আলোকচিত্রে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুঃখগাথা...

রুবেল পারভেজ

গতকালফ্ল্যাশ অন রোহিঙ্গা জেনোসাইডশীর্ষক একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী শুরু হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে

আর কোনো চাওয়া নেই, পৃথিবীর বুকে শুধু বেঁচে থাকার একটি মাত্র দাবিতেই যেন ব্যাকুল মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ। ভয়ংকর সীমান্ত আর উত্তাল সাগর পেরিয়ে দেশের বুকে আশ্রয় নেয়া এসব মানুষ কত দুঃসহ যন্ত্রণা, কষ্টকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকার লড়াই করছে, সে সম্পর্কে মুহূর্তে বিশ্বের সবাই কমবেশি জ্ঞাত। কিন্তু নিপীড়িত আর স্বজনহারা মানুষগুলোর ভেতরের দহন কজনইবা প্রত্যক্ষ করেছে একেবারে কাছ থেকে। তাদের জন্যই আলোকচিত্র এক বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। রকম বিষয় নিয়ে গতকালফ্ল্যাশ অন রোহিঙ্গা জেনোসাইডশীর্ষক একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী শুরু হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পোড় খাওয়া ক্ষতবিক্ষত হূদয়ের মানুষগুলোর অপ্রত্যাশিত এই পথচলা যাদের ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি হয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী আলোচনায় এসেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম আলোকচিত্রশিল্পী কে এম আসাদ। যিনি ২০১২ সাল থেকে ক্যামেরাবন্দি করছেন নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত মানুষের দুর্দশার চিত্র। গতকাল সকালে শিল্পকলায় শুরু হওয়া প্রদর্শনীর উদ্বোধনের পর টকিজের মুখোমুখি হন শিল্পী। আসাদ প্রদর্শনীর সমন্বয়কের দায়িত্বও পালন করছেন।


রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে আসাদ জানান, ২০০৫ সালে ফটোগ্রাফি শুরুর দুই বছরের মাথায় তিনি জানতে পারেন রোহিঙ্গা নামের একটি গোষ্ঠী মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ধীরে ধীরে তার কৌতূহল বাড়তে থাকে। তিনি ছুটে যান রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। যদিও প্রথমবার সেখানে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হন। এরপর ২০১২ সাল থেকে নিয়মিত শুরু করেন রোহিঙ্গাদের ছবি তোলার কাজ, যা চলছে আজ পর্যন্ত।

শিল্পকলায় শুরু হওয়া গতকালের আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া অথবা এর বাইরে আরো যত ছবি আসাদ তুলেছেন, সেগুলোর ভেতর এমন কোনো ছবি কি আছে, যা আজো তাকে বেদনার্ত করে তোলে? ‘২০১৬ সালের ঘটনা। সে সময় অবশ্য খুব বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গা আসেনি। নভেম্বরের দিকে হঠাৎ একদিন খবর পাই, মিয়ানমার থেকে লোকজন আসছে এবং তাদের মধ্যে একটি ছয় মাস বয়সী শিশু মারা গেছে।কথা চালিয়ে যান আসাদ,

আমরা গিয়ে দেখি সেই নিথর শিশুটিকে শেষবারের মতো গোসল করানো হচ্ছে। একপর্যায়ে শিশুটির মা এসে সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন। দৃশ্য আমাকে আজো তাড়িত করে, কষ্ট দেয়। সেদিন নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। আমি জানতে পারি, তীব্র বৃষ্টির মধ্যেও দীর্ঘ ২০টি দিন সন্তানকে বুকে আগলে হেঁটে এসে দেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন এই মা। অথচ আশ্রয় পেলেও তিনি হারিয়েছেন তার প্রিয় সন্তানকে।আসাদ প্রশ্ন তোলেন, ‘মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি এত কিছুর পরও কীভাবে বলেন, তার দেশে নৃশংসতার কোনো ঘটনা ঘটেনি? তাহলে আমাদের তোলা ছবিগুলো কি মিথ্যা?’

আলোকচিত্রী কে এম আসাদ, মোহাম্মদ হোসেইন অপু, সুমন পাল সালাউদ্দিন আহমেদের ২০১২ সাল থেকে তোলা ৫৭টি এবং বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাবিষয়ক মোট ১২০টি ছবি নিয়ে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রদর্শিত ছবিগুলোর প্রায় সবগুলোতেই দেশহারা নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আলোকচিত্র প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী . কে আব্দুল মোমেন। উদ্বোধনী আয়োজনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার আমাদের শত্রু নয়। আমরা প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাই। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি। চীনসহ সমর্থনকারী অন্য দেশগুলোকে নিয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার সরকারের প্রতি চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রদর্শনীর প্রতিটি ছবির মধ্যে রয়েছে শত শত গল্প। আলোকচিত্রের পাশাপাশি আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের রোহিঙ্গাদের নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুরোধ জানাই।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, এটা মানবতা, সভ্যতা এবং পৃথিবীর সবারই সমস্যা।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা ভবনের নং গ্যালারিতে সাত দিনব্যাপীফ্ল্যাশ অন রোহিঙ্গা জেনোসাইটশীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনীটি চলবে জানুয়ারি পর্যন্ত, যা সবার জন্য উন্মুক্ত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন