বিশেষ সংখ্যা

বাঙালির ভাষা আন্দোলনের ব্যাকরণ

কাজল রশীদ শাহীন

ছবি : বণিক বার্তা

ভাষার অন্দরের ও বাইরের স্বরূপ জানতে ভাষার ভেতরের সাগঠনিকতা বুঝতে এবং ভাষার বিভিন্ন অংশের পারস্পরিক সম্পর্ক পরখ করতে যেমন ব্যাকরণ পাঠের কোনো বিকল্প নেই। ঠিক তেমনই বাঙালির ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর জানা-বোঝা-পরখ এবং গভীরভাবে উপলব্ধি করতে বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ বই পাঠেরও কোনো বিকল্প নেই। ভাষা নিয়ে অনেক ব্যাকরণ রচিত হয়েছে। পাণিনি, হ্যালহেড থেকে রামমোহন রায়, ঈশ্বররচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ পণ্ডিতজনেরা ব্যাকরণ বই লিখেছেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ব্যাকরণ বই লিখেছেন একজনই—তিনি বদরুদ্দীন উমর। আমরা স্মরণে রাখতে চাই ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন মনীষীজনের লেখা বইসমূহ। এসব বইয়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিশ্চয় রয়েছে, যা পাঠে আমরা এ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় জানতে ও বুঝতে পারি, এ কারণে অবশ্যই উনারা শ্রদ্ধেয় ও বরণীয়। কিন্তু এ কথাও আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই যে ভাষা আন্দোলন নিয়ে ব্যাকরণতুল্য বই হয়ে উঠেছে বদরুদ্দীন উমরের তিন খণ্ডের গ্রন্থ—‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও রাজনীতি’, যা বাঙালির ঘরে ঘরে অনিবার্য পাঠের দাবি রাখে। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতি ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতি রাজনীতির দ্বৈত কপটতায় এ বইয়ের যে পাঠ রাষ্ট্র ও সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার কথা—তার কোনোটাই করা হয়নি। এ বইকে আড়ালে রেখে কিংবা উপেক্ষা করে একুশের চেতনা আদতে কতটুকু ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব সে প্রশ্ন ওঠা জরুরি। কিন্তু এ জরুরি বিষয়ের কোনো আলাপ বা তর্ক জারি নেই আমাদের বৌদ্ধিকমহলের কোনো পর্যায়েই। এ অবস্থা যে একুশের চেতনার সঙ্গে যায় না। এবং একুশের তাৎপর্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তা নিয়েও জারি নেই কোনো বেদনা বা আক্ষেপ। 

বাহান্নর ভাষা আন্দোলন এ ভূখণ্ডের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যতীত, বাঙালি জাতির ইতিহাসে এর থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নেই। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনা এ জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে স্বাধীকারের মন্ত্রে। যার পথ ধরে সশস্ত্র এক স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এ কারণে ভাষা আন্দোলন ঐতিহাসিকভাবেই তাৎপর্যপূর্ণ এক ঘটনা। এ তাৎপর্যের অন্তর্নিহিত কারণ ও তাৎকালীন বাস্তবতা পরিষ্কারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে বদরুদ্দীন উমরের বই—‘পূর্ব ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’-তে। এখানে তিনি যেমন তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়েছেন, তেমনই বিশ্লেষণের প্রতিও সমান মনোযোগ রেখেছেন। ফলে এ বই তথ্য-তত্ত্ব, ব্যাখা-বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন ও প্রতিতুলনায় কেবল সময় ও ঘটনার বিশ্বস্ত দলিল হয়ে ওঠেনি। এর মধ্যে দিয়ে আগামীর দিকনির্দেশক ভূমিকাও হাজের-নাজেল রয়েছে। তিন খণ্ডের বইটি ভাষা আন্দোলনের ‘আকর গ্রন্থ’ বিশেষ। কেন আকর গ্রন্থ তা এ প্রসঙ্গে আলোকপাত করলেই পরিষ্কার হবে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। এখানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বতঃপ্রণোদিত। কোনো সন্দেহ নেই এ যুদ্ধে আমরা বহির্বিশ্বের সহযোগিতা পেয়েছি। প্রতিবেশী দেশ ভারত আমাদের বন্ধুর মতো করে পাশে থেকেছে। আমাদের রাজনীতিবিদ-অর্থনীতিবিদ-সংস্কৃতিজন-লেখক-কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকরা এ যুদ্ধকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সবার সব অবদানকে স্মরণে রেখেও এ কথা স্পষ্ট করেই বলতে হয় এ যুদ্ধ ছিল সাধারণ মানুষের যুদ্ধ। তাদের সম্মিলিত অংশগ্রহণে এ যুদ্ধে বাঙালির বিজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে, বাস্তবেও হয়েছেও তাই। এ প্রসঙ্গে যে কারো মনেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক ও সংগত যে সাধারণ বাঙালি দেশের জন্য যুদ্ধ করার এ মন্ত্র কোথা থেকে শিখল। এ দীক্ষা তাদের কে দিল, দেশের জন্য যুদ্ধ করতে হয়, জীবন উৎসর্গ করতে হয়। বাঙালির গায়ে তো এ তকমা বহুদিন আগেই সেঁটে দেয়া হয়েছে যে বাঙালি মাত্রই ‘ভীতু ও ভেতো’। তাহলে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বাঙালি কীভাবে-কী মনে করে-কোন অনুপ্রেরণায় সেদিন নিজেকে শত্রুর মুখোমুখি দাঁড় করার মহত্তম সাহস অর্জন করল? এ প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা সত্যিকারার্থে তালাশ করতে চাই, তাহলে আমাদের যেতে হবে বদরুদ্দীন উমরের তিন খণ্ডের বই—‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’-র কাছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা যে প্রসঙ্গে আছি, সে বিষয়ে আরো একটু খোলতাই করলে আমরা উপর্যুক্ত প্রশ্নের জুৎসই অর্থবহ উত্তর খুঁজে পাব।

বাঙালির যুদ্ধ জনযুদ্ধ এ কারণে যে এ যুদ্ধে কৃষক-মজুর-মুটে-কুলি-মাঝি-তাঁতি থেকে শুরু করে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধ তখনই গতি পায়—নিশ্চিত এক বিজয়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, যখন এ দেশের সাধারণ মানুষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক ব্যতীত, যারা যুদ্ধে যায় এবং যারা বায়সিক কিংবা বিভিন্ন কারণে যুদ্ধে যায় না প্রত্যেকেই যার যার অবস্থান থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বিবিধ ভূমিকায় অংশ নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়ে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং শত্রু মোকাবেলায় প্রতিরোধ-সংগ্রাম গড়ে তোলে। শত্রু নিধনে সেদিন এক-একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠেন সংশপ্তকতুল্য। এরা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি গেরিলা অপারেশনেও বীরত্বসূচক ভূমিকা রাখে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা এবং নিয়মিত বাহিনীগুলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলায় একের পর এক সাফল্য অর্জন করে। ফলে নয় মাসের মধ্যেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জন সম্ভব হয়। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মর্যাদায় আত্মপ্রকাশ করে।

সেদিন বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল অভাবিত ও অভূতপূর্ব এক ঘটনা। তখন পাকিস্তান ছিল সমরশক্তিতে বিশ্বের প্রথম সারির দশটি দেশের মধ্যে একটি। ওদের পাশে ছিল আমেরিকা, চীনের মতো শক্তিধর রাষ্ট্র। তার পরও বাংলাদেশ সেদিন আকাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত বিজয় অর্জন করেছিল। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে সবার থেকে উল্লেখযোগ্য কারণ এ যুদ্ধে সাধারণ মানুষের যুক্ত হওয়া। যাতে প্রতীয়মান হয় যে বাংলার সমাজ সেদিন জেগে উঠেছিল আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তারা সেদিন বুঝেছিল এ লড়াই ন্যায্য ও ন্যায়সংগত, যেমনটা বুঝেছিল ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। ফলে একাত্তরের যুদ্ধ শেষাবধি দাঁড়িয়েছিল সামরিক শক্তির সঙ্গে সামাজিক শক্তির লড়াইয়ে। এ কথা তো সত্যি, কোনো সমাজ যখন জেগে ওঠে তখন তার সামনে বিপক্ষের কোনো শক্তিই দাঁড়াতে পারে না।

এখন আমাদের এ উত্তর অন্বেষণ করা জরুরি যে বাংলার সমাজ সেদিন কেন জেগে উঠেছিল-জেগে ওঠার শক্তি সে কোথা থেকে পেয়েছিল?

এ লেখার শুরুতেই আমরা বলেছিলাম, বাঙালি জাতির ইতিহাসের মহত্তম ঘটনা হলো বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত পূর্বাপর ঘটনাবলি। কারণ ভাষা আন্দোলন ছিল সেদিনের পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে আত্মসম্মান বা আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই। বাঙালি এ লড়াইকে কেন্দ্র করে জেনেছিল তাদেরও রয়েছে ন্যায়সংগত দাবি প্রতিষ্ঠার অধিকার। ন্যায্যতা প্রাপ্তির লক্ষ্যে প্রয়োজনে যে জীবনও দিতে হয় এবং এ জীবনদান যে গৌরবের—সে দীক্ষা তারা পেয়েছিল ভাষা আন্দোলন থেকে। এ দীক্ষার বিস্তার ঘটেছিল সারা দেশে, টেকনাফ থেকে তেতুঁলিয়ায়। ভাষা আন্দোলন প্রমাণ করেছিল বাঙালিকে ‘ভীতু ও ভেতো’ বলা যৌক্তিক নয়। এটা বাঙালির ওপর আরোপিত এক মিথ্যা।

এ কারণে বাঙালির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব চিরকালীন এক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারণ এ আন্দোলনের ভেতর দিয়েই বাঙালি তার ওপর প্রবহমান হাজার বছরের অন্যায়-অবিচার-নিগ্রহ-নির্যাতন-বৈষম্য ও ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির জুৎসই জবাব দিয়েছে। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ও ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর ঘটনায় বাঙালির যে রূপ উন্মোচিত হয়েছিল তাকে যদি কোনো তুলনায় আনতে হয়, তবে সেটাকে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির জেগে ওঠার সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে। বাঙালির এ নতুন রূপকে নবজাগরণ বলাই যৌক্তিক। সেদিন এ ভূখণ্ডে নবজাগরণ সংঘটিত হয়েছিল বলেই ইহজাগতিকতার প্রতি ব্যক্তির যে পক্ষপাত—বাঙালি তার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটিয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। বাঙালির এ নবজাগরণ বুঝতে হলে বদরুদ্দীন উমরের ভাষা আন্দোলনের ব্যাকরণ হিসেবে বিবেচ্য এ বই পাঠ করা জরুরি। এ বই বাংলা ভাষাভাষী মাত্রই সব বাঙালির কাছে সম্পত্তি নয়, অমূল্য এক সম্পদ। কারণ এখানে ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে বাঙালির জেগে ওঠার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস উপস্থাপিত হয়েছে।

এখন আমাদের খোলতাই করা দরকার যে কেন ওই বইকে ভাষা আন্দোলনের ব্যাকরণ বলে অভিহিত করছি। ওই সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা বিষয়টা সম্পর্কে অবহিত বলেই মনে করি। যারা অবহিত নন। তাদের জন্য বই তিনটার ভেতর থেকে প্রথম খণ্ডের সূচিটা এখানে তুলে ধরা হলো। যার মধ্য দিয়ে পুরো তিন খণ্ডের বই উমর কী সম্পদ হাজির করেছেন তার একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে।

প্রথম পরিচ্ছেদের নাম: সূত্রপাত। এর উপশিরোনাম হলো—০১. গণ-আজাদী লীগ, ০২. ডক্টর শহীদুল্লাহর অভিমত, ০৩. গণতান্ত্রিক যুবলীগ, ০৪. তমদ্দুন মজলিশের প্রাথমিক উদ্যোগ, ০৫. ভাষার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রথম সভা, ০৬. করাচির শিক্ষা সম্মেলন, ০৭. দুর্বৃত্তদের হামলা, ০৮. উর্দু সমর্থকদের তাত্ত্বিক বক্তব্য, ০৯. ওয়ার্কাসা ক্যাম্প ও রশিদ বই সমস্যা, ১০. প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, ১১. কর্মী নির্যাতন।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের নাম—প্রথম রাজনৈতিক সংগ্রাম। এর উপ-অধ্যায়গুলো হলো—০১. গণ-পরিষদে ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব, ০২. সংবাদপত্রের সমালোচনা, ০৩. সভা ও সাংগঠনিক উদ্যোগ, ০৪. সিলেটে প্রতিক্রিয়াশীলদের হামলা, ০৫. ১১ই মার্চের সাধারণ ধর্মঘট, ০৬. ১১ই মার্চের নির্যাতনের প্রতিবাদ, ০৭. চুক্তি সাক্ষর ও পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার প্রথম অধিবেশন, ০৮. পরিষদের অভ্যন্তরে, ০৯. বন্দীমুক্তি ও পরবর্তী বিক্ষোভ।

তৃতীয় পরিচ্ছেদের নাম—পূর্ব বাঙলার মহম্মদ আলী জিন্নাহ্। এর উপ-অধ্যায়গুলো হলো—০১. মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি, ০২. জিন্নাহ্ ঢাকা আগমন ও রেসকোর্সের বক্তৃতা, ০৩. জিন্নাহ্ সমাবর্তন বক্তৃতা ০৪. রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, ০৫. ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা, ০৬. জিন্নাহ্ বিদায়বাণী ও পূর্ব বাঙলা সফরের ফলাফল।

চতুর্থ পরিচ্ছেদের নাম—নাজিমুদ্দীন সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা। এর উপ-অধ্যায়গুলো হলো—০১. ব্যবস্থাপক সভায় খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকারী প্রস্তাব, ০২. ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনী প্রস্তাব, ০৩. অন্যান্য সংশোধনী প্রস্তাব, ০৪. বিতর্কের জবাবে নাজিমুদ্দীনের বক্তৃতা।

পঞ্চম পরিচ্ছেদের নাম—ভাষা আন্দোলনের উত্তর ঘটনা প্রবাহ—১৯৪৮। এর উপ-অধ্যায়গুলো হলো—০১. সাধারণ অসন্তোষ ও সরকারী নীতি, ০২. ঢাকা শহরে ব্যাপক ছাত্রী বিক্ষোভ, ০৩. পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের নাম—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের অগ্রগতি। এর উপ-অধ্যায়গুলো হলো—০১. পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, ০২. অসাম্প্রদায়িক ছাত্র রাজনীতি, ০৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিম্ন-কর্মচারী ধর্মঘট, ০৪. আন্দোলনের নোতুন পর্যায়

সপ্তম পরিচ্ছেদের শিরোনাম—পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের উত্থান। এর উপ-শিরোনাম হলো—০১. বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ, ০২. মোগলটুলীর শাখা অফিস, ০৩. টাঙ্গাইল উপনির্বাচন, ০৪. মুসলিম লীগের আভ্যন্তরীণ সংকট, ০৫. রোজ গার্ডেনের মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন, ০৬. শামসুল হকের প্রস্তাব এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম ম্যানিফেস্টো।

অষ্টম পরিচ্ছেদের শিরোনাম—আরবী হরফ প্রবর্তনের ষড়যন্ত্র। এর উপশিরোনামগুলো হলো—০১. ফজলুর রহমানের উদ্যোগ, ০২. কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ০৩. কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক আরবী প্রচলনের উদ্যোগ, ০৪. আরবীকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব।

নবম পরিচ্ছেদের শিরোনাম হলো—পূর্ব বাঙলা ভাষা কমিটি। এর উপশিরোনাম হলো—০১. পূর্ব বাঙলা ভাষা কমিটির প্রতিষ্ঠা, ০২. কমিটির কার্যপ্রণালি, ০৩. ভাষা কমিটির বৈঠক।

দশম পরিচ্ছেদের শিরোনাম—ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস ও পরবর্তী পর্যায়। এর উপশিরোনামগুলো হলো—০১. মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ ও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি, ০২. সোভিয়েট ও যুগোশ্লাভ পার্টির মুখপাত্রদের বক্তব্য, ০৩. নেহরু সম্পর্কে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নোতুন সিদ্ধান্ত, ০৪. ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস, ০৫. পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, ০৬. জননিরাপত্তা আইন ও সরকারী দমননীতি, ০৭. জেল নির্যাতন ও অনশন ধর্মঘট, ০৮. পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন এলাকায় কৃষক সংগ্রাম, ০৯. নাচোল কৃষক বিদ্রোহ ও পরবর্তী নির্যাতন, ১০. রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে গুলী বর্ষণ রাজবন্দী হত্যা, ১১. ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির উপর মাওসেতুঙ ও চীনা লাইনের প্রভাব, ১২. কমিনফর্ম থিসিস ও ভারতীয় পার্টির নেতৃত্বে রদবদল, ১৩. কমিনফর্ম থিসিস ও পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি। এছাড়া রয়েছে তথ্যনির্দেশ ও সাক্ষাৎকারের তালিকা।

গবেষণা কতটা বিস্তৃত পরিসরে ও শেকড়সন্ধানী হতে পারে উমর তিন খণ্ডের এ বইয়ে তার দৃষ্টান্ত হাজির করেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যে কেবল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না; কেবল ঢাকাকেন্দ্রিক আন্দোলন ছিল না। তা এ বই পাঠে স্পষ্ট বোঝা যায়। এখানে উমর আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন, যা এ বইয়ের চিরকালীন প্রয়োজনীয়তাকে অনিবার্য করেছে। সেটি হলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন কেন পুরো পূর্ব বাংলা জেগে উঠল, কেন সবাই দূরে বা কাছে যেখানেই থাকুক না কেন এ আন্দোলনের একাত্মতা বোধ করল এবং তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাল তার কার্যকারণও এ বইয়ে হাজির রয়েছে। ভাষা আন্দোলন কেন সর্বপ্লাবী হয়ে উঠল এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলার সমাজ ও তার সাধারণ মানুষ কেন জেগে উঠল তা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় এ বই পাঠে।

এ কারণে বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ কেবল একটা বই নয়—এটা ভাষা আন্দোলনের ব্যাকরণ, যা পাঠ করলে আমরা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য ও মহত্ব সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে পারব। একুশের চেতনাকে সম্যকভাবে ধারণ করতে হলে, বাঙালির মর্মমূলে প্রোথিত করতে হলে এ বইকে ভাষা আন্দোলনের ব্যাকরণ হিসেবে ঘোষণাপূর্বক যথোপযুক্ত মর্যাদা দেয়ার ব্যবস্থা করা আশু প্রয়োজন। বিদ্যায়তনিক পর্যায়ে এ বইকে আবশ্যিক পাঠ হিসেবে ঘোষণা করা জরুরি।

কাজল রশীদ শাহীন: লেখক, সাংবাদিক ও গবেষক