে আমরা তার কাছে যেতাম আর নিচে মুনীর স্যারের সাইকেলে রাখা ঝুড়িতে কী বই রাখা আছে, তা দেখার চেষ্টা করতাম।

সেলিম জাহান: শামীম তোমার নবীনবরণ উৎসবের কথা মনে আছে? ওটা তো বিভাগ অনুসারে হতো।

শামীম আজাদ: প্রথমে বিভাগওয়ারি এবং পরে সবাইকে নিয়েও একসঙ্গে হতো। সবাইকে নিয়ে নবীনবরণ উৎসবে আমরা বাংলা একাডেমিতে রক্তকরবী দেখতে গিয়েছিলাম। চমত্কার নাটকটি। কাজী তামান্না, গোলাম রব্বানী, গোলাম মুস্তাফা অভিনয় করেছিলেন। আক্তার ইমাম ছিলেন আমাদের হলের প্রভোস্ট। আপার কঠোর শাসন ছিল আমাদের ওপর। তার একটা গাড়ি ছিল। সন্ধ্যাবেলা আমরা হয়তো ছোটাছুটি করছি, এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে আছি, গান করছি। গেটে যখন আপার গাড়ির শব্দ পেতাম, আমরা সবাই শান্ত হয়ে যেতাম। কিছু নিয়ম ছিল আমাদের। প্রত্যেক সন্ধ্যায় আমাদের হাজিরা দিতে হতো রোকেয়া হলে যে আমরা সন্ধ্যা ৭টার আগে ফিরেছি কিনা। চামেলি হাউজের সামনে ছোট লন মতো জায়গায় রেজিস্টার নিয়ে একজন হাউজ টিউটর নাম ধরে ডাকতেন। শামসুন্নাহার হল তখনো হয়নি। নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। এই যে তখন নাম ডাকাডাকি হতো, তখন আমরা একটা কাজ করতাম। কাজটাকে বলতাম প্রক্সি দেয়া। আমাদের মধ্যে যারা সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে হলে ঢুকতে পারতাম না, তাদের হয়ে অন্য একজন প্রক্সি দিয়ে দিত। মাথাটা লুকিয়ে অন্যের হয়ে প্রেজেন্ট বলতাম। [চলবে]


লেখক পরিচিতি:

শামীম আজাদ: একজন কবি, লেখক ও গল্পকথক। তিনি বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লেখেন। সত্তরের দশকে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রায়’ শামীম তরফদার নামে প্রবর্তন করেন বাংলাদেশে ফ্যাশন সাংবাদিকতার। যুক্তরাজ্যে বাংলা ভাষায় তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি।

সেলিম জাহান: একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। কর্মজীবনে বছর দুয়েক আগে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মুখ্য লেখক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন দুই দশক ধরে। ইংরেজি ও বাংলায় তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা এক ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক।


শ্রুতলিখন: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন