সিল্করুট

তবকাত-ই-নাসিরী ও খলজিদের বাংলানামা

শহিদুল হাসান

বাংলায় বখতিয়ার খলজির দুই ধরনের মুদ্রা। সূত্র: সিএনজি কয়েনস

বরিশালে জন্ম নেয়া বিখ্যাত ইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরীর আত্মকথন ‘বাঙালনামা’র প্রতি ঋণ স্বীকার করেই এ নিবন্ধের শিরোনামে বাংলানামা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাস ও সভ্যতা বিষয়ের এ স্বনামখ্যাত অধ্যাপকের ধ্রুপদি গবেষণা, Bengal under Akbar and Jahangir: An Introductory Study in Social His tory গ্রন্থটি সুবা বাংলা বা মোগল আধিপত্যের সূত্র ধরে আকবর ও তদ্বীয় পুত্র জাহাঙ্গীরের আমলে ‘বাংলা’-(যেটি বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য)-দেশের সামাজিক পরিবর্তন, শ্রেণিকাঠামো ও গতিময়তার ইতিহাস। 

আকরসূত্র হিসেবে তিনি মোগল অ্যাডমিরাল মির্জা নাথানের রোজনামচা বাহারিস্তান-ই-গায়েবি ও সমকালীন দেশজ সাহিত্যকে ব্যবহার করেন। মোগলদের সর্বভারতীয় রাজনৈতিক শক্তির অভিঘাতে বাংলার ইতিহাসে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হয়। তবে এ পরিবর্তন বাংলার ইতিহাসে নতুন নয়। সুপ্রাচীন কাল থেকে বাংলা ও ভারতের ইতিহাসে এ ধরনের রাজনৈতিক অভিঘাত হয়েছে বারবার। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বর্তমান আফগানিস্তানের হেলমন্দ প্রদেশভুক্ত গরমশির (উত্তপ্ত অঞ্চল) এলাকাগত খলজিদের বাংলার উত্তর-পশ্চিম-এলাকায় রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এ ধরনের একটি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। বাংলায় খলজি মালিকদের (সামরিক নেতা) মধ্যে পাঁচজন নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন: (১) মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি, (২) মুহাম্মদ শিরান খলজি, (৩) আলি মর্দান খলজি ২৪), ইওয়াজ খলজি ও ইখতিয়ার উদ্দিন বলকা খলজি (সৈয়দ এজাজ হুসাইন, দ্য বেঙ্গল সালতানাত, পলিটিকস, ইকোনমি অ্যান্ড কয়েনস, এডি. ১২০৫-১৫৭৬, ২০০৩, পৃষ্ঠা: ১-৩৬)।

লেখমালা ও মুদ্রার বাইরে এ সময়ের রাজনৈতিক ঘটনার সবচেয়ে নিকটতম এবং বাংলার (উত্তর বাংলা ও বিশেষত লখনৌতি) জনজীবনের সঙ্গে পরিচিত ইতিহাসবিদ হলেন মিনহাজ-ই-সিরাজ। লিওপোল্ড ভন রÅvংকে কিংবা ইএইচ কারের বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস চর্চার আদালতে মিনহাজের তবকাত-ই-নাসিরীকে আধুনিক ইতিহাসতত্বের ধারায় হয়তো নানাভাবে প্রশ্ন করা যায়। সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে ইলম-উত-তারিখের (মুসলিম জ্ঞানজগতে ইতিহাসশাস্ত্রের নাম) মানদণ্ডে মিনহাজের তবকাতকে বিশ্ব ইতিহাস বা হালফিলের গ্লোবাল হিস্ট্রিজাত গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনায় নেয়া যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ওপরে বলা প্রথম চারজন খলজি মালিকদের ইতিহাস লিখনে তবকাত-ই-নাসিরীর গুরুত্ব মধ্যপর্বের ইতিহাস রচয়িতা অকপটে স্বীকার করেছেন। পূর্ববর্তী লেখকদের রচনার কিছু অংশ কর্জ করে পাঠকের দরবারে হাজির করাই এ লেখার উদ্দেশ্য।

দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের ইতিহাসে খলজি মালিকদের প্রথম জন ইবনে বখতিয়ার বা মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি মিনহাজের রচনায়, জনমানসে কিংবা পাঠ্যপুস্তকে বহুল উত্থাপিত ও আলোচিত। ফলে এ রচনায়ও সেটির প্রবণতা দেখা যাবে। তবে প্রসঙ্গক্রমে বাকিদের কথাও কিছুটা আসবে। বর্তমান লেখকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রে। এ বাস্তবতা বিবেচনায় এ লেখায় ইএইচ কারের নৈর্ব্যক্তিকতা বা ‘অবজেকটিভিটি’ ক্ষুণ্ণ হলে পাঠকের বিনয় ও মহত্ত্ব আমার একমাত্র আশ্রয়।

বিদ্যায়তনিক কাঠামোর বাইরে আকরসূত্র সন্ধানী ইতিহাসবিদ-প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক (পেশায় সরকারি কর্মকর্তা, নেশায় জ্ঞানসাধন) মান্যবর আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া মিনহাজের লেখা তবকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থের ২০, ২১ ও ২২ তবকাত বঙ্গানুবাদ করেছেন। গ্রন্থটির ‘হিন্দুস্তানের মুহজ্জিয়া সুলতানদের বিবরণ’ (তবকাত ২০, পৃষ্ঠা ১-৬৬) অংশে পঞ্চম শাসক হিসেবে—‘মালিক-উল-গাজী [ইখতিয়ার-উদ-দীন] মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি’-এর রাজনৈতিক ও সামরিক সাফল্য তুলে ধরা হয়েছে। মিনহাজের বর্ণনা থেকে বখতিয়ার খলজির পরিচয় জানা যায়:

[বিশ্বস্ত সূত্রে] এমন বর্ণনা আছে যে এই মোহাম্মদ বখতিয়ার ঘোর ও গরমসির রাজ্যের খলজি [সম্প্রদায়ের লোক] ছিলেন। তিনি একজন কর্মতৎপর, তড়িৎগতি সম্পন্ন, সাহসী, দুঃসাহসী, বিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নিজ গোত্র ছেড়ে গজনীর দিকে ও সুলতান মুইজ্জ-উদ-দীন এর রাজধানীতে উপস্থিত হন এবং [রাজকীয়] ‘দিওয়ান-ই-আরজ’-এ [উপস্থিত হলে] তাঁর খর্বাকৃতি দেখে দিওয়ান-ই-আরজের কর্মকর্তারা তাকে গ্রহণ করেননি। তিনি গজনী থেকে হিন্দুস্তানে গমন করেন। রাজধানী দিল্লীতে যখন তিনি পৌঁছেন একই কারণে দিওয়ান-ই-আরজে (এক কর্মকর্তার) দৃষ্টিতে তিনি কোন সৌন্দর্যের পরিচয় দিতে পারেননি এবং তিনি গৃহীত হননি। দিল্লী থেকে তিনি বদাউন গমন করেন। বদাউন এর জায়গীরদার সিপাহসালার হিজবর-উদ-দীন হোসেন আরনভ-এর নিকট গেলে (তার কাছ থেকে) তিনি নির্দিষ্ট বেতনের একটি চাকরী লাভ করেন। কিছুদিন পর তিনি আওধার (অযোধ্যর) মালিক হোসামউদ্দীন আখলাক-এর নিকট গমন করেন। তিনি অশ্ব ও উৎকৃষ্ট যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ করে কয়েকটি স্থানে খণ্ডযুদ্ধে) সাহসিকতার পরিচয় প্রদান করেন তখন ভগওয়াত ও ভিউইলী অঞ্চলের জায়গীর তাকে দেওয়া হয়। (আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া অনূদিত, পৃষ্ঠা ১৬-১৮)

উপর্যুক্ত অনুচ্ছেদদ্বয় থেকে বাংলার সম্পূর্ণ অংশ নয়, কেবল উত্তর-পশ্চিমের কিয়দংশে প্রথম মুসলিম শাসক বখতিয়ার খলজির প্রাথমিক জীবনের চ্যালেঞ্জ এবং ভাগ্যান্বেষে মধ্য এশিয়া, উত্তর ভারত, মধ্য ভারত হয়ে পূর্ব ভারতে আসার বিবরণ স্পষ্ট। মিনহাজ এর পরবর্তী অংশে এ খলজি যুবকের সামরিক বাহিনী গঠন এবং অর্থ জোগানের বিবরণ দেন। মিনহাজের মধ্যে ভগওয়াত ও ভিউইলীকে সামরিক কেন্দ্র বানিয়ে বখতিয়ার আশপাশের এলাকায় সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। ফলে- 

‘অনেক লুন্ঠিত দ্রব্য তিনি হস্তগত করেন এবং তাতে অশ্ব, যুদ্ধাস্ত্র ও সৈন্যসহ সম্পূর্ণ যুদ্ধোপকরণ তার অধিকারে আসে। তার বীরত্ব ও (অধিকৃত) লুন্ঠিত দ্রব্যের সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। হিন্দুস্তানের (বিভিন্ন স্থান থেকে) খলজি সম্প্রদায়ের লোক তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হয়।’ 

(পৃষ্ঠা ১৮)

মিনহাজের লেখনীতে বখতিয়ারের নদীয়া জয় এবং লখনৌতিতে রাজধানী স্থাপনের যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে তা ইতিহাসের সুবিদিত এবং বহু গ্রন্থে পুনরুৎপাদিত। রাজা লক্ষ্মণ সেনের জন্ম সম্পর্কে মিনহাজ কর্তৃক উপস্থাপিত কিংবদন্তি, লখনৌতি রাজ্যের সীমানা কিংবা নদীয়ার শনাক্তকরণ নিয়ে থাকা নানা মতপার্থক্য বাংলার ইতিহাস গ্রন্থগুলোয় নানাভাবে সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। ১৭ বা ১৮ জন ঘোড়সাওয়ার নিয়ে লক্ষ্মণ সেনকে পরাস্ত করার চটুল গল্প জনমুখে এবং কখনো কখনো ছাপার অক্ষরেও স্থান পেয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ দুর্গা চন্দ্র স্যানালের রচিত বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থ থেকে খলজি মালিক বখতিয়ারের সঙ্গে লক্ষ্মণ সেনের সামরিক উত্তেজনার অংশ নিচে তুলে দেয়া হলো:

‘বখতিয়ার অতি সহজেই মগধ রাজ্য অধিকার করলেন। তিনি শুনিলেন যে, পঞ্চরাজ্যের অধিপতি লক্ষ্মণ সেন নবদ্বীপে বাস করেন। এজন্য তিনি ঐ স্থানই রাজধানী বিবেচনায় তাহাই আক্রমণ করিতে চলিলেন। তিনি ভাগীরথীর পশ্চিম পারে জঙ্গলে সমস্ত সেনাসহ গোপন থাকিলেন এবং তাজীম খার অধীনে সতেরজন মাত্র অশ্বারোহী ছলপূর্বক তোরণদ্বার অধিকারের জন্য পাঠাইলেন। তাজীম প্রচার করিলেন যে, তাঁহার উপরিস্থ সেনাপতিসহ বিবাদ হওয়ায় তিনি গৌড়াধিপতির নিকট চাকরী প্রার্থনায় আসিয়াছেন।

তাজীম বিনা বাধায় গঙ্গাপার হইয়া রাজবাটীর তোরণদ্বারে প্রবেশ করিলেন। তথায় সৈন্য সামন্ত অল্প দেখিয়া হঠাৎ আক্রমণ দ্বারা রক্ষিগণকে নষ্ট করিয়া তোরণদ্বার অধিকার করিলেন। রাজভৃত্যেরা স্বল্পকাল মধ্যে তাহাদিগকে নিষ্কাশিত করিতে পারিল না। সংবাদ পাইয়া বখতিয়ার অবশিষ্ট সেনা লইয়া মুক্ত তোরণ দ্বার দিয়া রাজবাটীতে প্রবেশ করিলেন। লক্ষ্মণ সেনের যুদ্ধোপযোগী কোন আয়োজনই ছিল না। তাহার রাজধানী গৌড়নগর যবনেরা অধিকার করিবে জানিয়া তিনি রাজধানী ত্যাগ করিয়া দূরদেশে নবদ্বীপে বাস করিতেছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তাহাই প্রথম আক্রান্ত হইল। উপায়ান্তর না দেখিয়া তিনি দ্রুতগামী নৌকাযোগে ঐ জগন্নাথক্ষেত্র পলায়ন করিলেন। তথায় বন্ধুহীন অবস্থায় তিনি মনোদুঃখে গতাসু হন। ১৩১৭ বঙ্গাব্দ (পৃষ্ঠা-৪৪)

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ফারসি ভাষায় বাংলার ইতিহাস লেখেন গোলাম হুসেন সলীম। ১৭৮৪ সালে জজ উডনী মালদহের নিলকুঠীর সর্বাধ্যক্ষের দায়িত্ব পান এবং তার উৎসাহ-পৃষ্ঠপোষকতায় সলীম ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’ রচনা করেন। এই গ্রন্থের প্রথম বঙ্গানুবাদ করেন শ্রীরামপ্রাণ গুপ্ত। ইতিহাসগ্রন্থটিতে প্রদত্ত বখতিয়ার খলজির সঙ্গে গৌড়ের রাজা মহারাজাধিরাজ লক্ষ্মণ সেনের যুদ্ধের বর্ণনাটি পাঠককে বাংলায় খলজিদের ইতিহাসের বিবর্তনের বাঁক বদলগুলোকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে। শ্রীরামপ্রাণ গুপ্ত ১৩১২ বঙ্গাব্দে অনুবাদ করেছেন নিম্নোক্ত বাক্যসুতোয়—

‘...পর বৎসর বঙ্গদেশে আসিয়া নানা স্থানে থানা স্থাপন করিয়া রাজধানী নদীয়া আক্রমণের অভিপ্রায়ে যাত্রা করিলেন। এই সময় লখমনিয়া বঙ্গদেশে রাজত্ব করিতে ছিলেন। লখমনিয়া যখন আহার করিতেছিলেন, সেই সময় বখতিয়ার খলজি অষ্টাদশ অশ্বারোহি-সহিত হঠাৎ রাজধানীতে উপস্থিত হইলেন। রাজা যথোচিত সাবধান হইবার পূর্বেই বখতিয়ার বিদ্যুদ্বেগে রাজপুরে প্রবেশ করিয়া বহুলোকের জীবন বিনাশ করিলেন। বর্ষীয়ান রাজাও রাজ্যরক্ষার আশা পরিত্যাগ করিয়া অতিমাত্র ভয়-ব্যাকুল হৃদয়ে নগ্নপদে পুরীর পশ্চাৎদ্বার পথে বহির্গত হইয়া নৌকাযোগে কামরূপ অভিমুখে পলায়ন করিলেন। বখতিয়ারের অত্যাচারে নদীয়া বিধ্বস্ত হইল। অতঃপর বখতিয়ার বাঙ্গালার পূর্বতন রাজধানী লক্ষ্ণৌতির পুনঃসংস্কার করিয়া তথায় রাজধানী স্থাপনপূর্বক নিশ্চিন্তচিত্তে শাসনকার্য সম্পন্ন করিতে লাগিলেন। খোতবা ও শিক্কা সুলতান কুতব উদ্দীনের নামই প্রচারিত হইল। বখতিয়ার বঙ্গদেশে এসলাম ধর্ম্মের উন্নতিকল্পে যত্ন করিতে লাগিলেন। এই সময় হইতে বাঙ্গালাদেশ দিল্লীর অধিপতিগণের অধিকার ভুক্ত হইল।’

গোলাম হোসেনের শেষ অংশটুকু উপনিবেশিক জ্ঞান কাঠামোয় ‘other’ বা ‘অপর’-এর ব্যঞ্জনা বহন করে। স্মর্তব্য যে মোগলরাও কিন্তু বাংলাকে তাদের সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিল। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের বহুল আলোচিত পরিচয় বা ‘Identity’ ভাবনায় অপরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ধরা হয়। কিন্তু পাঠকের দরবারে ফুটনোটের মতো করে মনে করিয়ে দিতে চাই যে খলজিরা সেন বংশের শাসনকে সরিয়ে দিয়েছিল এটি যেমন ইতিহাসের সত্য বা রাজনৈতিক বাঁকবদল, তেমনিভাবে সেনদের তাম্রশাসনে উল্লেখিত আত্মপরিচয় বাচক ‘‌কর্ণাটদেশাগত’ প্রত্যয়টিও ইতিহাসের আকর। উনিশ-বিশ শতকীয় জাতিরাষ্ট্রে কাঠামোয় যে সীমানা তৈরি করেছে বা করছে, তার ভেতরে থেকে আট শতাব্দী কাল আগে লেখা মিনহাজের তবকাত-ই-নাসিরী হিন্দুস্তানের শাসন বদলের তারিখ (ইতিহাস অর্থে)। একই সঙ্গে এটি বাংলার রাজনৈতিক পরিবর্তনের একমাত্র সমসাময়িক লিখিত বিবরণ। রাজনৈতিক বদলে কোম্পানি শাসন এবং পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ রাজের অধীনে ভারতবর্ষ—বদলে দিয়েছিল সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনীতি। বদলেছে জ্ঞানচর্চার ধরনও। বদলেছে ইতিহাস চর্চা ও লেখনের কায়দা।

পাঠকের দরগায় মিনহাজের ভাষায় (আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার অনুবাদে) খলজিদের নদীয়া-গৌড় জয়ের কাহিনী তুলে ধরে এ লেখার সমাপ্তি টানতেছি- 

‘দ্বিতীয় বৎসরে মোহাম্মদ বখতিয়ার সৈন্য প্রস্তুত করলেন ও বিহার থেকে নির্গত হলেন। তিনি এমন অতর্কিতে (ও দ্রুতগতিতে) ‘‌‘‌নওদীয়াহ’’ সহরের দ্বারে উপস্থিত হলেন যে অষ্টাদশ অশ্বারোহীর অধিক তাঁর সঙ্গে ছিল না ও অবশিষ্ট সৈন্য তাঁর পশ্চাতে আসতেছিল।’

মোহাম্মদ বখতিয়ার যখন নগর দ্বারে উপস্থিত হলেন, তখন কাউকে তিনি কোনো উপদ্রব করেননি। তার শান্ত ও শিষ্টভাব দেখে কারো (মনে) এমন কোনো সন্দেহ হয়নি যে তিনিই মোহাম্মদ বখতিয়ার। বরং তাদের মনে সম্ভবত এমন কোনো ধারণা হয়েছিল যে (তারা) বণিক দল এবং মূল্যবান অশ্ব (বিক্রয়ের জন্য) এনেছেন।’ (এ ভাব তাদের মনের মধ্যে রইল) যে পর্যন্ত না (তিনি) লখমনিয়ার রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে অসি নিষ্কাশন করে আক্রমণ শুরু করলেন।

এ সময়ে রায় (লখমনিয়াহ) ভোজনে বসেছিলেন ও তার সম্মুখে স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত পাত্রে ভোজদ্রব্য পরিবেশিত ছিল। এমন সময় রায়ের প্রাসাদ ও নগরের মধ্য থেকে আর্তনাদ (তার কানে) এসে পৌঁছল। যখন তিনি প্রকৃত অবস্থা কী সে সম্পর্কে অবহিত হলেন, তখন মোহাম্মদ বখতিয়ার রাজপ্রাসাদ ও রাজ অন্তঃপুরে আক্রমণ শুরু করে দিয়েছেন এবং লোকদের তরবারির আঘাতে ধরাশায়ী করেছেন।

রায় নগ্নপদে পশ্চাৎদ্বার দিয়ে নিজ প্রাসাদ থেকে পলায়ন করেন ও তার সমুদয় ধনাগার, হেরেমের নারী, দাস-দাসি, (তার) ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও (পুর) নারী তার (মোহাম্মদ বখতিয়ারের) করতলগত হয় এবং তিনি অসংখ্য হস্তি অধিকার করেন। মুসলমান সৈন্যদের হস্তে এত লুণ্ঠিত দ্রব্য পতিত হয় যে তা বর্ণনা করা যায় না। যখন তার সমুদয় সৈন্য এসে পৌঁছাল, তখন তিনি সব নগর অধিকার করে সেখানে কিছুদিন অবস্থান করেন।

রায় লখমনিয়া সকোনাত ও বঙ্গ রাজ্যের দিকে পৌঁছে গেলেন। তিনি জীবনের শেষপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন (অর্থাৎ তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন)। তার বংশধররা এ সময় পর্যন্ত (মিনহাজ যখন লখনৌতি রাজ্যে) বঙ্গরাজ্য রাজত্ব করেছেন।’ (পৃষ্ঠা ২৬-২৮)

শহিদুল হাসান: সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়