করোনাকালে অযত্ন-অবহেলায় দায়িত্বরত প্রবীণ পুলিশ সদস্যরা

নিহাল হাসনাইন

থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা মাথায় ধরে একবার রাস্তার এপারে, আরেকবার ওপারে ছুটছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এক পুলিশ কনস্টেবল। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যে এভাবেই রাজধানীর বিজয় সরণির ব্যস্ত সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। এভাবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীতে এমন প্রবীণ সদস্য রয়েছেন ২২ হাজারেরও বেশি।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমনিতেই মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। এর বিপরীতে বাড়তে থাকে দুর্বলতা। তাই নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চলাকালে প্রবীণদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সময় প্রবীণদের বাড়ির বাইরে যাওয়াই উচিত নয়। করোনার সংক্রমণ থেকে প্রবীণদের নিরাপদ রাখতে বাড়তি যত্নও নিতে হবে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমানে বাহিনীতে কর্মরত দুই লাখ পুলিশ সদস্যের মধ্যে ৫০-৫৯ বছর বয়সী রয়েছেন ২২ হাজার ৪১৩ জন। সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি পালনের মাধ্যমে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হচ্ছে। তবে প্রবীণ পুলিশ সদস্যদের বাড়তি যত্নে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো বিশেষ উদ্যোগ বাহিনীর পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি।

অন্য সব পেশার মতো পুলিশ বাহিনীতেও প্রবীণ সদস্যদের অনেকেই ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত। এর বাইরেও শুধু বয়সের কারণেই কভিড-১৯- সংক্রমিত হয়ে পড়ার পর শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ার, এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও রয়েছে প্রবীণ পুলিশ সদস্যদের।

মাঠ পর্যায়ে কর্মরত প্রবীণ পুলিশ সদস্যরা জানান, দৈনিক দুই শিফটে তাদের ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা ডিউটি করতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিশেষ ডিউটি যুক্ত হয়ে তা ২০ ঘণ্টাও হয়ে যায়। বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পালিত নিয়মিত দায়িত্বের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে কভিড-১৯ মোকাবেলায় গৃহীত নানা ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম। সব মিলিয়ে করোনার সময়ে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় ডিউটির চাপ বেশি বলে জানিয়েছেন প্রবীণ পুলিশ সদস্যরা।

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব মতে, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে প্রথম কভিড-১৯ শনাক্ত হয় গত ২৫ এপ্রিল। রোগে আক্রান্ত হয়ে কোনো পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর ঘটনা প্রথম ঘটে ২৮ এপ্রিল। পর্যন্ত সারা দেশে কভিড-১৯ আক্রান্ত পুলিশ সদস্যের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে একজন অতিরিক্ত ডিআইজি আটজন পুলিশ সুপার (এসপি) রয়েছেন। এছাড়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) পদমর্যাদার ১৯ জন, সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার ২০ ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার ৯৮ জন পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে অন্য সবাই এসআই, এএসআই কনস্টেবল পদমর্যাদার।

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় দেশজুড়ে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যেও দিন-রাত নিরলসভাবে কাজ করতে হয়েছে পুলিশ সদস্যদের। সংক্রমণ রোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, বিদেশফেরতদের হাতে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার অমোচনীয় সিল লাগানো এবং পরবর্তী সময়ে তাদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, এমনকি কভিড-১৯ আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির মরদেহ পরিবহন থেকে সত্কারের কাজ করতে হয়েছে তাদের।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, পর্যন্ত কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গিয়েছেন ২৪ জন পুলিশ সদস্য। এর মধ্যে ১৯ জনের বয়সই চল্লিশের ওপরে, যার মধ্যে পঞ্চাশ থেকে ষাটের ঘরে রয়েছেন আটজন। এর বাইরে আরো পাঁচজন পুলিশ সদস্য কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, যাদের বয়স চল্লিশের নিচে।

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকেও করোনাকালে প্রবীণদের বিশেষ যত্ন নেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে। সংস্থাটির মহাপরিচালক . টেড্রোস অ্যাডহ্যানম গেব্রেইয়েসুস বলেছেন, প্রবীণদের রক্ষায় আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে। তারা আমাদের পরিবার সমাজের মূল্যবান সদস্য। কভিড-১৯- আক্রান্ত হলে তাদের অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে, দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই করোনাকালে প্রবীণদের বিশেষ যত্ন নিতে হবে। 

বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) . বেনজীর আহমেদ করোনায় আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন। আইজিপির নির্দেশে অসুস্থ পুলিশ সদস্যদের দেখাশোনার জন্য বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল, বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতাল ছাড়াও রাজধানী এবং বিভাগীয় শহরে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বেসরকারি হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বণিক বার্তাকে বলেন, একক পেশা হিসেবে করোনায় সর্বোচ্চ আক্রান্ত বাংলাদেশ পুলিশ। তেমনি পুলিশে সুস্থ হয়ে ওঠার হারও কিন্তু অনেক বেশি। পর্যন্ত প্রায় ৪৮ শতাংশ পুলিশ সদস্য সুস্থ হয়ে পুনরায় দেশের সেবায় নিযুক্ত হয়েছেন। করোনাকালে যারা যত বেশি জনগণের কাছে গিয়ে সেবা দেবে, তাদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তত বেশি থাকে। করোনাযুদ্ধের শুরু থেকেই বাংলাদেশ পুলিশের দুই লাখের বেশি সদস্য মানুষের কাছে গিয়ে সেবা, সুরক্ষা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজ করে চলছে। কারণে পুলিশে সংক্রমণও তুলনামূলকভাবে বেশি হচ্ছে।

প্রবীণ পুলিশ সদস্যদের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, সরকার নির্দেশিত যেসব স্বাস্থ্যবিধি সুরক্ষার নির্দেশনা রয়েছে, আমাদের যারা প্রবীণ সদস্য রয়েছেন, তারা যাতে এগুলো যথাযথভাবে প্রতিপালন করেন। পাশাপাশি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাদের একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি নিজেদের সুরক্ষিত রাখার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন