মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে অবৈধ প্রবাসীদের ফিরিয়ে নিতে চাপ বাড়ছে

শ্রম কূটনীতি জোরদার ও পুনর্বাসনে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হোক

দেশের জনশক্তি রফতানির সবচেয়ে বড় উৎস দেশগুলোর অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যের। গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যের জনশক্তি বাজারে শ্রম রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারের যুদ্ধে থাকা দেশগুলোর অধিকাংশই জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। করোনায় দেশগুলোয় আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও জ্বালানি তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি আবার সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এক্ষেত্রে তারা জনশক্তি আমদানি কমানোর পাশাপাশি অনেক প্রবাসী শ্রমিক ফেরত পাঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে। প্রায় ৪০ লাখ বাংলাদেশীর বাস মধ্যপ্রাচ্যে। এর মধ্যে ৭০-৭৫ শতাংশ বৈধ। কিন্তু করোনার কারণে অনেকে এখন কর্মহীন। বেকার জীবনে তারা অর্থ আর খাদ্যকষ্টে পড়ে গেছেন। অনেককে কোম্পানির কর্তারা ডেকে নিয়ে বাধ্যতামূলক ছুটিতে দেশে পাঠাতে চাইছে। এর মধ্যে গতকাল বণিক বার্তায় প্রতিবেদন প্রকাশ হলো, সৌদি আরব থেকেই ১০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশীর বিতাড়িত হওয়ার শঙ্কা। শুধু সৌদি আরব নয়, কাতার, ইরাক, বাহরাইনসহ উপসাগরীয় দেশগুলো অবৈধ শ্রমিকদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য প্রতিনিয়ত চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে। এরই মধ্যে কয়েকটি দেশ থেকে অবৈধ হয়ে পড়া বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় হিমশিম খাওয়া বাংলাদেশের পক্ষে মুহূর্তে এমন বার্তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। এটি আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করছেন বৈদেশিক শ্রমবাজার বিশেষজ্ঞরা। বিষয়ে সরকারের দ্বিপক্ষীয় তত্পরতা বাড়ানো উচিত। পাশাপাশি এসব বিষয় তুলে ধরতে হবে আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোয়।  

সেসব দেশে বৈধ অভিবাসীদের যখন এই হাল, তখন অবৈধদের তো রক্ষাই নেই। করোনা তাদের জন্য কাল হয়ে এসেছে। করোনাকালে বড্ড বিপদে আজ মধ্যপ্রাচ্যের কারাগারে থাকা বাংলাদেশীসহ বিদেশীরা। সর্বাগ্রে তাদের ওপর করোনার খড়্গ নেমে এসেছে। সুনির্দিষ্ট বা সুস্পষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে কূটনীতিকদের অনুমান ১১ দেশের কারাগার ডিটেনশন সেন্টার মিলে হাজতি বাংলাদেশীর সংখ্যা ৩০ হাজারের কম হবে না। করোনা আতঙ্কে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাদের নিজ নিজ কারাগার ডিটেনশন সেন্টার খালি করছে। সেই সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে তারা অপরাধীদের সাজার মেয়াদ কমিয়ে দ্রুত মুক্তি দিয়ে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গেলে শ্রমিকদের সরাসরি গমনও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রেমিট্যান্স আয়ের বৃহৎ ক্ষেত্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানিকে বিপন্ন করে তুলেছে কভিড-১৯। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বর্তমানে অন্তত ৪০ লাখ বাংলাদেশী বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। অভ্যন্তরীণ চলাচল সীমিত করে দেয়ার কারণে ব্যাঘাত ঘটছে তাদের পেশাগত জীবনযাত্রায়ও। অচিরেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে দেশের রেমিট্যান্স আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাপক হারে প্রবাসীরা আতঙ্কে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ভিসা জটিলতাসহ নানা কারণে প্রতিদিন ফেরত আসছেন প্রবাসীরা। তারা চাকরি ছাঁটাইয়ের আশঙ্কায় রয়েছেন। এতে ওইসব দেশ থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহে নেতিবাচক ধারা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে সৌদি আরব থেকে। দেশটিও করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসে। এখানেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ফলে এসব দেশে কর্মরত অনেক প্রবাসীই যেমন বাংলাদেশে চলে আসছেন, তেমনি দেশ থেকে নতুন করে ওইসব দেশে কোনো কর্মী যাচ্ছেন না। অবস্থা চলতে থাকলে রেমিট্যান্সপ্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। দেশের অর্থনীতির একমাত্র রেমিট্যান্স ছাড়া সব সূচকই নিম্নমুখী। এখন করোনার প্রভাবে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির হারও হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। তাই রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে নতুন শ্রমবাজারের দিকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি যেসব দেশে বাংলাদেশী শ্রমিক কর্মরত, তাদের দেখভালের ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে সরকারকে। বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য খাদ্য, চিকিৎসাসহ সামগ্রিক সুরক্ষায় সব ধরনের সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মানবিক বিবেচনায় কয়েকটি দেশ থেকে যাচাই-বাছাইসাপেক্ষে বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশী কর্মীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। যেসব দেশ প্রবাসীদের ফেরত পাঠাতে চাইছে, তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে সচেষ্টও হতে হবে। বিদেশফেরত কর্মীদের পুনর্বাসনের জন্য অর্থঋণ সহায়তা প্রদানে আলাদা ফান্ড গঠন করা যেতে পারে। সর্বোপরি আমাদের শ্রম কূটনীতি আরো সুসংহত করতে হবে।

প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ষায় সরকারকে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। যারা চাকরি হারিয়েছেন, তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা এবং সেখানে বৈধভাবে বসবাসকারীদের ফেরত না পাঠানোর জন্য লবিং জোরদার প্রয়োজন। যেসব বাংলাদেশী প্রবাসীর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে অথবা ইকামার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে, তাদের ভিসা/ইকামার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কোনো কর্মী বিদেশে চাকরিচ্যুত হলে অথবা নিয়োগকারী কোম্পানি যদি কর্মী ছাঁটাই করে, সেক্ষেত্রে তাদের দেশে না পাঠিয়ে সে দেশের অন্য কোনো কোম্পানিতে নিয়োগে লবিং করা যেতে পারে। একই সঙ্গে ফেরত আসাদের কীভাবে সহায়তা  দেয়া হবে, তারও একটি পরিকল্পনা থাকা আবশ্যক। মিসরও তাদের বিপুল শ্রমিক বিশেষত যাদের ওয়ার্ক পারমিট শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাদের ফেরত নিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ এখন অবৈধ অনেক বৈধ শ্রমিককে ফেরত পাঠাতে তত্পর। অবস্থায় বৈধদের সংশ্লিষ্ট দেশে রাখতে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি যাদের কাজের বৈধতার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে, সেগুলো নবায়ন করার উদ্যোগও নিতে হবে। অবৈধ এবং যাদের প্রবাসে আর থাকার সুযোগ নেই, তাদের ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করতে হবে। এজন্য প্রথমেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। দেশে ফেরত আসাদের স্বকর্মসংস্থানে নিয়োজনের লক্ষ্যে স্বল্প সুদে বা বিনা সুদে ঋণ দিতে পারে। ফেরত আসাদের অনেকেই বিভিন্ন ধরনের কাজে দক্ষতা অর্জন করে থাকবে। আমাদের প্রকল্পগুলোয় তাদের ব্যবহারের সুযোগ কিন্তু রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন