বাংলাদেশে শেভরনের গ্যাসের মজুদ বেড়েছে ৪৮১ বিসিএফ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

দেশের জাতীয় গ্রিডে দৈনিক গ্যাস সরবরাহের ৪১ শতাংশ আসে বিবিয়ানা, জালালাবাদ ও মৌলভীবাজার গ্যাস ক্ষেত্র থেকে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি শেভরন পরিচালিত এ তিন গ্যাস ক্ষেত্রের প্রাক্কলিত মজুদ শেষ পর্যায়ে। মজুদ বাড়াতে প্রতিষ্ঠানটি কূপ খননসহ নানা সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। এতে মজুদ কতটুকু বেড়েছে, সে বিষয়ে শেভরন কিংবা পেট্রোবাংলার কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে সম্প্রতি শেভরন জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির ক্ষেত্রগুলোয় গ্যাসের মজুদ বেড়েছে প্রায় আধা ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। 

মার্কিন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে জমা দেয়া শেভরন করপোরেশনের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, রিজার্ভের ব্যবস্থাপনার ফলে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির আওতাধীন ক্ষেত্রে গ্যাসের মজুদ বেড়েছে ৪৮১ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। তবে কোন গ্যাস ক্ষেত্রে এ মজুদ কী পরিমাণে বেড়েছে, তা প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার একটি সূত্র জানিয়েছে, বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রে এ মজুদ বাড়ার সম্ভাবনা বেশি। 

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, বিবিয়ানা-২৭ নামে একটি কূপ খনন করেছে শেভরন। এর কাজ শুরু হয় গত বছর। সেখানে এ অগ্রগতি হতে পারে। আবার উৎপাদনে থাকা গ্যাস ক্ষেত্রে কারিগরি সক্ষমতা বাড়িয়েও মজুদ বাড়ানো হতে পারে।

বর্তমানে বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে দৈনিক ১ হাজার ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন হয়। মজুদ বেড়ে থাকলে একই হারে এখান থেকে আরো অন্তত এক বছর তিন মাসের বেশি সময় ধরে গ্যাস পাওয়া যাবে। যদিও গ্যাস ক্ষেত্রটির মেয়াদ নির্ভর করছে পেট্রোবাংলার চাহিদার ওপর।

বিবিয়ানায় মজুদ বাড়ার ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গত ৪ জানুয়ারি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘বিবিয়ানার নতুন কূপে আরো প্রায় এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ পাওয়া যেতে পারে।’

দেশের জ্বালানি খাতে ৩০ বছর ধরে কাজ করছে শেভরন। উৎপাদন সক্ষমতা ধরে রাখতে গ্যাস ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ করছে কোম্পানিটি। তবে সরবরাহকৃত গ্যাসের বিল না পাওয়ায় পেট্রোবাংলার কাছে তাদের বিপুল অর্থ পাওনা রয়েছে। এরই মধ্যে অর্থ না পেয়ে জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রে কম্প্রেসর স্থাপনের কাজ স্থগিত করেছে শেভরন। বিষয়টি তারা পেট্রোবাংলাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। কোম্পানিটি এ প্রথম বিল বকেয়ার কারণে কোনো প্রকল্প স্থগিত করল।

সিলেট অঞ্চলে কাজের পরিধি বাড়াতে ২০২২ সালের অক্টোবরে পেট্রোবাংলার সঙ্গে তিনটি চুক্তি করে শেভরন। চুক্তির আওতায় কোম্পানিটি বিবিয়ানায় নতুন জায়গা পায়। মৌলভীবাজার ও জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রের গ্যাস ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির মেয়াদও বাড়িয়ে নেয় কোম্পানিটি। বর্তমানে জালালাবাদ ও বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রের সঙ্গে চুক্তির সময়সীমা রয়েছে ২০৩৪ সাল পর্যন্ত। আর মৌলভীবাজার গ্যাস ক্ষেত্রের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে ২০৩৮ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে গত বছর বিবিয়ানায় মূল্যায়ন কূপ (বিবিয়ানা-২৭) খনন করে তারা। বর্তমানে এ কূপের ধারাবাহিক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

মার্কিন সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের জমা দেয়া প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে মন্তব্য দিতে রাজি হয়নি শেভরন। শেভরন বাংলাদেশের কমিউনিকেশন ম্যানেজার শেখ জাহিদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি পেট্রোবাংলার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে শেভরন বাংলাদেশ। শেভরন প্রায় ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে। এ দেশে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জনগণের কল্যাণে কাজ করতে পারায় শেভরন উচ্ছ্বসিত।’

শেভরনের দুটি গ্যাস ক্ষেত্রের প্রাক্কলিত মজুদ ফুরিয়ে গেলেও সবগুলোয় উৎপাদন আগের মতোই রয়েছে। বিশেষ করে বিবিয়ানা গ্যাস উত্তোলনে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। বর্তমানে গ্যাসের মজুদ শেষ হলেও তিনটি ফিল্ড থেকে দৈনিক গড়ে ১ হাজার ২৮৮ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এর মধ্যে বিবিয়ানা থেকে ১ হাজার ১৫ এমএমসিএফ, মৌলভীবাজার থেকে ১৬ এমএমসিএফ ও জালালাবাদ থেকে ১৫৭ এমএমসিএফ (২১ মে গ্যাস উত্তোলন প্রতিবেদন অনুসারে) গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে।

জ্বালানি বিভাগের হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, বিবিয়ানা, মৌলভীবাজার ও জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত মোট গ্যাস মজুদের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৬১২ বিসিএফ (২পি রিজার্ভ অনুসারে)। সংস্থাটির হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, আগের মজুদ প্রাক্কলন অনুযায়ী, বিবিয়ানা ও জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রে মজুদ শেষ। আর মৌলভীবাজারে গ্যাসের মজুদ জানুয়ারি পর্যন্ত ছিল ৭৭ বিসিএফ। যদিও এরই মধ্যে এ গ্যাস ফিল্ডের মজুদও কমে গেছে।

উত্তোলনের দিক থেকে বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস ক্ষেত্র বিবিয়ানা। দীর্ঘ সময় ধারাবাহিকভাবে উৎপাদনে থাকায় এর প্রাক্কলিত গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষেত্রটির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা হলে আরো মজুদ বাড়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রে উত্তোলনযোগ্য প্রকৃত মজুদ নির্ণয় ও নতুন করে কূপ খনন কার্যক্রম আরো জোরদার করা প্রয়োজন। গ্যাস ক্ষেত্রটির অনাবিষ্কৃত এলাকায় নতুন করে গ্যাসকূপ খনন করলে সেখানে আরো গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাসের প্রাথমিক মজুদ আবিষ্কারের পর এর হিসাব যে আরো বড় হবে না, তা বলা যাবে না। গ্যাস উত্তোলন শুরু হওয়ার আগে এক ধরনের হিসাব থাকতে পারে। উত্তোলন শুরু হওয়ার পর অন্য রকম হতে পারে। বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের মজুদ এখন বাড়ছে। অনুসন্ধানের বাইরে থাকা এলাকা নিয়ে এখন তারা কাজ করছে। ফলে নতুন গ্যাস মজুদও বেড়ে যেতে পারে। এটি গ্যাসের যেকোনো ফিল্ডের ক্ষেত্রে হতে পারে।’

প্রসঙ্গত, দেশে বর্তমানে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে ৩ হাজার ১১০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। যার মধ্যে শেভরনের তিনটি গ্যাস ফিল্ড সরবরাহ করছে ১ হাজার ২৮৮ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বাইরে আমদানি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ রয়েছে প্রায় ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। জাতীয় গ্রিডে বাকি গ্যাসের সরবরাহ করছে বাংলাদেশের স্থানীয় কোম্পানিগুলো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন