অভ্যন্তরীণ চাপ হালকা করতেই কি চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা?

এমএম খালেকুজ্জামান

‘জিরোসাম’ ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা আদতে আছে কিনা অথবা এমন পরিস্থিতি আদৌ তৈরি হবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তর ভবিতব্যই দিতে পারে। কেননা এমন ‘জিরোসাম’ প্রতিযোগিতার খেলুড়ে দেশগুলো বিভিন্নভাবে পরস্পরের ওপর এমনভাবে নির্ভরশীল যে এ বিষয়ের অমীমাংসিত অবস্থাই বরং কাম্য। এতে অপরাপর দেশগুলোর ব্লক বেছে নিতে সুবিধা হয়। এই খেলায় ছোট দেশগুলো নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে পারে। যেমন হিমালয় ধারণ করা নেপাল পৃথিবীর প্রায় সকল ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করা বিরাটাকার ভারতকে সীমান্তে একচোট দেখিয়ে দিল। যেটি দর্শক প্রদর্শক সবারই ভ্রু কুঁচকে দিয়েছে। একদা টেকেন ফর গ্রান্টেড প্রতিবেশী নেপালের এমন ইউটার্ন ভারতের জন্য নতুন ভাবনা। আর চীন তো এক আবহমান চ্যালেঞ্জ।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স বা জিএফপিতে চীন এবং ভারত শীর্ষ পাঁচের দুই সদস্য। দেশওয়ারি একক সামরিক সক্ষমতার নিরিখে এই তালিকায় আমেরিকা রয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রাশিয়া। তিন আর চারে যথাক্রমে চীন ও ভারত। অথচ ‘হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট’ এই নিউক্লিয়ার অস্ত্রের যুগেও কেমন প্রাসঙ্গিক তার ফলিত রূপ দেখা গেল চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির আঘাতে ভারতীয় সেনাদের প্রাণনাশের ঘটনার মধ্য দিয়ে।

এর আগেও চীন অধিকৃত তিব্বতে বৌদ্ধদের বিক্ষোভ এবং জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে পেরেক বসানো লাঠি ব্যবহার করে আন্দোলন দমন করেছে, সেগুলো কিছুটা ঘরোয়া প্র্যাকটিস, এবার একেবারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।

১৫ জুন গালওয়ানে ঘটে যাওয়া প্রাণহানিতে ভারতীয় সেনারা নিরস্ত্র অবস্থায় হামলার মুখোমুখি হয়েছিল কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে কংগ্রেসসহ অন্য বিরোধী দলগুলো। জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দুদিন পর তার টুইট, ‘সোজাসুজি বলি। সীমান্তে মোতায়েন সব বাহিনীই সশস্ত্র অবস্থায় থাকে, অবশ্যই যখন তারা শিবির ছেড়ে বাইরে যাচ্ছে, সে সময়। ১৫ জুন গালওয়ানেও তেমনি ছিল। কিন্তু বহু দিনের চলা প্রথা (১৯৯৬ এবং ২০০৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী) মেনে মুখোমুখি সঙ্ঘাতের সময় অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি।’ 

রাহুল গান্ধী গালওয়ানে হামলায় চীনের নিন্দার পাশাপাশি  নিজ দেশের সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন, ‘গলাওয়ানে নিরস্ত্র ভারতীয় সৈনিকদের হত্যা করে চীন নিন্দনীয় অপরাধ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভারতের বীর সেনাদের কারা নিরস্ত্র অবস্থায় ওই পরিস্থিতিতে ঠেলে দিলেন?’ সেই মন্তব্যের জবাবে জয়শঙ্কর বিগত সরকারগুলোর আমলের সীমান্ত প্রোটোকলের বিষয়টি তুলে ধরেন। এইচডি দেবগৌড়া এবং মনমোহন সিংহের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় স্বাক্ষরিত ওই দু’টি সীমান্ত প্রোটোকলের ম্যান্ডেট ছিল, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় (এলএসি) মুখোমুখি অবস্থানের সময় সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হলেও কোনো পক্ষই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করবে না। তারই মাসুল দিতে হলো ভারতের এতগুলো সেনার প্রাণহানির মধ্য দিয়ে।

চীন-ভারত দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। ১৯৬২ সালে প্রায় সর্বাত্মক যুদ্ধের ইতিহাস আছে দু’দেশের। আর কিছুদিন বিরতি দিয়ে সীমান্ত উত্তেজনা নৈমিত্তিক ঘটনা। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ডোকলাম উত্তেজনাও আলোচনার মাধ্যমে সামাল দিতে হয়েছে মোদি সরকারকে। বর্তমানেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে মোদি সরকার। যদিও সাবেক কর্নেল সৌমিত্র রায় এত সহজে পরিস্থিতির স্বাভাবিকীকরণ আশা করছেন না। তার মতে উত্তেজনা চূড়ান্ত রূপ পেতেও পারে, দুপক্ষই অপেক্ষা করছে ‘অ্যাক্লাইমেটাইজেশন’-এর। ওয়ার টার্মিনোলজিতে ‘অ্যাক্লাইমেটাইজেশন অর্থ হলো অভিযোজন বা বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার সময়। কেবল সীমান্ত পাহারা আর যুদ্ধ তো এক নয়। ২০১৭ সালে ডোকলামে যখন ভারত-চিন মুখোমুখি হয়েছিল, তখন ৭৩ দিন ধরে উত্তেজনা চলেছিল। 

চীন-ভারতের মধ্যে বৈঠকে, পরিস্থিতি শান্ত করে আনার কথা বলছে দুই পক্ষই। তবে ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন বলছে অন্যকথা। ভারকে চাপে রাখতে  চীনের সঙ্গে পরামর্শ করে ২০ হাজার অতিরিক্ত সৈন্য লাদাখ অঞ্চলের দিকে পাঠিয়েছে পাকিস্তান। যুদ্ধবিশারদদের ধারণা, চীন-পাকিস্তান দু’দেশই  ভারতের সঙ্গে ‘টু ফ্রন্ট ওয়ার’ এ জড়াতে চাইছে। ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনের লিবারেশান আর্মির সঙ্গে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর কথাবার্তা চলছে। এমনকি পাকিস্তানের বর্ডার অ্যাকশন টিমের (ব্যাট) মাধ্যমে  ভারতে হামলা চালানোর পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। আর অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাশ্মীরের দিকে প্রচুর সংখ্যক জঙ্গি পাঠানো হচ্ছে।

জাতীয়তাবাদ কার্ডকে ব্যবহার করে দ্বিতীয়  মেয়াদে  ক্ষমতায় মোদী সরকার।  প্রতিআক্রমণ না করে কেবল আলোচনার মাধ্যমে সমাধা করা কারো কারো মতে পশ্চাৎপসারণ। মোদি ও তার সভাসদ আক্রমণাত্মক মানসিকতার আঁচ ছড়াতে চাইছে ঘরে ও বাইরে। তবে, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আগ্রাসী জাতীয়বাদের সঙ্গে সীমান্ত সংক্রান্ত কূটনীতিতে একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখানোর মতো বোকামি না করাটাই শ্রেয়তর বিকল্প।

২০১৩ সালে শি জিন পিং ক্ষমতায় আসেন মোদির এক বছর আগে। জিনপিং চীনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার আগে  জানুয়ারিতে তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছে লেখা এক চিঠিতে ভারতের সঙ্গে তার পূর্ববর্তী সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক ধরে রাখার ওপরই কেবল গুরুত্ব দেননি, তিনি ভারতের সঙ্গে সহজ ও আন্তরিক সম্পর্কের ইচ্ছার কথা জানান। এবং তার পূর্বসূরি হু জিনতাওয়ের দেয়া ‘পাঁচ দফা’ প্রস্তাব সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ওপরও জোর দেন তিনি। বোঝা যায় ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই ভারতের বিষয়ে ভালোই গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করে রেখেছিলেন শি।

বিশ্লেষকেরা বলেন, সম্প্রতি দুই দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, সেই বিষয়টি উভয় দেশের মধ্যে বিশেষত ‘সামরিক ও নিরাপত্তা আস্থা’ বাড়ানোর ওপর জিনপিংয়ের বিপরীতে মোদির আচরণ যথেষ্ট আপোসকামী ।  ‘সাম্প্রতিক সীমান্ত বিরোধ দুই দেশের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না’ চীনের তরফে এখন এ কথা বলা হলেও কূটনৈতিক সূত্রের মতে, রীতিমতো হিসাব কষেই সীমান্ত এলাকা অতিক্রম করেছিল চীনের সেনাবাহিনী। কারণ  চীন চায় দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মূল আলোচ্য হোক সীমান্ত সমস্যা। অন্যদিকে ভারত চায় বাণিজ্য অসাম্য দূর করে সমতা আনতে। 

চীন-ভারত এই টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধার কথা ঘোষণা করেছে চীন ।  বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া ৫ হাজার ১৬১টি পণ্যে শুল্ক না নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দুই বড় শক্তি প্রতিবেশীর মাঝে তার প্রভাব বলয় বাড়াতে সচেষ্ট, এরই অংশ চীনের এই বাণিজ্য ছাড়। 

অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা মালদ্বীপ থেকে ভারতের জন্য সুখবর নেই। নেপাল-ভুটান কোনো দেশের সঙ্গেই আর আগের উষ্ণতা নেই ভারতের। ভারতীয় কূটনীতিকদের ধারণা, এই পরিস্থিতি চীনের তৈরি। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ‘কৌশলগত অংশীদার’ এটি আমেরিকা ও ভারত উভয়ের প্রিয় বচন, চীনের এই হামলা এই ব্রান্ডিংকে এক কৌশলী মার।

কিছু অস্বস্তি আসলে চীনেরও আছে, করোনা ইস্যুতে আমেরিকা ও আরো কিছু দেশের দোষারোপ, বাণিজ্য বিরোধে কানাডা ও আমেরিকার যৌথ আঘাত। প্রবৃদ্ধির অবনমন। অন্যদিকে সামরিক ক্ষেত্রে মোড়লিপনা জারি রাখার বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সেই আমেরিকার নেতৃত্বে ভারতের সঙ্গে গাঁটছড়া যা চীনের প্রধানতম দুশ্চিন্তা। 

চীন-ভারত উভয়ের অভ্যন্তরীণ চাপ কি সীমান্তে হামলার মাধ্যমে হালকা করার চেষ্টা? তা পুরোপুরি না হলেও আলোচনার ভরকেন্দ্র তো বদল করা গেল।

বহিঃশক্তির হাতে দূরবর্তী দেশের ভূমি দখল, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়াবলীর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ, ভারসাম্যহীন বা একপেশে বাণিজ্য  বন্ধন অথবা বলপ্রয়োগ করে খনিজ সম্পদ লুণ্ঠন এসবই ছিল ক্লাসিক্যাল কলোনিয়ালিজমের বাঁধা  বৈশিষ্ট্য। যা শুরু হয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দীতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশীকরণ বিরোধী আন্দোলন বিকশিত হয় এশিয়া ও আফ্রিকায়; স্বাধীনতাকামী জনগণের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যার কবর রচিত হয় শেষ পর্যন্ত। সাবেক  ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাক স্ট্র যার সব নমুনাই দেখতে পান চীনের সাম্প্রতিক আচরণে । তিনি বলেন ‘আজ থেকে ১৫০ বছর আগে ব্রিটেন যেমন আচরণ করতো চীন আজ তার ভিন্ন কিছু করছে না। মূলত এশিয়ার এই অঞ্চলের শান্তি স্থিতি অনেকটাই নির্ভর করে চীনের আচরণ ও ভারতের প্রতিক্রিয়ার ওপর। বিষয়টার বিপ্রতীকতাও একইভাবে সত্য।

আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম  কোর্ট

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন