মার্চের ২৬ তারিখ থেকে সাধারণ ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের কল-কারখানাগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর চলতি মাসে মার্চের বেতন পরিশোধের সময় হলে শ্রমিকরা জানতে পারেন অনেক কারখানা লে-অফ বা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও আইন অনুসরণ করে মাত্র ৯৩৮ কারখানা লে-অফ করা হয়েছে বলে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে (ডিআইএফই) অবহিত করেছিলেন সংশ্লিষ্ট মালিকরা। তবে শেষ পর্যন্ত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে এ কারখানাগুলো লে-অফ হবে না সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিআইএফই।
ঢাকা মহানগরসহ দেশের ছয় শিল্প এলাকায় সব খাত মিলিয়ে কারখানা আছে সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে সাড়ে তিন হাজারের বেশি বস্ত্র ও পোশাক খাতের কারখানা। নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে অনেক কারখানাই লে-অফ ঘোষণা করেছিল। তবে আইন অনুসরণ করে মাত্র ৯৩৮ কারখানা লে-অফের বিষয়টি ডিআইএফইকে অবহিত করে, যার মধ্যে ৯৫ শতাংশই পোশাক খাতের কারখানা।
ডিআইএফই সূত্র বলছে, ৯৩৮ কারখানার ২০৭টি ঢাকা জেলার, ৫৩৬টি গাজীপুরে ও ৯১টি নারায়ণগঞ্জের। এছাড়া চট্টগ্রামের ২৮, নরসিংদীর দুই, মুন্সীগঞ্জের দুই, টাঙ্গাইলের আট, ময়মনসিংহের ৫৪, রংপুরের পাঁচ ও সিলেটের পাঁচটি। এ কারখানাগুলোর ৯৫ শতাংশই পোশাক খাতের কারখানা।
চলতি মাসে মার্চ মাসের বেতন পরিশোধের সময় থেকেই কারখানা লে-অফ, ছাঁটাই নিয়ে শ্রম পরিস্থিতি অস্থির হয়ে ওঠে। অবরুদ্ধ পরিস্থিতি ভেঙে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভও প্রদর্শন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কারখানা লে-অফ, শ্রমিক ছাঁটাইয়ের হালনাগাদ তালিকা করে ডিআইএফই। চলতি সপ্তাহে এমন ৯৩৮ কারখানার তথ্য প্রতিবেদন আকারে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে পাঠায় সংস্থাটি।
ডিআইএফই জানিয়েছে, শ্রম পরিস্থিতির জটিলতা নিরসনে অনুষ্ঠিত সভায় পোশাক কারখানাগুলোতে লে-অফ হবে না বলে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। শ্রম ভবনে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করে কারখানা বন্ধ থাকায় কাজ না করতে পারা শ্রমিক তার মোট মজুরির ৬০ শতাংশ পাবেন।
গতকাল অনুষ্ঠিত সভায় লে-অফ ঘোষিত ৯৩৮ কারখানার বিষয়ে কী হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে ডিআইএফই মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায় বলেন, মালিকরা ঘোষণা দিয়েছেন লে-অফ হবে না। আমরা ধরে নেব লে-অফ হয়নি। ২৮ এপ্রিল তারা সিদ্ধান্ত দিল লে-অফ হয়নি, আমরা করিনি। মিটিংয়ে মালিকপক্ষ থেকে এ সিদ্ধান্ত ছিল। আর শ্রমিকদের দাবি ছিল, ছাঁটাই করা চলবে না, লে-অফ করা চলবে না।
বেতনের বিষয়টিতে দুই পক্ষকেই খুশি করা গেছে জানিয়ে শিবনাথ রায় বণিক বার্তাকে বলেন, যারা কাজ করেনি তারা ৬০ শতাংশ পাবে। কারখানা বন্ধ বা লে-অফ কোনোটাই হবে না। শ্রমিক ছাঁটাইও হবে না। অর্থাৎ কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে যেসব কারখানা চালু রাখা সম্ভব হয়নি, সেসব কারখানার শ্রমিকদের ৬০ শতাংশ বেতন-ভাতা দেয়া হবে। আর যারা কাজ করেছেন, তারা ১০০ শতাংশ বেতন-ভাতা পাবেন। এ দুটোই মূল সিদ্ধান্ত।
পোশাক শিল্প মালিক সংগঠন বিজিএমইএর কাছে এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া চাইলে দাপ্তরিক সার্কুলার বা নোটিস পেলে এ সম্পর্কে মত জানানো সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
এদিকে ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় সভায় শ্রমিক নেতাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, অন্যায়-অযাচিতভাবে কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে, এটি বন্ধ করতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঈদের আগ পর্যন্ত আর ছাঁটাই হবে না বলে মালিক প্রতিনিধিরা অঙ্গীকার করেন। বৈঠকে মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সব শ্রমিকই আগে-পরে বেতন পাবেন। এপ্রিল মাসে লে-অফ ও বন্ধ থাকা কারখানার শ্রমিকদের মোট বেতন ৬০ ভাগ দেয়া হবে। আর এপ্রিল মাসে যেসব কারখানা যে কয়েকদিন চালু ছিল, সে ক’দিনের শতভাগ বেতন তারা পাবেন। মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোর ৬০ ভাগ বেতনও তাদের দেয়া হবে। গতকাল শ্রম প্রতিমন্ত্রী পোশাক খাতের অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন।
উল্লেখ্য, মার্চ মাসের বেতন চলতি মাসে পরিশোধ করার সময় হলে শ্রম পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে শুরু করে। গতকালও অনেক কারখানার শ্রমিকরা অসন্তোষ প্রকাশ করে রাস্তায় নেমেছেন। করোনা প্রাদুর্ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক কারখানায় এখনো মার্চ মাসের বেতন পরিশোধ হয়নি। শিল্প পুলিশের তথ্য বলছে, ৫৫৪টি কারখানার বেতন-ভাতা অপরিশোধিত ছিল। এর মধ্যে বিজিএমইএ সদস্য কারখানা ৯৭টি, বিকেএমইএর ৭২টি ও বিটিএমএর সদস্য কারখানা ২৫টি।
এদিকে ২৬ মার্চ থেকে বন্ধ হওয়া কারখানাগুলো গত ২৬ এপ্রিল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সচল হতে শুরু করেছে। একাধিক শ্রমিক কভিড-১৯ সংক্রমণের শিকার হওয়ার ঘটনাও ঘটতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতিতে সব খাত মিলিয়ে গতকাল মোট ২ হাজার ৩৫৬টি কারখানা খোলা ছিল বলে শিল্প পুলিশ জানিয়েছে। আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা ও ময়মনসিংহে খোলা কারখানাগুলোর মধ্যে বিজিএমইএ সদস্য কারখানা ৮১৭টি, বিকেএমইএর ২১৪টি ও বিটিএমএর ৮৫টি।
২৬ মার্চ থেকে সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণায় পর্যায়ক্রমে বন্ধের পর থেকে পোশাক কারখানা মালিকরা একের পর এক কারখানা লে-অফ করে আসছিলেন। বিজিএমইএ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ডিআইএফই সূত্র বলছে, প্রায় ৯০ ভাগ পোশাক কারখানাই লে-অফের কৌশল বেছে নিয়েছিল। আবার ঢালাওভাবে শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, শ্রম আইনের ১২ ও ১৬ অযৌক্তিকভাবে প্রয়োগ করে কারখানা মালিকরা শ্রম পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছিলেন।
শিল্প পুলিশের সূত্র বলছে, গতকাল বেতন-ভাতা সংক্রান্ত শ্রম অসন্তোষ হওয়া আশুলিয়ার কারখানাগুলোর মধ্যে আছে কেয়ারেল নিটিং লি., এ ওয়ান বিডি লিমিটেড, ওয়ান ওয়ার্ল্ড ডেনিম লিমিটেড, রাইজিং টেক্স ফ্যাশন লি., জিনিয়াস অ্যাপারেলস লিমিটেড। গাজীপুরের অসন্তোষ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে আছে ই ই প্রিন্টিং লিমিটেড, টেক্স টেক্স কোম্পানি লিমিটেড, বে ফুট লিমিটেড, ট্রাস্ট নিটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ। অসন্তোষ হওয়া চট্টগ্রামের কারখানাগুলোর মধ্যে আছে আলামিন গার্মেন্টস লিমিটেড ও মমতাজ ফ্যাশন লিমিটেড।
পোশাক শিল্পের মালিকরা সরকারের কোনো নির্দেশনাই মানছেন না—এমন অভিযোগ তুলে ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সাবেক মহাসচিব সালাউদ্দিন স্বপন বলেন, পোশাক শিল্পের অর্ধেক মালিকও যদি লে-অফ অব্যাহত রাখেন, তবে এক বছরের নিচের চাকরির বয়স এমন কয়েক লাখ শ্রমিক কোনোরকম বেতন-ভাতা পাবেন না, লে-অফ আইনে একটি টাকাও ক্ষতিপূরণ পাবেন না এ শ্রমিকরা। আবার যাদের চাকরির বয়স এক বছরের ওপরে, তাদের প্রাপ্ত বেতনও অর্ধেকের নিচে নেমে আসবে।