কৃষি

করোনাকালে শঙ্কিত বোরো মৌসুম

পাভেল পার্থ

করোনাকালে দুনিয়াজুড়ে যখন লকডাউন, থেমে নেই গ্রাম জনপদের কৃষিজীবন। পুরুষেরা জমিনে যাচ্ছেন, নারীরা মাচায় তুলে দিচ্ছেন লাউ-কুমড়োর লতা। এই তীব্র করোনা সংকটেও বোরো মৌসুমের ফসল তোলার জন্য দেশের গ্রাম জনপদ নিদারুণ শঙ্কা নিয়ে অপেক্ষা করছে। নিরাপদ সুরক্ষা বিধি মেনে কীভাবে বোরো মৌসুমের ফসল তোলা যাবে কৃষকের ঘর থেকে চাতাল, বাজার কি সরকারের গুদাম অবধি, এখনো এসবের কোনো প্রস্তুতি নেই। তাহলে কীভাবে আমরা সামাল দেব করোনার ক্রান্তিকাল? আশা করি কৃষি মন্ত্রণালয় বিষয়ে সজাগ এবং দ্রুত করোনাকালে বোরো মৌসুম ঘিরে কিছু বিশেষ সুরক্ষাবিধি প্রণোদনা গ্রামীণ কৃষকদের কাছে হাজির করবে।

. খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি বোরো মৌসুমে ছয় লাখ টন ধান, সাড়ে ১১ লাখ টন আতপ সিদ্ধ চাল এবং ৭৫ হাজার টন গম কিনবে সরকার। গ্রামাঞ্চলের একটি সাধারণ হিসাব হলো, এক বিঘা জমিনে প্রায় ২০ মণ ধান ফলে এবং এই ধান চারজন শ্রমিক মিলে একদিনে কাটতে পারেন। তারপর একদিন লাগে ধান মালিকের বাড়ি পরিবহনে। আরো একদিন লাগে ধান ঝাড়াই-মাড়াই করতে। এখন কিছু ধান কাটার মেশিন ধান মাড়াই-ঝাড়াই মেশিনের চল হয়েছে। দৈনিক একজন মানুষ প্রায় পাঁচ মণ ধান কাটলে সরকারের লাখ টন ধান জোগাতে প্রায় ৩২ লাখ মানুষ একদিনে দরকার। আর বোরো মৌসুমের সামগ্রিক ফলন হিসাব করলে এই সংখ্যা কত হতে পারে? কিন্তু এটি সম্ভব নয়। কারণ সব এলাকার জমিন, ফলনের পরিস্থিতি, কাজের ধরন, কৃষিবিন্যাস এমন নয় যে একদিনে সব ধান কাটা যাবে। ধান কাটতে মূলত কয়েকজন শ্রমিকের একটি দল কোনো গৃহস্থ বাড়িতে নিযুক্ত হয় এবং চুক্তিমতো সব ধান কেটে মজুরিসহ বিদায় নেয়। কিন্তু তার পরও বোরো মৌসুমের ধান কাটা থেকে সংগ্রহ, ঝাড়াই থেকে প্রক্রিয়াকরণ মজুদকরণে নানা বয়সী লিঙ্গের মানুষের সমাবেশ ঘটবে। করোনাকালে কৃষকের এই সমাবেশ কীভাবে সংক্রমণমুক্ত নিরাপদ হবে?

এলাকাভিত্তিক ধান কাটার সময়সূচি তৈরি

দেশের সব এলাকায় এমনকি একটি গ্রামেও একসঙ্গে ধান কাটা শুরু হওয়া সম্ভব নয়। কৃষি বিভাগের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে তার এলাকার সব বোরোচাষীদের তালিকা তৈরি করা যেতে পারে। কার জমিনের ফসল কখন কাটার উপযোগীএসব তথ্য নিয়ে এলাকার জন্য ধান কাটার একটি এলাকা পরিবারভিত্তিক সময়সূচি তৈরি করে এটি পাবলিক পরিসরে পূর্বাভাস হিসেবে জানানো যায়। তাহলে বোঝা যাবে কোন গ্রামে কোন পরিবারে কবে ধান কাটার তারিখ। সেই অনুযায়ী গ্রামীণ পরিবার শ্রমিকরাও সহজে সংযুক্ত হতে পারবে। আর কৃষক-শ্রমিকদের ভেতর চলমান সম্পর্কের ধরনকে কাজে লাগিয়ে করোনা সুরক্ষাকে মেনে কাজটির সমন্বয় করতে পারে কৃষি বিভাগ।

স্থানীয় শ্রমিক নিয়োগ মজুরি প্রণোদনা

এবার নানাভাবেই শ্রমিক সংকট দেখা দেবে। সংকটের ধরন কয়েক বছর ধরে চলা শ্রমিক সংকটের মতো হবে না। বৃহত্তর হাওড়াঞ্চলে ধান কাটতে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ আসতে পারছে না। আবার নিম্ন আয়ের দিনমজুর অনেকেই এখন শহরে ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। তার মানে মৌসুমে নানা জায়গায় গ্রামে কর্মহীন অনেক গরিব মানুষ। কর্মহীন মানুষদেরই এবারের বোরো মৌসুমে ধান কাটার ক্ষেত্রে আহ্বান জানিয়ে উৎসাহিত করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছা দক্ষতাকেও বিবেচনায় রাখা জরুরি। সংকটে মজুরি বিতর্ক আরেক সংকট তৈরি করবে। কোথাও সস্তায় শ্রম বেচবে অভাবী মানুষ আবার কোথাও হয়তো শ্রমিক সংকট দেখা দেবে। দেশব্যাপী একটি ন্যূনতম দৈনিক মজুরি এবার নির্ধারণ করা জরুরি। এছাড়া সংকটের কারণে অনেক গ্রামীণ কৃষিজীবী পরিবারের পক্ষে শ্রমিকের সব মজুরির সংকুলানও কঠিন হবে। সরকার এক্ষেত্রে ধান কাটা শ্রমিকের মজুরিটি প্রণোদনা হিসেবে নিশ্চিত করতে পারে।

নিশ্চিত হয়ে শ্রমিক নিয়োগ

বছর খুব হিসাব করে প্রতিটি কৃষক পরিবারকে শ্রমিক নিয়োগ করতে হবে। বিশেষ করে শ্রমিকের গত দুই মাসের পরিভ্রমণ সংস্পর্শের ইতিহাস জানা জরুরি। পাশাপাশি করোনার মতো কোনো উপসর্গ আছে কিনা, জেনে নেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে বহিরাগত শ্রমিকদের অনুৎসাহিত করাই জরুরি। কারণ বাইরে থেকে আসা সবাইকেই ১৪ দিন স্বেচ্ছা সঙ্গনিরোধ করা জরুরি। এই সংকট এড়াতে রাষ্ট্রকে স্থানীয় এলাকাতেই সব শ্রমিকের কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে হয়তো লকডাউন ভেঙে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শুধু ধান কাটার জন্য কৃষককে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যেতে হবে না। তার পরও যদি কোনো শ্রমিক ধান কাটতে কোনো এলাকায় চলে যান বা যারা স্থানীয়ভাবেও যাবেন, তাদেরকে কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পর ১৪ দিন নিজ বাড়িতে স্বেচ্ছায় সঙ্গনিরোধ করতে হবে। আর এক্ষেত্রে তাদের খাদ্যসহ জরুরি প্রয়োজনগুলো মেটাতে পারে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

শ্রমিকের করোনা নিরাপত্তা সুরক্ষা

বোরো মৌসুমে কর্মরত কৃষক-শ্রমিকদের জন্য ধানজমিন থেকে শুরু করে তাদের থাকার জায়গা অবধি সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেকর জন্য মাস্ক গামছা সরবরাহ করা যায়। কাস্তেসহ কৃষি সরঞ্জাম উপকরণগুলো ব্যবহারের আগে-পরে ভালোভাবে ধুয়ে রাখতে হবে। বিশেষভাবে হাওড়াঞ্চলে মৌসুমে শ্রমিকরা ধানের খলায় ভিন্ন ঘর বানিয়ে বসবাস করেন আবার অনেকে গৃহস্থ বাড়ির একটি আলাদা ঘরেও থাকার জায়গা পান। যদি কাজের প্রয়োজনে শ্রমিকদের গৃহস্থ বাড়িতে থাকতে হয়, তবে অবশ্যই সেখানে প্রত্যেকের বিছানা নিরাপদ দূরত্বে স্থাপন করতে হবে। প্রতিজন শ্রমিকের কাপড়চোপড় ব্যক্তিগত সরঞ্জাম নিজেরাই পরিচ্ছন্ন করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তাদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়। যে কাপড় পরে শ্রমিকরা সারা দিন কাজ করবেন, তা প্রতিদিন ধুয়ে দেয়া জরুরি। প্রশ্ন হলো, এসব নিরাপত্তাসামগ্রী দেশের সব গ্রামে কৃষক পরিবারের পক্ষে কীভাবে সরবরাহ করা সম্ভব? এসব নিরাপত্তা উপকরণও উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে সরকার তালিকা অনুযায়ী কৃষক পরিবারের ভেতর শ্রমিকদের জন্য বিতরণ করতে পারে। কাজ করতে গিয়ে যদি কোনো শ্রমিক সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন বা কারো যদি করোনার কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায়, তবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদসহ স্বাস্থ্য বিভাগকে দ্রুত তা জানাতে হবে। দরকার হলে হয়তো এমন ঘটনায় সেই এলাকায় স্থানীয়ভাবে লকডাউন সঙ্গনিরোধের ব্যবস্থা করতে হতে পারে। পাশাপাশি অসুস্থ শ্রমিকের সামগ্রিক চিকিৎসার দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করতে পারে।

জমিন থেকে সরাসরি ধান ক্রয়

জমিন থেকে ধান কাটার পর ধান পরিবহনে একেকটি ধানের বোঝা মাথায় তোলা, নামানো, একত্রীকরণ সব ক্ষেত্রেই নানাভাবে শারীরিক সংস্পর্শ এড়ানো অসম্ভব। তাই এই করোনাকালে কৃষকের জমিন থেকে সরাসরি সরকার ধান ক্রয় করতে পারে। এতে বিস্তার সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে। পাশাপাশি এটিও হিসাব করে দেখতে হবে এতে যেন কাজ কমে গিয়ে শ্রমিকের মজুরিতে কোনো সংকট তৈরি না হয়।

শ্রমিকদের নিরাপদ পরিবহন

স্থানীয়ভাবে শ্রমিক নিয়োগ হলেও একটি গ্রামে তো আর সবার জমিনের ধান কাটার জন্য একটি গ্রাম থেকেই শ্রমিকের সংকুলান হবে না। এক্ষেত্রে একটি জেলায়ও যদি হয়, তবুও শ্রমিকদের ধান কাটার কাজে পরিবহন জরুরি হবে। কিন্তু গণপরিবহনকে এই সময়ে নিরাপদ করার কায়দা কী? এক্ষেত্রে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদ কাজটি সমন্বয় করতে পারে। আগে উল্লিখিত এলাকা অনুযায়ী ধান কাটার সময়সূচি দেখে নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকদের এলাকার একটি নির্দিষ্ট স্থানে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে একত্র হওয়ার জন্য বলতে পারেন। শ্রমিকদের জন্য স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য কোনো গণপরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই পরিবহন জীবাণুনাশক দিয়ে স্প্রে করতে হবে। এই পরিবহন কৃষক-শ্রমিক ব্যতীত অন্য কেউ সময়ে ব্যবহার করতে পারবেন না। সরকার এই পরিবহন খরচটিও প্রণোদনা হিসেবে চিন্তা করতে পারে।

গ্রামীণ কৃষি পরিবারের সুরক্ষা

কৃষি শ্রমিক কেবল নয়, গ্রামীণ কৃষি পরিবারগুলো সবাইকেই সময়ে সুরক্ষা বিধিগুলো মেনে চলা জরুরি। এক্ষেত্রে ধান মাড়াই-ঝাড়াই থেকে বাড়ির পরিচ্ছন্নতা, ধান সিদ্ধ, রোদে দেয়া, মজুদকরণ নানা কাজে গ্রামীণ নারীর ব্যস্ততা সংস্পর্শ বাড়ে। তাই বাড়ির নারীসহ শিশুদের নিরাপদে রাখার জন্য স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা এই বোরো মৌসুমে কৃষক পরিবারগুলোকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে।

. এত কিছুর পরেও প্রশ্ন উঠতে পারে, তার পরও কি করোনার সংক্রমণ বিস্তার ঠেকানো সম্ভব? হয়তো নয়। কিন্তু সুরক্ষা বিধি মানলে হয়তো ঝুঁকিটা কম হবে, গ্রামীণ কৃষকসমাজ বিপদে কম পড়বে। কারণ কৃষকসমাজ সংক্রমিত হওয়া মানে চরম খাদ্য সংকট। আমরা এখনো জানি না চলতি বোরো মৌসুমে আমরা আমাদের সব ধান গোলায় তুলতে পারব কিনা! হাওড়ে আছে পাহাড়ি ঢলের শঙ্কা, উপকূলে আছে ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত। তার পরও আমাদের সম্মিলিতভাবে সামগ্রিক সমন্বয়ের মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সরকারের অনেক কিছুই আছে, কাঠামো, লোকবল কি নীতি। এই করোনাকালে দরকার নানামুখী বিশ্লেষণ, সমন্বয় এবং দায়িত্বশীল আচরণ। হাওড়সহ দেশের অনেক অঞ্চলে কোনো ধরনের সুরক্ষা বিধি ছাড়াই ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু বোরো মৌসুমের সামগ্রিক কাজকে সুরক্ষাবলয়ের আওতায় আনতে হবে। আশা করি কৃষি মন্ত্রণালয় দ্রুতই বোরো মৌসুমের জন্য সুরক্ষা বিধি তৈরি করবে এবং গ্রামীণ কৃষিজীবনকে নিরাপত্তাবলয়ে এনেই কৃষির বিকাশ অব্যাহত রাখবে।

 

পাভেল পার্থ: গবেষক

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন