করোনা দুর্যোগে মাছ চাষে উদ্ভুত সমস্যা

ড. হারুনুর রশীদ

সমগ্র পৃথিবী স্থবির, বাংলাদেশও তাই - স্থবির, স্তব্ধ। কিন্তু মানুষের খাদ্যের চাহিদায় বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই। চাল-ডালের পাশাপাশি চাহিদা আছে মাছ-মাংসেরও। মূলতঃ আমাদের প্রাণিজ আমিষের একটি বড় অংশের যোগানদার বাংলাদেশের মাৎস্য সম্পদ।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের সর্বমোট ৪২ দশমিক ৭৭ লাখ টন উৎপাদনের মধ্যে শুধু পুকুরে মাছ চাষ থেকেই এসেছে এর অর্ধেকেরও বেশি, প্রায় ২৪ লাখ টন। কৃষি জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান প্রায় ২৫ শতাংশ ; আর ৬৯ হাজার টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করে গত অর্থবছরে আয় হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। 

দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ, প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ, এখন মাছ চাষ এবং এই সম্পর্কিত ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ দেশের পুষ্টি নিরাপত্তা, জিডিপি, রফতানি আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মৎস্য তথা পুকুরে মাছ চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু করোনাভইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সারা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা থেকে মুক্ত নয় মাছ চাষ ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড।

এই সময়ে দেশের মাছ চাষ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা কোনো ধরনেরর সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে সে বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা পাওয়ার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মাছ চাষি ও মৎস্য হ্যাচারী মালিকদের মধ্যে একটি অনলাইন জরিপ চালানো হয়। সেই জরিপের ফলাফলের আলোকে কিছু আলোচনা নিম্নরূপ:

মাছ, খাদ্য, পোনা ও অন্যান্য উপকরণের পরিবহনই প্রধানতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অধিকাংশ মৎস্য উদ্যোক্তা। পরিবহন সঙ্কটের কারণে বিক্রয়যোগ্য মাছ বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না (২০.৭ শতাংশ ); মাছের খাদ্য, খাদ্যোপাদান, চুন, লবণের মত মাছ চাষের অবশ্যপ্রয়োজনীয় উপকরণের সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে (১৪.১ শতাংশ ); এবং মাছের পোনা পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে (৯.৮ শতাংশ )। অর্থাৎ জরিপে অংশগ্রহণকারীদের চিহ্নিত সমস্যার শতকরা প্রায় ৪৫ ভাগই পরিবহন প্রতিবন্ধকতার করণে হচ্ছে।

(১) পরিবহন সঙ্কটের কারণে বিক্রি বিঘ্নিত হওয়ায় পুকুরের মাছ পুকুরেই রেখে দিতে হচ্ছে। এতে করে চাষি চতুর্মুখী সঙ্কটে পড়ছেন- (ক) খামার থেকে মাছের বিক্রয়মূল্য ক্রমশ নিম্নমুখী, (খ) চাষি মূলধন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, (গ) মাছের খাবারের জন্য বাড়তি খরচ হচ্ছে, (ঘ) পুকুর খালি না হওয়ায় নতুন করে চাষ শুরু করা যাচ্ছেনা। 

মাছ বিক্রির এই সঙ্কট আবার প্রভাবিত করছে সংশ্লিষ্ট সরবরাহ ব্যবস্থাকে, যেমন- মাছের আড়তগুলো ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাছ/পোনা পরিববহনের জন্য ট্রাক-পিকআপ-মাইক্রোবাস রাস্তায় নামতে ভয় পাচ্ছে; কারণ ডেলিভারি দেয়ার পর খালি গাড়ি ফেরার পথে লকডাউনের কারণে নানাবিধ প্রশ্ন ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে, অনেক সময় জরিমানা গুণতে হচ্ছে।

(২) মাছ চাষের জন্য মাছের খাদ্য প্রধান উপকরণ। মাছকে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ না করলে বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এমনকি দিনের পর দিন অপর্যাপ্ত খাদ্য প্রয়োগ করলে একসময় মাছের ওজন হ্রাসও পেতে শুরু করে। ব্যাহত পরিবহন ব্যবস্থা বর্তমানে মাছের খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণের সরবরাহ বিঘ্নিত করছে। এতে করে বাড়তি দামে খাদ্য কিনেও অনেক চাষি তার কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হবেন।

(৩) এপ্রিল-মে মাস চাষের পুকুরে পোনা ছাড়ার উৎকৃষ্ট সময়। মার্চ-এপ্রিল মাসের মধ্যে চাষি আগের বছরে ছাড়া বাজারজাতযোগ্য মাছগুলো বিক্রি করে নতুন মৌসুমের জন্য পুকুর প্রস্তুত করে ফেলেন। কিন্তু নতুম মৌসুম শুরুর এই সময়ে মাছের হ্যাচারি/নার্সারি এবং মাছ চাষি উভয়ের জন্যই পোনা পরিবহন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পোনা উৎপাদন, প্যাকেজিং, বিক্রয় ও পরিবহন নিয়ে যখন হ্যাচারিগুলোর ব্যস্ততম সময় অতিবাহিত করার কথা তখন বেচা-বিক্রি একরকম নাই বললেই চলে। যৎসামন্য বিক্রি যা হচ্ছে তাও অত্যল্প মূল্যে ছেড়ে দিতে হ্যাচারিগুলো বাধ্য হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ হ্যাচারি তার উৎপাদন খরচই তুলতে পারবে কিনা সন্দেহ প্রকাশ করেছে।

(৪) সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার কারণে মাছ ও পোনার মূল্যহ্রাসের বিপরীতে দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণের দাম। লকডাইনের এই সময়ে একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মাছের খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণের দোকান। এমনকি বাড়তি বাজারমূল্য পরিশোধে করেও চাষির পক্ষে অনেক সময় মাছের খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণ জোগার করা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে চাষির হাতে নাই পর্যাপ্ত মূলধন। তাই পুকুরে মাছকে পর্যাপ্ত খাবার দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনেক খামারে পানির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে পুকুর ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও অষুধের অভাবে মাছ রোগাক্রান্ত হয়ে মার যাচ্ছে।

(৫) করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে খামারের অনেক কর্মচারী আর কাজে আসতে চাচ্ছে না। ফলে খামার/হ্যাচারি পরিচালনার জন্য শ্রম-সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। আবার যেসব কর্মচারী এখনো কাজ করছে তাদের বেতন পরিশোধ সম্ভব হচ্ছেনা মূলধন ঘাটতির কারণে।

এসব সমস্যার কারণে এদিকে যেমন মাছ চাষি, হ্যাচারি মালিকসহ মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের মৎস্য খাত। মাছ ও পোনা বিক্রয় বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এবং মূলধন ঘাটতির কারণে পুকুরে নতুন মাছ ছাড়ার এই মৌসুমে অধিকাংশ খামারিই মাছ ছাড়তে পারবে না বলে আশঙ্কা হচ্ছে। এতে করে দেশ মাছ চাষের প্রধান ফসলটি থেকে বঞ্চিত হতে পারে। মৎস্য চাষ থেকে বছরে ২৪-২৫ লাখ টন মাছ উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা তার অধিকাংশই অর্জিত হবে না বলে শঙ্কা হয়। সারা দেশে প্রাণিজ আমিষ সরবরাহে বড় আকারের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। 

বিগত মৌসুমের মাছ বিক্রি করতে না পারা এবং নতুন মৌসুমে চাষ শুরু করতে না পারার ক্ষতি সুদুরপ্রসারী হতে পারে; পর পর দু’টি ফসল বঞ্চিত/ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে চাষিরা যে ব্যাপক মূলধন ঘাটতিতে পড়বেন তাতে করে পরের বছর মাছ চাষ করা অনেক চাষির পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। ফলে পরের বছরও মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক ঘাটতির কারণে দেশে প্রাণিজ আমিষের সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। 

এত দুঃসংবাদের মধ্যে আশার আলো দেখাচ্ছে সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ঘোষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঁচ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম, যা করোনা সংকটে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের প্রান্তিকসহ সব খামারি, উৎপাদক, সরবরাহকারী এবং উদ্যোক্তাদের ঋণ গ্রহণের সুবিধার্থে প্রণযন করা হয়েছে। 

মৎস্য খাতের প্রকৃত উদ্যোক্তারা যদি দ্রুত এই অর্থায়ন পান তাইলে সঙ্কট উত্তরণে এটি একটি পাথেয় হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে পুনঃঅর্থায়নের এই স্কিমই একমাত্র সমাধান নয়।

লেখক: ড. হারুনুর রশীদ, অধ্যাপক, মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন