বিশেষ সংখ্যা

ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্রটি বদরুদ্দীন উমর প্রথম প্রমাণ করেছেন

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ছবি : বণিক বার্তা

আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল মূলত একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। সাংস্কৃতিক তাৎপর্য অবশ্যই ছিল। বড় পরিসরেই সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ছিল। তার পরও এটা রাজনৈতিক আন্দোলন। সে সময়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আমাদের সে অভ্যুত্থানে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ কিংবা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ প্রত্যাখ্যাত হলো। বিপরীতে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে অবস্থান নিলাম আমরা। তারই প্রকাশ ঘটল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। আর পাকিস্তান যে একটা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র হবে, আরো স্পষ্ট করে বললে অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র, এ আন্দোলনেই সে সত্যটা উন্মোচন হয়ে যায়। যদিও এ সময়ে তা পরিপূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়নি। ক্রমাগতভাবে উন্মোচন হয়েছে পরবর্তী দিনগুলোয়। ১৯৬৯ সালের অভুত্থানে এটা প্রমাণ হয়েছে যে পাকিস্তান রাষ্ট্র আসলেই একটা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র। এখানে কয়েক পুঁজিপতি শোষণ করবে জনগণকে। আর সেই শোষণের বেশির ভাগ প্রভাব যাবে পূর্ববঙ্গে। বদরুদ্দীন উমর ঠিক এ দিকটা নিয়েই কাজ করলেন। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যে রাজনীতির যোগ আছে, সেটা তিনিই প্রথম লক্ষ করলেন। আর তিনিই প্রথম গবেষণা করে বিষয়টিকে সবার সামনে নিয়ে এলেন। 

ভাষা আন্দোলন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এ বিষয়ে যে জার্নালগুলো আছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, এখানে প্রত্যক্ষভাবেই রাজনীতি জড়িত ছিল। আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানুষের যে ক্ষোভ, সেটাই প্রকাশ হয়েছে। রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই ক্ষোভের প্রকাশ শুরু। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের এ রাজনৈতিক চরিত্র আরো শক্তিশালীরূপে ক্রমাগত প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। তারপর ’৭১ সালে আমাদের জনযুদ্ধ, গণহত্যা ও স্বাধীনতা লাভ। বদরুদ্দীন উমর এ দিকটায় প্রথম আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন এবং তিনি দেখালেন, এটা একটা রাজনৈতিক আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রকাশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। পূর্ববঙ্গের মানুষের মধ্যে যে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ গড়ে উঠেছিল, বিশেষ করে মেহনতি মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ গড়ে উঠেছিল, তা প্রকাশের একটা উপায় ছিল ভাষা আন্দোলন। এরপর আরো অনেকে লিখেছেন ভাষা আন্দোলন ও তার রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে। তবে তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন ও প্রমাণ করেছেন। এখানেই তার মৌলিকত্ব।

‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ বইটা যখন প্রকাশ হলো তখন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কারণ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কেবল মধ্যবিত্তের কোনো আন্দোলন নয়, বরং এটা খোদ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই একটা আন্দোলন। আন্দোলনের গভীরে সমস্ত জনগণের যে ক্ষোভ জড়িত আছে, সে বিষয়টির উদ্ঘাটন সত্যিকারভাবেই একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। আমি এ চাঞ্চল্যের দিকটাকেই গুরুত্ব দেব প্রভাবের চেয়ে। কারণ যখন এমন একটা বিষয় উন্মোচন হয়, স্বভাবতই তার প্রতিক্রিয়া হবে। মানুষ এদিকে তাকিয়েছে। ফলে তখন আর একে কেবল সাংস্কৃতিক আন্দোলন বলার সুযোগ থাকেনি। এটা যে একটা রাজনৈতিক আন্দোলন, সবাই তার স্বীকৃতি দিয়েছে, বলুক আর না বলুক। প্রকাশ্যে বলার দরকার হয়নি। উপলব্ধির মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ভাষা আন্দোলন একটি রাজনৈতিক ঘটনা ছিল।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক