হঠাৎ নেটফ্লিক্সে চেপে বুলবুল উড়ে এল।
একেবাবে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়া দশা।
স্ট্যাটাস, লেখায় ভেসে যাচ্ছে সোস্যাল মিডিয়া।
দেখার লোভ সামলানো গেল না, তাই দেখলাম।
দুদিন পরের ক্লাসে রবার্ট ফিস্ক, রবার্ট কাপা আর আফগান ওয়ার নিয়ে ভারি ভারি আলোচনার ফাঁকে নিজেই উৎসাহী হয়ে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করি, ‘বুলবুল দেখছেন?’ একজন বললেন, ‘ম্যাডাম বন্ধু বলছে, ছবিটা হাইথটের, তাই ভাবছি পরীক্ষার আগে দেখব না।
মাথা গুলায় যাবে।’ এই ‘হাইথট’ বিষয়টির প্রতি আমার আবার আগ্রহ অদম্য।
তাই ক্লাস শেষে হাইথটের খোঁজে তৃতীয়বারের মতো আমি বুলবুল দেখতে বসি।
ছবিটি যারা দেখেছেন, বেশির ভাগই বলছেন এটি প্রবল নারীবাদী গল্প।
ছবির প্রযোজকদের একজন আনুশকা শর্মা বলেন, যেকোনো কালচারের মানুষ ছবিটি গ্রহণ করবে রূপকথার গল্প হিসেবে।
‘ঠিক যেন দাদা-দাদির কোলে শুয়ে ভূতের গল্প শোনর মতো।’ ভারি ভাষায় এ ধরনের গল্পকে আমরা বলি ‘ডার্ক ফেবল’। আনভিতা দত্ত, ছবির পরিচালক এক সাক্ষাত্কারে বলেন, তারও পা নাকি উল্টা (অর্থাৎ সমাজের গত্বাঁধা নিয়মে তিনি চলেন না।)
আর এ রূপকথাও উল্টা পায়ের ডাইনিদের বলেই আনভিতা দাবি করেন।
এ ছবির মূল শক্তি হলো চলচ্চিত্রের বলার ধরন। লাল রঙ, কুয়াশা, বন আর ময়ূরের পাখার কনোটেশন ছবিটিকে ভয়াবহ করেছে। রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিতের গল্প ও স্টাইলের সঙ্গে মিল একে ‘বাঙালিয়ানা চলচ্চিত্রের’ লুক দিয়েছে। চলচ্চিত্রের একটা বড় অংশ শুট হয়েছে লাল ফিল্টারে। আমরা জানি, আগুন আর রক্তকে ব্যাখ্যা করতে সাধারণত লাল রঙ ব্যবহূত হয়। কথিত আছে, লাল রঙ যেকোনো বাস্তবকে পরাবাস্তব হিসেবে হাজির করতে সবচেয়ে কার্যকর। প্রাচীন শিল্পকলায় শিল্পীরা দোজখের চিত্রায়নে বরাবর ব্যবহার করেছেন লাল রঙ। আনভিতা দত্ত তো দোজখের গল্পই বলতে চেয়েছেন। তবে সেই দোজখে পুরুষতন্ত্র নয়, বরং খোদ নারীকে পুড়ে যেতে দেখি আমরা। তাও প্রেমিকের হাতে লাগানো আগুনে। সেই যে আদিতে, অনেক অনেক দিন আগে নারীর জ্যান্ত চিতায় পুড়ে মরার মতোই। বুলবুল মারা যায়, কিন্তু তার ‘বড় বউ’ পরিচয় নিয়েই। সত্য বিলেত থেকে বছর পাঁচেক পর ফিরে এলে পুনরায় ক্ষমতাচ্যুত ঠাকুরাইন (বুলবুল) বরণ করে নেয় নিয়তির মতো জ্বলন্ত মৃত্যুকে।
ভারতে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি ধর্ষণের রিপোর্ট হয়।
এ অবস্থায় তামাম ধর্ষককে গলায় কামড় দিয়ে রক্ত চুষে খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, মধ্যবিত্ত সমাজের অনেকেরই হয় বৈকি।
ঠিক যেন কালির চেয়েও অনেক বেশি ড্রাকুলার মতো।
সেই কুয়াশাচ্ছন্ন বন পেরিয়ে, ব্রাম স্টোকার’স ড্রাকুলা ‘র (১৯৯২) হন্টেড প্যালেস, তার দেখা মেলে বুলবুলেও।
পশ্চিমের বিশ্বাসে ‘শয়তানের চোখ’খ্যাত ময়ূরের পালক হাতে থাকে বুলবুলেরও।
কিন্তু অবাক করা বিষয়, সে কিন্তু ডাইনি থাকে না বেশি দিন।
মৃত্যুকালে তার পরিচয় দাঁড়ায় দেবী হিসেবে।
দর্শক আলোড়িত হতে থাকে ‘সাধারণ মেয়ের’
দেবীতে রূপান্তরের গল্পে।
সত্য বনে আগুন লাগিয়ে দিলে ডাক্তার বলে ওঠে, ‘সে ডাইনি নয়, সে দেবী’। ফলে এখানে এসে আনভিতার দাবি হোঁচট খায়।
এ গল্প উল্টা পায়ের ডাইনির নয়, বরং এ গল্প একজন দেবীর।
যিনি পারিবারিক প্রবল নির্যাতনের জবাব দিতে নিজেকে রূপান্তর করেছেন দেবী কালীতে।
আমাকে দাগ কেটেছে বিনোদিনী চরিত্রটি।
আনভিতা বলেন, চলচ্চিত্র বানানোর সময় তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যজিৎ রায়কে পাঠ করেছেন ভালোভাবে।
তাদের প্রভাব তিনি অস্বীকার করেন না।
চোখের বালি থেকে বিনোদিনী নামটি নিয়েছেন, সেটা নিজেই বলছেন।
পূর্বসূরিদের কাছ থেকে চরিত্র, স্টাইল গ্রহণ করার রীতি চলচ্চিত্রে বহু পুরনো।
এটা শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পদ্ধতিও বটে।
আনভিতাও তাই করেছেন।
কিন্তু পরকীয়া আর বৈধব্যটুকু ছাড়া দুই বিনোদিনীর আর কোনো মিল নেই।
আনভিতার বিনোদিনী, দুর্বল ও খল।
এমন চরিত্রগুলোর দেখা সোপ অপেরায় হরহামেশাই মেলে।
চলচ্চিত্রের একপর্যায়ে বিনোদিনীকে বুলবুলকে সবসময় ভয় পেতে দেখি, যেমনটা একসময় সে পেত ইন্দ্রনীলকে।
ভারতে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের একটা জোয়ার চলছে।
দিল্লিতে জ্যোতি সিং পান্ডের ধর্ষণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে আন্দোলন শুরু হয়।
কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিও এ সময় থেকেই ধর্ষণবিরোধী বিভিন্ন করটেন্ট নিয়ে এগিয়ে আসে।
ইন্ডিয়াস ডটার (২০১৫), দেবী
(২০২০), পিংক
(২০১৬) ছবিগুলো ধর্ষণবিরোধী দুর্দান্ত কনটেন্ট নিয়ে হাজির হয়েছে।
কিন্তু যে নির্যাতন বুলবুলকে প্রথমবার সহ্য করতে হয়, তা ধর্ষণ নয়, বরং ভয়ানক প্রহারে রক্তপাতের দৃশ্য।
স্লো মোশনে সেই সহিংসতা দর্শকের রোম দাঁড় করিয়ে দেয়ার মতো।
কিন্তু সেজন্য বুলবুল তার ঠাকুর মশায়কে কী শাস্তি দেয়, তা আমাদের অজানাই থেকে যায়।
বেঁচে থাকতে দেখি তার প্রেমিক ও হত্যাকারী সত্যকেও।
ছবির এক পর্যায়ে মনে হয় এ গল্প চেনা।
নষ্টনীড় (১৯০১) থেকে চারুলতার (১৯৬৪) বা কাদম্বরী দেবীর উপাখ্যান বলে মনে হতে থাকে।
সত্য চলে যাওয়ার আগের রাতে তার লাল ডায়েরি বুলবুলকে হস্তান্তর করে।
মনে হতে থাকে, হয়তো কাদম্বরী দেবীর সেই ইতিহাস বুলবুলের হাতে বিবৃত হবে নতুন আঙ্গিকে।
অথচ সেই ডায়েরি ছিঁড়ে আগুনে ফেলে দেয় বুলবুল।
আরো অবাক বিষয়, বুলবুলের কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই, যেমনটা আছে বিনোদিনীর।
বিনোদিনীর ইন্দ্রনীলের জন্য আকাঙ্ক্ষা ছিল বলেই তাকে খল প্রমাণ করা সহজ হয়েছে।
বিনোদিনীর প্রেমকে আনভিতা ব্যাখ্যা করেন নীল রঙে।
আর এদিকে সত্যর সঙ্গে বুলবুলের ভালোবাসার ধরনটা ‘প্লেটোনিক’। পাশাপাশি বসে ভূতের গল্প শোনার মতোই ‘পবিত্র’।
ডাক্তার সুদীপ তার অন্য প্রেমিকের জায়গা নিতে পারত, কিন্তু আনভিতা সেই ঝুঁকিতে যান না।
তাই সুদীপকে অন্য দশটা ছবির দ্বিতীয় নায়কের মতোই বুলবুলের ‘শুধু বন্ধু’
হিসেবেই থাকতে দেখি।
ফলে ‘দেবদাসের পার্বতী’র মতোই বুলবুলের একটাই প্রেম।
সে হলো প্রথম দেখার দিনে অতঃপর শুভদৃষ্টির ফাঁকে, যাকে তিনি স্বামী ভেবে গ্রহণ করেছিলেন, বুলবুলের সত্য ঠাকুরপো।
চলচ্চিত্রটি কিন্তু আরো অনেক কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারত।
অমিত ত্রিবেদীর পশ্চিমা ধাঁচে করা আবহ সংগীত নিয়ে আলাচনা হতে পারত।
সিদ্ধার্থ দিওয়ানের ক্যামেরার কাজে সুররিয়ালিজম ও এক্সপ্রেশনিজমের প্রভাব বা হিসেবি শট ও ফ্রেমিংয়ের ব্যবহার অথবা আইকনের ক্ষেত্রে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিশেল নিয়ে কথা হতে পারত।
কিন্তু চলচ্চিত্রটিকে ঘিরে আলোচনা হলো প্রবল নারীবাদী হিসেবে।
যে আলাপ খোদ ডিরেক্টর পাড়তে চেয়েছেন চলচ্চিত্রটির তিনটি দৃশ্যের ওপর ভর করে।
বুলবুলের ইন্দ্রনীল কর্তৃক প্রহারের নৃশংস দৃশ্য, মহেন্দ্র কর্তৃক ধর্ষণের দৃশ্য আর দেবীতে রূপান্তর হওয়ার দৃশ্য।
এ দৃশ্যগুলো এত মোহাবিষ্ট করে আমাদের আমরা ভুলে যাই যে গল্পটা সাদামাটা প্রতিশোধের গল্পের দিকে চলে যাচ্ছে।
প্রতিশোধের গল্প দেখবেন বলেই তো হররের মোড়কে এই মেলোড্রামা।
আর মেলোড্রামা মানেই তো ব্যবসা।
ব্যবসায় মেয়েদের উল্টা পা হলে চলে না, সতী দেবীর প্রয়োজন পড়ে।
তাই বুলবুলকে খুন করা ছাড়া আর কোনো উল্টা পায়ের কাজ করতে দেখা যায় না।
অনেক বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে থাকা আনভিতা জানেন এসব।
জেনে রাখা ভালো, যে রেপ রিভেঞ্জ জনরার চলচ্চিত্রের মূল সমস্যা হলো নারীকে শক্তিশালী হয়ে ওঠার আগে এটা নারীকে সব দিক থেকে ভঙ্গুর হয়ে যাওয়াকে রিপ্রেজেন্ট করে।
ফলে নারীকে শক্তিশালী হতে হলে অবশ্যই ভয়াবহ ধর্ষণ, প্রহারের মধ্য দিয়ে যাওয়ার শর্ত চলচ্চিত্রগুলো তৈরি করে।
তাই লাল মোহময় মোড়কে আমরা আদি গল্পের ঝাঁ-চকচকে বয়ান দেখি।
আর এখানে এসেই ছবিটিকে ‘হাইথটের’ বলে মনে হতে থাকে।
গল্পটি গুরুত্বপূর্ণ আরো অন্য কারণেও।
নারীর বয়ানে নারীর গল্প এটি।
ক্যামেরার কাজে অকারণে নারীর যৌনতাকে পুঁজি করা হয়নি।
এটা অবশ্যই উত্তরণ।
ভার্জিনিয়া উলফ যেমন বলেন, লেখার জন্য নারীর নিজের ঘর দরকার।
আনভিতা দত্ত সেই ঘরের সন্ধান পেয়েছেন।
তার প্রথম চলচ্চিত্র বানানোর টাকা জুগিয়েছেন আনুশকা শর্মা (সঙ্গে তার ভাইসহ)। আর লায়লা মজনুর ফ্লপ নায়িকা তৃপ্তি দিমরি আসন পেয়েছেন বলিউডের মতো ইন্ডাস্ট্রিতে।
চলচ্চিত্রের বিনোদিনী যা করতে পারে না বুলবুলের জন্য, বাস্তবের এই নারীরা কিন্তু দিব্যি করে দেখিয়েছেন।
এটাও উত্তরণই বটে।
এমন সব উত্তরণের পথ আরো সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য, ওয়েব সিনেমার পথিকৃেদর কাতারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য আনভিতা, আনুশকা, তৃপ্তি তো ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
মনিরা শরমিন: শিক্ষক, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া কমিউনিকেশন বিভাগ, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ