নির্বাচনের পরে দেশে নগদ টাকার চাহিদা বেড়েছে

ব্যাংক খাতের প্রতি জনগণের আস্থা ফেরানো ও শ্যাডো ইকোনমির নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক

ছবি : বণিক বার্তা

নির্বাচন কেন্দ্র করে সাধারণত দেশে নগদ টাকার চাহিদা বাড়ে। একদিকে প্রচারণা ও সংশ্লিষ্ট কারণে নগদ অর্থের প্রয়োজন হয়, অন্যদিকে নির্বাচন ঘিরে মানুষের মনে ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি হলে তারা ব্যাংকের আমানত ভেঙে হাতে নগদ অর্থপ্রবাহ বাড়ায়। তবে নির্বাচন শেষে আবার সে চাহিদা স্বাভাবিকভাবে কমেও আসে। কিন্তু এবার দেশের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের পর দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও কমেনি নগদ টাকার চাহিদা। উল্টো মানুষের মধ্যে নগদ টাকা ধরে রাখার প্রবণতা বেড়েছে। অর্থাৎ দেশের ব্যাংকগুলো থেকে নগদ টাকা তোলার চাপ আরো বেড়েছে। বণিক বার্তার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এ চাপ সামলাতে প্রতিনিয়ত ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ বাড়িয়ে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে ক্রমাগতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নোটের স্থিতি বাড়ছে। শুধু চলতি বছরের সাড়ে তিন মাসেই ছাপানো অর্থের স্থিতি ২৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা বেড়েছে। ইস্যুকৃত নোটের মধ্যে ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকারও বেশি আছে ব্যাংকের বাইরে। অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, কোনো দেশে দুর্নীতি বাড়লে ও ব্যাংক খাতে সুশাসন না থাকলে নগদ অর্থের প্রয়োজনীয়তা বাড়ে।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রতিবেদন ২০২৩-এর তথ্যানুসারে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১০তম, যা গতবার ছিল ১২তম। গত এক যুগের মধ্যে বাংলাদেশে দুর্নীতি এবার সবচেয়ে বেশি। এতে স্পষ্ট যে দেশের অর্থনীতিতেও নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ক্রমেই বাড়ছে। যার কারণে বেড়েছে কালো টাকার দৌরাত্ম্য। তাই এখানে নগদ অর্থের চাহিদাও বেশি। একদিকে সরকারি কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ প্রভাবশালীরা নগদ টাকা দিয়েই কোটি কোটি টাকার লেনদেন করে থাকেন। কেননা নগদ টাকার লেনদেনের কোনো প্রমাণ থাকে না। অন্যদিকে ব্যাংক খাতে বিরাজমান অস্থিরতা—ঋণখেলাপি, তারল্য সংকট, ব্যাংক একীভূতকরণ প্রভৃতি কারণে এ খাতের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। ফলে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকা রাখার চাহিদা বেড়েছে। উপরন্তু ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতিও নগদ অর্থের চাহিদা বাড়ার একটি কারণ হিসেবে যোগ হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, টানা ২৩ মাস ধরে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। যদিও অর্থনীতিবিদদের দাবি, দেশের প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার বিবিএসের তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ভোগ ব্যয় বেড়েছে এবং সঞ্চয় করার প্রবণতা আগের চেয়ে কমেছে। আবার বাড়তি ব্যয় মেটাতে সঞ্চয়ের ওপর চাপ বেড়েছে, ব্যাংক থেকে আমানত তুলে ফেলছে মানুষ।

বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অর্থবছরের শুরুতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। ঘোষিত মুদ্রানীতির প্রধান লক্ষ্যই ছিল বাজারে অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ। নীতি সুদহারসহ সব ধরনের সুদ অব্যাহতভাবে বাড়িয়েছে। এমনকি আমানত আকৃষ্ট করতে ঋণের পাশাপাশি আমানতের সুদও বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। তা সত্ত্বেও ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকার প্রবাহ বেড়েছে, যা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিবিরুদ্ধ। অর্থাৎ বাস্তবতা এই যে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থের প্রবাহ না কমানো গেলে মূল্যস্ফীতি কমানো বেশ দুঃসাধ্যকর। আর নগদ অর্থপ্রবাহ কমাতে কালো টাকার লাগাম টেনে ধরা যেমন জরুরি, তেমনি ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের আস্থা ফেরানো আবশ্যক। 

সারা বিশ্বে এখন কার্ড কিংবা প্লাস্টিক মানিতে লেনদেন বেড়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও মানুষ বাজার-সদাই করার ক্ষেত্রে ‘পেটিএম’ ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় নগদ অর্থের চাহিদা ব্যাপক। সরকার যেকোনো ডিজিটাল লেনদেনের ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ করায় সাধারণ মানুষ নগদ টাকায় কেনাকাটায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। গুটিকয়েক শপিং মল আর হোটেল-রেস্টুরেন্ট বাদ দিলে দেশের কোথাও ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবস্থা নেই। দোকানিরাও চান লেনদেন নগদে হোক। তাছাড়া ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ হস্তান্তর করলে তার ওপর শুল্ক দিতে হয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রতিটি লেনদেনে শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। এ কারণে সাধারণ মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে এবং নগদ লেনদেন করছে। পাশাপাশি অসাধু ব্যবসায়ী, অসৎ কর্মচারী এবং চোরাকারবারিরাও নগদ লেনদেনে আগ্রহী। এ কারণেও খোলাবাজারে বাড়ছে নগদ অর্থের প্রবাহ। ফলে হিসাববহির্ভূত অর্থনীতির আকারও বেড়ে চলেছে। অধিকন্তু নগদ অর্থ ঘরে রাখতে উচ্চ মূল্যের নোটের সহজলভ্যতা বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এর কারণ উচ্চ মূল্যের নোটের মাধ্যমে বেশি পরিমাণ টাকা সঞ্চয় করা সহজ হয়। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ছোট অংকের নোটের তুলনায় উচ্চ মূল্যের নোট বেশি ছাপিয়েছে, প্রায় ৯২ শতাংশই উচ্চ মূল্যের তথা ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোট। শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১ হাজার টাকার নোট ছাপিয়েছে ১৯ কোটি ৩৯ লাখেরও বেশি। বাজারে হাজার টাকার নোটের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত ৫০০ টাকার নোট ছিল মোট ইস্যুকৃত অর্থের ৩৮ শতাংশ। আর বাজারে ১ হাজার টাকার নোট ছিল মোট ইস্যুকৃত অর্থের ৫৪ শতাংশেরও বেশি। সব মিলিয়ে গত জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত ছাপানো টাকার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার ১৫৬ কোটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে উচ্চ মূল্যের নোট সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ঘরে রাখার প্রবণতা বাড়ছে। আবার ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থও কালো টাকা হিসেবে সিন্দুকে চলে যাচ্ছে। হুন্ডিসহ অবৈধ অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রেও ১ হাজার টাকার নোটই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। চাহিদা বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও উচ্চ মূল্যের নোট বেশি ইস্যু করছে। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে শ্যাডো ইকোনমি (ছায়া অর্থনীতি) মূল অর্থনীতির চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় শ্যাডো ইকোনমির নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক।

দেশের অর্থনীতির অর্ধেকের বেশি এখনো ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এ অবস্থায় সুদহার বাড়িয়ে কিংবা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে নগদ অর্থপ্রবাহ কমানো মুশকিল। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কালো টাকার দৌরাত্ম্য প্রতিনিয়ত বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের পর ঘুস-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি আরো বিস্তৃত হয়েছে। এসব দুর্নীতি ঠেকাতে না পারলে অবস্থা আরো বেগতিক হবে। এজন্য সরকারকে ও বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগী হতে হবে। বিশেষ করে ইস্যুকৃত নোটের অনুপাত সীমার মধ্যে রাখাও এ মুহূর্তে জরুরি। 

একটি দেশের অর্থনীতিতে কী পরিমাণ ইস্যুকৃত নোট থাকবে সেটির একটি আদর্শ অনুপাত রয়েছে। ২০২০ সালের আগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ইস্যুকৃত নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ব্যাপক মুদ্রার (ব্রড মানি) সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে কভিডসৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে এ অনুপাত কিছুটা বেড়ে যায়। তার পরও ২০২১ সালের জুনে ব্যাংকের বাইরে ছিল ব্যাপক মুদ্রার সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। কিন্তু গত বছরের জুনে এ অনুপাত ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ পর্যন্ত উঠে যায়। ডিসেম্বরে এসে এটি কিছুটা কমলেও তা প্রায় ১৫ শতাংশে রয়েছে। অথচ প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটায় এ অনুপাত আরো কম হওয়ার কথা ছিল।

প্রযুক্তির উৎকর্ষে এরই মধ্যে বহু দেশ বর্তমানে ক্যাশলেস সোসাইটিতে পরিণত হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে দেশেও ক্যাশলেস লেনদেনের প্রেক্ষাপট গড়ে তুলতে হবে। কেবল লেনদেনের সুবিধা হবে তা নয়, অর্থ পাচার ও ঘুস-দুর্নীতি অর্থাৎ কালো টাকার দৌরাত্ম্য কমাতে সহায়ক হবে এটি। ব্যাংক খাতকে আরো সুবিবেচক হিসেবে কাজ করতে হবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর হলে মানুষের আস্থা ফিরবে—এ প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন