ফেনী নদীর পানি ব্যবহার চুক্তি প্রসঙ্গে

ম ইনামুল হক

ফেনী নদীর উৎপত্তি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গোমতী জেলা ও বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার ভগবানটিলার কাছে, দুই দেশের একটি অমীমাংসিত সীমান্ত এলাকা থেকে। ফেনী নদী উৎপন্ন হওয়ার পর দুই দেশের সীমানায় যাত্রাপথে বাংলাদেশের বড় মুড়া পাহাড় থেকে আসা অনেকগুলো ছড়ার সঙ্গে মিলিত হয়েছে ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মীরসরাই উপজেলার আমলিঘাটের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এর পর প্রায় ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে এ নদী বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

বাংলাদেশের ভগবানটিলার পশ্চিম প্রান্ত থেকে উৎপন্ন অনেকগুলো ছোট নদী যথা, আসালং, তাইলালং, গুমতি, অযোধ্যা, ধাইয়াছড়া, নলুয়া, কাইলা ইত্যাদি ফেনী নদীর বাম তীরে এসে পড়েছে। ফেনী নদীর ডান তীরে ভারত থেকে সাব্রুম, লুধুয়া, বেলোগা ইত্যাদি ছোট নদী এসে যোগ দিয়েছে। বড় নদীর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে গুইমারা এবং ভারত থেকে মনু এসে যোগ দিয়েছে। সাগরের দিকে পাড়ি দিতে ফেনী নদীর ডানতীরে মুহুরী ও সেলোনিয়া নদী এসে যোগ দেয়। সোনাগাজীর কাছে ফেনী নদীর ওপর একটি রেগুলেটর নির্মাণ করে এর উজানে সাগরের লোনা পানি ও জোয়ারের পানি প্রবেশ রোধ করা হয়েছে এবং তাতে একটি মিঠা পানির হ্রদ তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন ও সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ৫ অক্টোবর স্বাক্ষরিত এ সমঝোতায় ভারতকে ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি উত্তোলন করার অনুমতি দেয়া হয়। ফেনী নদীর ঐতিহাসিক ন্যূনতম প্রবাহ বা শীতকালে তলানিপ্রবাহ বা বেজ ফ্লো ১২০ কিউসেক। এ থেকে মাত্র ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি উত্তোলনের জন্য ভারতকে কেন চুক্তি করতে হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। এবং ১ দশমিক ৮২ কিউসেক নাকি ১ দশমিক ৮২ কিউমেক এ প্রশ্ন চলে আসে। ১ কিউমেক বা ১ কিউবিক মিটার প্রতি সেকেন্ড অর্থ প্রায় ৩৫ কিউবিক ফুট প্রতি সেকেন্ড। অতএব ১ দশমিক ৮২ কিউসেক না হয়ে ১ দশমিক ৮২ কিউমেক হলে তা অনেক।

আসলে ফেনী নদীর এ পানি উত্তোলনের বিষয়টি তিস্তা পানি ব্যবহার চুক্তির সঙ্গে ২০১১ সাল থেকে ঝুলে ছিল। বিগত ৭ সেপ্টেম্বর ২০১১ তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির সঙ্গে ওই চুক্তিও হওয়ার কথা ছিল। ওইদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে আসেন, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি না আসায় চুক্তি হয়নি। এখন ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম শহরে খাবার পানির সংকট মোকাবেলায় ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি উত্তোলনের ব্যাপারে ভারতের অনুরোধে বাংলাদেশ সম্মতি দিয়েছে। প্রতীয়মান হয় যে, এ উত্তোলন একটি প্রকল্প-সংক্রান্ত। এবং যেহেতু ফেনী নদী একটি যৌথ নদী তালিকাভুক্ত, সেহেতু এ নদী থেকে পানি উত্তোলনের ব্যাপারে দুই দেশের সমঝোতা থাকা প্রয়োজন। জানা যায়, গত আগস্টে দুই দেশের সচিব পর্যায়ের বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু তিস্তা নদীর পানি না পেয়ে ফেনী নদীর পানি দিয়ে দেয়ার চুক্তিটি বাংলাদেশের মানুষ সহজভাবে নিতে পারেনি।

ভারত এখন তিস্তা নদীর তলানিপ্রবাহের কোনো ভাগই বাংলাদেশকে দিতে চায় না। এবং ২০১২ সাল থেকে দিচ্ছেও না। ভারত লিংক খালের মাধ্যমে তিস্তার সমুদয় প্রবাহ মহানন্দা পেরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যার অনেকটা বিহারে চলে যাচ্ছে। যৌথ নদী কমিশনের ৩৭তম বৈঠকের পর আর কোনো বৈঠক হয়নি। আবার বিগত সেপ্টেম্বর ২০১১ তিস্তা নিয়ে যে চুক্তিটি সই হতে যাচ্ছিল, সে চুক্তির বিষয়গুলো নিয়ে নানা রহস্য আছে। মমতা ব্যানার্জি ওই চুক্তিকেলোক দেখানো বলেছিলেন এবং চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে সম্মত হননি। তারপর ওই চুক্তিটির ব্যাপারে মিডিয়ায় কয়েকটি ভাষ্য প্রকাশ হয়েছে, কোনটি যে সঠিক নিশ্চিত করে বলা যায় না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ফিরে যান। মমতা ব্যানার্জি ২০ ফেব্রুয়ারি সোনারগাঁও হোটেলে ভারত ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে একবৈঠকী বাংলা বা মতবিনিময় সভায় তিস্তা পানি বণ্টন নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে না বলেন। কিন্তু তিস্তার পানি ব্যবহার নিয়ে এখনো কোনো চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশের মানুষের মনে দুশ্চিন্তা রয়েই গেছে।

ফেনী নদীর ব্যাপারে স্থানীয় মানুষদের অভিযোগ হচ্ছে, ভারত কোনো চুক্তি ছাড়াই পাম্প বসিয়ে নদীর পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। রামগড়ে অবস্থিত ৪৩ বিজিবি ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক কর্নেল তারেহুল হাকিম বিবিসিকে বলেন, ফেনী নদীর সীমান্তে ৩৬টি পাম্প মেশিন বসিয়ে পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে ভারত। নো ম্যানস ল্যান্ড থেকে এগুলো সরিয়ে নিতে বিএসএফের সঙ্গে বৈঠকে বারবার বলা সত্ত্বেও এগুলো তুলে নেয়া হচ্ছে না। (সূত্র: কালের কণ্ঠ, ১১ অক্টোবর ২০১৯)। উল্লেখ্য, নদীতীরের এ পাম্পগুলো ২ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন। অতএব এদের মাধ্যমে ভারত প্রায় ৭০ কিউসেক পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, এ সীমান্তবর্তী নদীর পানি বিনা সমঝোতায় বা বিনা চুক্তিতে তুলে নিয়ে যাওয়া অবৈধ, যা উঠিয়ে দেয়ার ব্যাপারে বিজিবি কর্নেলের দাবি যুক্তিসংগত।

");

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন