কর সুবিধার অপব্যবহারে সৃষ্টি হচ্ছে বাজার ভারসাম্যহীনতা : করবৈষম্য দূরীকরণে বেজা আইনের সংশোধন জরুরি

অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়নবৈষম্য দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি বেগবান করতে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের একটি হলো অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা। মূলত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন, ২০১০-এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। এর অন্যতম লক্ষ্য অনগ্রসর অথচ সম্ভাবনাময় এমন এলাকার দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এজন্য কর সুবিধা দিয়ে শিল্পে বৈচিত্র্য আনার পাশাপাশি কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও রফতানি বৃদ্ধিতে উৎসাহ দেয়ার কথা বলা হয়েছে আইনে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, কর সুবিধার আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, শুল্ক-কর সুবিধা নিয়ে নিজস্ব অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন শিল্প নয়, প্রতিষ্ঠিত শিল্পই গড়ে তুলছে বড় শিল্প গ্রুপ। এ বাস্তবতায় বাজারে সংশ্লিষ্ট সুবিধার বিরূপ প্রভাব পড়ার দাবি ব্যবসায়ীদের। তাদের ভাষ্যানুযায়ী, এর আগে যেসব প্রতিষ্ঠান কর অবকাশ সুবিধা ভোগ করে ফেলেছে, সেই শিল্পগুলো পুনরায় অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প স্থাপনপূর্বক নতুন করে একই সুবিধা নিচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হচ্ছে। কর কাঠামোয় তৈরি হচ্ছে এক ধরনের দ্বৈত কর ব্যবস্থা। শুল্ক-কর সুবিধায় উৎপাদিত পণ্য তুলনামূলক কম দামে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে পারছে অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো, কিন্তু অধিক করের প্রভাবজনিত বাড়তি উৎপাদন ব্যয়ের কারণে অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে বেশি দামে। ফলে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। বাজারে সৃষ্টি হচ্ছে বড় শিল্প গ্রুপগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য। প্রতিযোগিতা আইনে বাজারে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টিকারী যেকোনো ধরনের তত্পরতা বন্ধের কথা বলা হয়েছে। সেদিক থেকে বিদ্যমান অবস্থা প্রতিযোগিতা আইনের সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ নয়। কাজেই বাজার অসংগতি ও করবৈষম্য দূরীকরণে সরকারের কার্যকর ব্যবস্থা কাম্য।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত বণিক বার্তার আরেক প্রতিবেদনে কর অবকাশ সুবিধা নিয়ে নিজস্ব অর্থনৈতিক অঞ্চলে দুটি বড় শিল্পের ভোগ্যপণ্য উৎপাদন করার বিষয় উঠে এসেছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের সনদ নিয়ে অঞ্চলের বাইরে তাদের অন্যান্য শিল্পেও একই সুবিধা নিচ্ছে বলে প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। একে অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত শিল্পে সরকারের দেয়া প্রণোদনার অপব্যবহার হিসেবে দেখছে সংস্থাটি। এতে বাজার ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে বলে ভাষ্য সংস্থাটির। এদিকে উদ্যোক্তারা বলছেন, কর অবকাশ সুবিধা নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল আইনের নেতিবাচক প্রভাব এখন নির্দিষ্ট কিছু ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে দেখা গেলেও ভবিষ্যতে রড-সিমেন্টের মতো পণ্যেও তা দেখা যাবে। কারণ একই দেশে দুই ধরনের কর কাঠামো থাকলে অবশ্যম্ভাবীভাবে বাজার বিকৃতি ঘটবে। ফলে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো ঘিরে ভবিষ্যতে বড় ধরনের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে বেজা আইনের পরিবর্তন জরুরি। বিশ্বের অনেক দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য আইন প্রণয়নের আগে বৈষম্যের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়। বিশেষ করে আলোচ্য অঞ্চলে দেয়া প্রণোদনা সুবিধা বাজারে প্রতিযোগিতা ব্যাহত এবং সার্বিকভাবে ব্যবসার ক্ষেত্রে বৈষম্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে কিনা, সেসব বিষয় গভীরভাবে আমলে নেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। দেশে সামগ্রিকভাবে বেজা আইন বিনিয়োগের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক হলেও আইনের ক্ষুদ্র অনেক বিষয়ের অসংগতিতে বাজারে বৈষম্যের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। বিদ্যমান অবস্থায় বড় শিল্প গ্রুপ লাভবান হচ্ছে এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা অর্থনৈতিক অঞ্চলে যারা নেই, তারা ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কাজেই এক্ষেত্রে বেজার উচিত হবে বিভিন্ন দেশে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর উত্তম চর্চা চিহ্নিত করে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনের সমন্বয় ঘটানো।

সন্দেহ নেই, সরকার পরিকল্পিত শিল্পায়নকে গুরুত্ব দিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। বড় শিল্পোদ্যোক্তাদের মতো সেখানে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও সুযোগ সমান। অথচ বড় শিল্প গ্রুপের কর প্রণোদনার অপব্যবহারের কারণে ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন। এটা প্রতিরোধ করা দরকার। মনে রাখা চাই, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোই আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। তাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বিবেচনায় আইনের কারণে বৈষম্যপূর্ণ পরিবেশ যেন সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বেজা আইন সংশোধন এখন সময়ের দাবি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন