সিল্করুট

বাংলার মহীপালকে পরাজিত করেছিলেন রাজেন্দ্র চোল

হোসাইন সুহি

মহীপালের মুদ্রা। ছবি: ক্লাসিক্যাল নুমিসম্যাটিক গ্রুপ, এলএলসি

দক্ষিণ ভারতে চোল সাম্রাজ্য ছিল সর্বাপেক্ষা দীর্ঘকালীন একটি সাম্রাজ্য। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে দক্ষিণ ভারতে বসবাস করে আসছে বলে ধারণা প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে লিখিত সম্রাট অশোকের শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো থেকেও চোল বংশ নিয়ে জানা যায়। দক্ষিণ ভারতের ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে ছিল এ রাজবংশের শাসন। নবম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত তারা জায়গা করে নিয়েছিল পরাশক্তি হিসেবে।

ধারণা করা হয় নবম শতাব্দী থেকেই চোলরা মূলত পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। আধিপত্য বিস্তার শুরু করে ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে। ইতিহাসে যখনই ভারতের কোনো সাম্রাজ্য নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে চেয়েছে, তারা অগ্রসর হয়েছে বাংলা দখলের জন্য। তাই দীর্ঘ শাসনামলে চোল সাম্রাজ্যকে বাংলার বিভিন্ন অংশ দখলে আগ্রহী হতে দেখা গেছে। নিজেদের স্বর্ণযুগে চোলরা সাম্রাজ্য আরো বিস্তৃত করার লক্ষ্যে এগিয়ে আসে বাংলার দিকেও। চোল সাম্রাজ্য যখন প্রথম রাজেন্দ্র চোলের শাসনে, তখনই বাংলা দখলের প্রচেষ্টা শুরু হয়। পিতা রাজরাজ চোলের মতোই তিনিও সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেছিলেন। ইতিহাসে চোল রাজা রাজেন্দ্রকে নিয়ে বলা হয়, আক্রমণাত্মক বিজয় অভিযান এবং রাজ্য বিস্তারের বিষয়ে তিনি তার পিতার নীতি অব্যাহত রেখেছেন সর্বদা। গঙ্গা নদীর উত্তর দিক থেকে মালদ্বীপ এবং শ্রীলংকা পর্যন্ত বিস্তৃতি ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলগুলোয় আক্রমণ চালিয়েছিলেন। 

সে সময়ে বাংলা পাল সাম্রাজ্যের অধীনে। পাল সাম্রাজ্যের একাদশতম শাসক প্রথম মহীপাল বাংলা শাসন করছেন। তার রাজত্বকালে ১০২১ থেকে ১০২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চোল রাজা প্রথম রাজেন্দ্র চোল কয়েকবার বাংলা আক্রমণ করেছিলেন। মূলত চালুক্য বংশের উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব ও সেখান বঙ্গরাজের সমর্থনই ছিল অভিযানের প্রধান কারণ। রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে তিনি একাধিক শাসককে পদানত করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেও জানা যায়। বাংলার বেশকিছু সম্পদ লুণ্ঠন করেছেন। 

রাজেন্দ্র চোল বাংলায় রণসুর ও গোবিন্দচন্দ্রকে পরাজিত করেছিলেন। এরা সম্ভবত পাল রাজবংশের প্রথম মহীপালের অধীন সামন্ত শাসক ছিলেন। প্রথম রাজেন্দ্র চোল প্রথম মহীপালকেও পরাজিত করেন এবং পাল রাজার থেকে ‘দুর্লভ শক্তির হস্তীবাহিনী, নারী ও সম্পত্তি’ লাভ করেন বলে জানা যায়। শিলালিপি থেকে আরো জানা যায়, প্রথম রাজেন্দ্র চোল উত্তর ভারতে সেনা অভিযান প্রেরণ করেন। তিনি সম্রাট প্রথম মহীপালকে পরাজিত করে গঙ্গা নদীর অববাহিকা পর্যন্ত চোল সাম্রাজ্য প্রসারিত করেছিলেন। ১০২৪ খ্রিস্টাব্দে গাঙ্গেয় এলাকা জয় করেন। তাই তার উপাধি গঙ্গাইকোণ্ডা (গাঙ্গেয় অঞ্চল বিজেতা)। 

সম্রাট রাজেন্দ্রের হাতে পরাজিত শাসকরা হলেন তণ্ডবুত্তি (দণ্ডভুক্তি: দাঁতন, মেদিনীপুর) তক্কনলাঢ়ম্‌ (দক্ষিণ রাঢ়), উত্তিরলাঢ়ম্‌ (উত্তর রাঢ়) এবং বঙ্গাল-এর (বরিশাল-ঢাকা-বিক্রমপুর, বাংলাদেশ) শাসকেরা। এদের মধ্যে পাল বংশীয় রাজা প্রথম মহীপাল তো ছিলেনই। তিনি কিন্তু সমগ্র বাংলার শাসক নন। অন্যদিকে বঙ্গালের শাসকও বাংলার একটি স্থানীয় শক্তি মাত্র। রাজেন্দ্র চোলও তাই বাংলা জয়ের কথা বলেন না। তিনি বরং গাঙ্গেয় এলাকায় সফল অভিযানের কৃতিত্ব দাবি করেন। কুমিল্লা জেলার বাঘাউড়া ও নারায়ণপুরে প্রাপ্ত দুটি লিপির সাক্ষ্যে অনেক ঐতিহাসিক প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন, দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায়ও মহীপাল সার্বভৌম ক্ষমতা বিস্তার করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে এ যুক্তি গ্রহণ করা বেশ কষ্টকর। কারণ দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার কুমিল্লা অঞ্চলে আবিষ্কৃত দুটি লিপি, যেখানে মহীপালের নাম উৎকীর্ণ, তা পরবর্তী সময়ে ওই অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়ে থাকতে পারে। তাই ওই অঞ্চলে মহীপালের শাসন সম্প্রসারণের প্রমাণ হিসেবে এটি গ্রহণযোগ্য নয়। গোবিন্দচন্দ্র ছিলেন মহীপালের সমসাময়িক। সে সময়ে রাজেন্দ্র চোলের সৈন্যবাহিনী গোবিন্দচন্দ্রকে বঙ্গালদেশে এবং মহীপালকে উত্তর রাঢ়ে পেয়েছে।

১০২১ থেকে ১০২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় রাজেন্দ্র চোলের অভিযান পরিচালনা সম্পর্কে তথ্যসংবলিত চোল লিপি (তিরুমুলাই লিপি) তৎকালীন বাংলার অবস্থার ওপর কিছু বিষয় আলোকপাত করে। লিপিটিতে বলা হয়েছে, ওড়িশা অভিযানের পর চোল সম্রাট ধর্মপালের (সম্ভবত কম্বোজ বংশীয় রাজা) ধ্বংস সাধন করে যেখানে রণসুরের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় এবং সেখানে পৌঁছেন। এরপর সৈন্যরা বঙ্গালদেশে পৌঁছে, যে দেশে একবার বৃষ্টি শুরু হলে আর থামে না। এমন তথ্যই উঠে এসেছে চোল লিপি থেকে। এ দেশের রাজা গোবিন্দচন্দ্র হাতির পিঠ থেকে নেমে দ্রুত পলায়ন করেন। উত্তর রাঢ়ে চোলরা মহীপালের সাক্ষাৎ পান। চোললিপির বর্ণনার ভিত্তিতে গোবিন্দচন্দ্র দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় এবং মহীপাল উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় রাজত্ব করতেন বলে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়।

হোসাইন সুহি: লেখক