পুরো পৃথিবী এখন ডুব মেরে আছে। একটি ভাইরাস কীভাবে মানুষের জীবনযাত্রা, প্রকৃতি, সামাজিক ঘনিষ্ঠতা, পারস্পরিক সম্পর্ক ও মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে তা এ মহামারীতে উপলব্ধি করতে পারছে সবাই। তবে এর মাঝে একটি বড় পাওয়া হলো মানুষ প্রকৃতি ও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দিচ্ছে। ডুব দিয়ে থাকা মানবসমাজের নতুন এ দৃষ্টিভঙ্গি শিল্পীদেরও নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। রঙ-তুলির নিপুণতায় তারাও ফুটিয়ে তুলছেন মানবতাবোধ।
এমন মানবতাবোধের প্রেরণা থেকে দেশের নয়জন উদীয়মান শিল্পীর অংশগ্রহণে শুরু হয়েছে অনলাইনভিত্তিক মিনিয়েচার শিল্প প্রদর্শনী। শিল্পীরা এ প্রদর্শনীর নাম দিয়েছেন ‘ডুব’। বৈশ্বিক মহামারীর প্রকোপে বর্তমান পৃথিবীর মানুষের ডুব দিয়ে থাকা জীবনযাত্রা, প্রকৃতির জীব-বৈচিত্র্য প্রভৃতি বিষয় নিয়ে শিল্পীমনের উপলব্ধিগুলোকে শিল্পকর্মে রূপান্তরের প্রকাশেই প্রদর্শনীটির আয়োজন।
মানুষ সামাজিক প্রাণী, এ কথা কে অস্বীকার করতে পারে! কিন্তু মহামারীর কারণে ‘সামাজিক দূরত্ব’, ‘কোয়ারেন্টিন’-এর মতো শব্দগুলো এখন সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। হঠাৎ করেই মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অনাকাঙ্ক্ষিত ছুটির উদ্রেক হয়েছে। ফলে হতাশা, বিরক্তি, রাগ বা অভিমানের মতো বিষয়গুলোর উদ্রেক ঘটছে। জীবন সম্পর্কে নতুন কিছু উপলব্ধিও হয়েছে বটে। কেউ কেউ বাধ্য হয়েছে শহর ছেড়ে আবার নিজের গাঁয়ে ফিরে যেতে। কেউ কেউ নিজের বারান্দা বা ছাদটাকেই নতুন দুনিয়া হিসেবে আবিষ্কার করেছে। পালটে যাওয়া নিত্যদিনের কাজের তালিকা, স্বাভাবিক গতিময় জীবনের অনুপস্থিতি এবং প্রকৃতি ও তার মাহাত্ম্যকে নতুন করে দেখার বিষয়টিই অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের উৎসাহিত করেছে রঙ-তুলিতে ফুটিয়ে তোলার জন্য।
২৫ জুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু করে হয়েছে প্রদর্শনীটি। চলবে আগামী ৩ জুলাই পর্যন্ত। এমন উদ্যোগের মূল কারিগর হিসেবে আছেন তরুণ শিল্পী আজিজি ফাওমি খান। এটি তার প্রথম উদ্যোগ। আর প্রদর্শনীতে অংশ নেয়া শিল্পীরাও সবাই নবীন।
আয়োজক সূত্রে জানা যায়, ‘ডুব’-এর গল্পটা শুরু হয় জুনের প্রথম দিকেই। বিশ্ব পরিবেশ দিবসের ঠিক আগ মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েকজন শিল্পী আড্ডা দিচ্ছিলেন। আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল ‘কো-এক্সিস্ট্যান্স’
বা পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রজাতির জীবের একসঙ্গে বসবাস। কিন্তু সেই জীব সম্প্রদায়ের প্রায় এক বিলিয়ন প্রজাতির বিলুপ্তির কারণ মানুষ। ২০২০-এ যখন মহামারীর আবির্ভাব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল তখন অল্প সময়ের জন্য হলেও মানুষ কিন্তু বিলুপ্তির ভয় পেয়েছিল। মূলত এ বিষয়টিই শিল্পীদের বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে।
প্রদর্শনীর জন্য আঁকা কোনো ছবিই নিছক কল্পনা নয়। এ মহামারীর সময়ে শিল্পীরা নিজেদের উপলব্ধ ভাবনাগুলোকে নিজ নিজ পরিপ্রেক্ষিতে তুলে ধরেছেন। কয়েকজন শিল্পী কাজ করেছেন সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অসংগতিগুলো নিয়ে। শিল্পের মাধ্যম হিসেবে এসেছে বর্তমান সময়ের একটি জরুরি পণ্য সাবান। আবার অনেক শিল্পীর কাজে ব্যক্ত হয়েছে প্রকৃতি ও শান্ত জীবনের সরলতার আশাবাদ। কোনো শিল্পী মানুষের মনের গভীরে থাকা প্রকৃত সত্তার সন্ধান এবং ব্যাখ্যা করেছেন ছবিগুলোতে।
তবে শিল্পের বিভিন্ন দিক থাকতে মিনিয়েচার বিষয়টি কেন? এর উত্তরে আয়োজকরা জানান, যেহেতু সবাই এখন নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন, স্বাভাবিক সময়ের মতো গ্যালারিভিত্তিক শিল্পচর্চার সুযোগ কম। তাই মিনিয়েচারধর্মী কাজ বেছে নেয়া হয়েছে প্রদর্শনীর জন্য। যেন প্রত্যেক শিল্পী নিজেদের অবস্থানে থেকে স্থানস্বল্পতার মধ্যেই কাজ করতে পারেন। আর সামাজিক দূরত্ব ও অন্যান্য সতর্কতার বিষয়টি মাথায় রেখে অনলাইনে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী তরুণ শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন সারা হোসাইন, অন্তরা মেহরুখ আজাদ, অনন্যা মেহপার আজাদ, নুসরাত জাহান তিতলী, সারা জাবীন, আরজিনা আহসান, শিপ্রা রানী বিশ্বাস, তানিয়া রহমান রশ্নি ও শৈলী শ্রাবন্তী।
মানুষ যেকোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। আপত্কালীন সময়ে রুখে দাঁড়াতে পারে বলেই মানুষ টিকে আছে হাজার বছর ধরে। মহামারীর এমন রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এখন আমরা আবার ধীরে ধীরে ওপরের দিকে মাথা তুলছি। এমন সময়ে এ শিল্প প্রদর্শনীটির আয়োজন মূলত মানুষের মধ্যে আশার বাণী ছড়িয়ে দেয়া। প্রকৃতি ও মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা। হয়তো ইতিবাচকতা ও আশার প্রদীপই একদিন মানুষকে আরো পরিশীলিত ও সহানুভূতিশীল একটা পৃথিবীতে শ্বাস নেয়ার সুযোগ করে দেবে।