আলোকপাত

কভিড-১৯-এ উপেক্ষিত জনস্বাস্থ্য

হুমায়ুন কবির

করোনা ঝড়ে কাঁপছে বিশ্ব। বিভিন্ন দেশে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যার সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। গোটা বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে নয় লাখ ছাড়িয়েছে এবং মৃত্যু দাঁড়িয়েছে ৪৯ হাজারের ওপরে। পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত বিশ্বায়িত দুনিয়ার সুবাদে কভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তার বিস্তার এখন বাংলাদেশের জন্যও কঠিন বাস্তবতা। মাসখানেক আগেও যে সমস্যাকে মনে করা হয়েছিল চীনের বা ইতালির, তা ভুল প্রমাণ হয়ে আমাদের সবাইকে সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে এই ভাইরাস। দেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্তের সংখ্যা ৫৬। আর মারা গেছে ছয়জন। তবে পরীক্ষার পরিধি সুবিধা বাড়ানো হলে আক্রান্তের সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সংগত কারণে দেশের পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দৃষ্টি এখন করোনাভাইরাসের দিকে। রোগ মহামারী আকারে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আগেই তা রোধ করতে এখন সর্বশক্তি নিয়োগ করা হচ্ছে। ফলে আমরা যে শিগগিরই আরো কিছু বড় স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হতে পারি কিংবা এরই মধ্যে হচ্ছি, সেটি অনেকটাই আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে।

মুর্হূতে উপেক্ষিত অন্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা ডেঙ্গু জ্বর। সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা তথ্যমতে, চলতি বছরের ১৮ মার্চ পর্যন্ত ২৬৩ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। গত বছরের একই সময়ে সংখ্যা ছিল ৭৩। অর্থাৎ গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় বছর রোগীর সংখ্যা দশমিক গুণ বেশি; যদিও এখনো ডেঙ্গু জ্বরে কেউ মারা যায়নি বলে আইইডিসারের ভাষ্যে উঠে এসেছে। তবে সত্য হলো, এরই মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের ব্যাপকতার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সুতরাং সমস্যাটিকে হেলায় নেয়ার সুযোগ নেই। ডেঙ্গু জ্বরে গত বছর বিপুলসংখ্যক মানুষকে ভুগতে হয়েছে। সরকারি হিসাবেই মারা গেছে ১৭৯ জন আর বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটি ছিল ৩০০। কেন গত বছর ডেঙ্গুর এমন প্রকোপ বেড়েছিল, তা খতিয়ে দেখতে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের গাফিলতি ছিল ডেঙ্গুর প্রকোপ এত বেশি হওয়ার একটি কারণ। আর বছর যখন ডেঙ্গুর মৌসুম (এপ্রিল-অক্টোবর) এগিয়ে আসছে, তখন দেখা দিয়েছে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। ফলে মহানগরের বিভিন্ন স্থান জীবাণুমুক্ত করার প্রচেষ্টার কারণে মশক নিধন কার্যক্রমে ভাটা পড়লে বছর ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কঠিন হয়ে পড়বে বৈকি।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন, বছরের ডেঙ্গুর প্রকোপ অন্য বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি হবে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য পূর্বাভাসের সত্যতা প্রমাণ করে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এডিস মশার ঘনত্ব পর্যবেক্ষণ করে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আগামী জুলাই-আগস্টে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়বে। তাই এডিস মশার বিস্তার রোধে আগাম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প নেই।

বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে গোটা দেশের সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে খবর পাওয়া যাচ্ছে যে করোনা আক্রান্ত নয়, নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা পাওয়া এখন অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চিকিৎসকদের মধ্যে করোনা থেকে সুরক্ষার বিষয়ে অসন্তোষ বিরাজ করছে। কয়েকজন চিকিৎসক এর মধ্যে রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে, আরো কয়েকজনকে কোয়ারেন্টিনে যেতে হয়েছে। সংক্রমণের হার বাড়তে থাকলে অনেক চিকিৎসককেই আইসোলেশনে যেতে হতে পারেন। সব মিলিয়ে স্বাভাবিক দৈনন্দিন চিকিৎসা কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা জোরদার হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির সমান্তরালে যদি ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়, তাহলে চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য সেটা হবে সাধ্যাতীত ব্যাপার। এক্ষেত্রে ডেঙ্গু প্রতিরোধ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু চিকিৎসা প্রটোকল তৈরি এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।

বেসামাল পরিস্থিতিতে পড়ার আগে এখন থেকেই ডেঙ্গু প্রতিরোধের লক্ষ্যে মশক নিধন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমসহ অন্যান্য কাজ শুরু করতে হবে। মূলত ডেঙ্গুর প্রাক?-মৌসুম হিসেবে মার্চ থেকেই যেসব কর্মসূচি পালন করার কথা, বছর সেগুলোর অধিকাংশই করা হয়নি। আর কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। শিগগিরই ডেঙ্গু প্রতিরোধের ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু করা প্রয়োজন। সুরক্ষাসামগ্রীতে সজ্জিত করে দেশের মহানগরের বিভিন্ন স্থান জীবাণুমুক্ত করার পাশাপাশি মশক নিধনের কার্যক্রম জোরদার করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে। বিশেষ করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি পাড়া-মহল্লার মানুষ, নাগরিক সমাজকে নিয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টিতে নানা উদ্যোগ নেয়া চাই। একটি দুর্যোগের ভয়ে অন্য সব জরুরি কার্যক্রম বন্ধ থাকবে, তা কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না।

এদিকে করোনাকালে পাহাড়ে হামের প্রাদুর্ভাব আরেকটি জনস্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, বান্দরবনের লামা খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পর্যন্ত নয়টি শিশু মারা গেছে। উল্লিখিত এলাকায় হামের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় এরই মধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কাপেং ফাউন্ডেশন নামে দুটি সংগঠন। প্রাকৃতিক মহামারী মাসখানেক আগেই পাহাড়ি এলাকায় দেখা দেয় এবং কমপক্ষে ৩০০টি শিশু আক্রান্ত হয় এবং নয়জনের প্রাণহানি ঘটে। অবস্থায় সেখানকার অধিবাসীরা চরম উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় দিন যাপন করছে এবং জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এটি নিঃসন্দেহে সে অঞ্চলের নাগরিক সুবিধা স্বাস্থ্যসেবার করুণ অবস্থাকেই প্রতিফলিত করে। ওইসব এলাকায় চলতি মাসে হামের টিকা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে তা স্থগিত করা হয়েছে। মূলত কারণে সেখানে হামের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।

করোনা মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সক্রিয়তা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু তাই বলে করোনার ডামাডোলে পার্বত্য অঞ্চলে হামের প্রাদুর্ভাব কর্তৃপক্ষের চোখের আড়ালে থাকবে, তা হতে পারে না। যথাযথ সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ নেয়া এবং সুনির্দিষ্ট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হলে এমনটি হতো না এবং এতগুলো প্রাণ ঝরত না। তা না করে নির্ধারিত কর্মসূচি স্থগিত করা ছিল অযৌক্তিক অবিবেচনাপ্রসূত। সুতরাং পাহাড়ে শিশুদের প্রাণহানির দায় কর্তৃপক্ষ কোনোভাবে এড়াতে পারে না। একবিংশ শতাব্দীতে হামে মৃত্যুবরণ কল্পনাতীত ব্যাপার। অথচ কর্তৃপক্ষের অবহেলায় পার্বত্য অঞ্চলে সেটিই ঘটছে। এখন আক্রান্ত রোগীদের বাঁচাতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আরো বেশি এগিয়ে আসা জরুরি। তাদের স্বাস্থ্যসেবা পুষ্টি নিশ্চিত করতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেও হাত বাড়ানো দরকার। করোনার সংকটে মানবিক সংকটটি যেন হারিয়ে না যায়।

সংগঠন দুটির পক্ষ থেকে হামের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে চার দফা সুপারিশ করা হয়। সেগুলো হলো মেডিকেল বোর্ড গঠন করে উপদ্রুত এলাকাগুলোয় সার্বক্ষণিক, নিরবচ্ছিন্ন পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, পাহাড়ে হাম উপদ্রুত এলাকায় জরুরি মানবিক সহায়তা নিশ্চিত, আক্রান্ত রোগীদের বিনা মূল্যে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ আশা করছি।

 

হুমায়ুন কবির: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন