বিশেষ সংখ্যা

বদরুদ্দীন উমর: ভাষা আন্দোলনের সাহিত্যিক স্থপতি

আফজালুল বাসার

ছবি : বণিক বার্তা

বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং অধিকাঠামোমূলক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বহু সমস্যার ওপর রাজনৈতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। বহু ক্ষেত্রে তার কৃত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও মতামতের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বাঙালি মননের জগতে বদরুদ্দীন উমরের স্থান বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং স্বীকৃত। অবশ্য রাজনৈতিক সাহিত্য রচনা ছাড়াও তার রাজনৈতিক জীবনের অন্যান্য উজ্জ্বল অংশ রয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মধারা অব্যাহত রাখা তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বদরুদ্দীন উমরের সর্বজনস্বীকৃত কৃতি হচ্ছে তিনটি বিশাল খণ্ডে ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থ। তিনি আমাদের ভাষা আন্দোলনের সাহিত্যিক স্থপতি। ভাষা আন্দোলনের ওপর তার এই গ্রন্থ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সাহিত্যিক শংকর লিখেছেন—বদরুদ্দীন উমর ভাষা আন্দোলনের কাশীরাম দাশ। বদরুদ্দীন উমরের চিন্তার সঙ্গে একমত পোষণ করে অথবা একমত পোষণ না করেও বলা যায়, ভাষা আন্দোলনের ওপর রচনা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা তার রাজনৈতিক জীবনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অবিমিশ্রভাবে মানুষের সার্বিক শোষণমুক্তির সংগ্রামে নিরন্তর অংশগ্রহণ করে চলেছে। আবুল কাসেম ফজলুল হক সম্পাদিত মাসিক লোকায়ত পত্রিকার নভেম্বর ’৮২ সংখ্যায় আবুল কাসেম ফজলুল হক লিখেছেন, বিগত কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশে সৃষ্টিশীল চিন্তার ও সৃষ্টিশীল কর্মের যে একটি ধারা ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে, সবার অজান্তে আত্মপ্রকাশ করছে, ভবিষ্যতে রচিত ইতিহাসে বদরুদ্দীন উমর সম্ভবত সেই ধারার পথিকৃতের এবং প্রথম পর্বের প্রধান পুরুষের মর্যাদায় ভূষিত হবেন। তার অবদানের ক্ষেত্র বিশিষ্ট ও বিশাল হওয়া সত্ত্বেও তাকে নিয়ে আলোচনা খুবই কম।

উল্লেখ্য, বদরুদ্দীন উমরের চিন্তারাশির মূল্যায়ন বর্তমান প্রবন্ধের লক্ষ্য নয়। ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থ রচনার পটভূমি-তথ্যাদি এবং একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন সম্পর্কে তার চিন্তাসূত্রের সংক্ষিপ্ত পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে।

তমদ্দুন মজলিস ও ‘সৈনিক’ থেকে শুরু

সমাজ, রাজনীতি এবং পার্টি—এই অবিচ্ছিন্ন তিনটি বিষয়ের প্রতি বদরুদ্দীন উমরের সার্বিক মনোযোগের অনিবার্য ফসল হচ্ছে তার রচনাবলি। উমরের রচনার সঙ্গে তার জীবন, রাজনীতি এবং উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের সাধারণত রাজনৈতিক সাহিত্য রচনার প্রতি যে অনীহা আছে বদরুদ্দীন উমর তাদের মধ্যে উজ্জ্বলতম ব্যতিক্রম এবং শুধু ব্যতিক্রমই নন, অনন্যও বটে। তার প্রকাশিত প্রতিটি গ্রন্থ এ দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক-সামাজিক বিকাশ প্রত্যক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তার রচনায় সমাজই মূল বিষয়। তিনি একটি নিশ্চিত নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সামনে রেখেই লেখেন। তার রচনার লক্ষ্য: সমাজের সার্বিক শোষণ-মুক্তির উদ্দেশ্যে সমাজ পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা এবং কাজ করা। বিশ্লেষক হিসেবে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, রাজনীতিবিদ হিসেবেও তার পরিচয়টা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করি আর না করি।

একুশে ফেব্রুয়ারি যেসব ব্যক্তিকে সংগ্রামী প্রতিবাদী আন্দোলনী হিসেবে গড়ে উঠতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে বদরুদ্দীন উমর তাদের একজন। তার রচনাগুলোর ভেতরেও একুশে ফেব্রুয়ারি বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। এমনকি তার প্রথম উল্লেখযোগ্য রচনাও একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ উমরের পিতা আবুল হাশিমকে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি রচনা লিখতে অনুরোধ করে। আবুল হাশিম বদরুদ্দীন উমরকে এই রচনাটি তৈরি করতে বলেন। এর শিরোনাম ছিল আমাদের ভাষার লড়াই। পুস্তিকাটি ১০ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল। এখন আর পুস্তিকাটি কোথাও পাওয়া যায় না। প্রথম বয়সে বদরুদ্দীন উমর বেশি লিখেননি। ১৯৫১ সালের দিকে তিনি তমদ্দুন মজলিসের সদস্য ছিলেন এবং মজলিসের পত্রিকা ‘সৈনিকে’ লিখতেন। এ সময় তিনি অনুবাদ করেন তার পিতা রচিত The Creed of Islam গ্রন্থটি। দু-একটা পত্রিকায় লেখা ছাড়া এই সময় এবং পরবর্তী আট-নয় বছর, ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় কিছুই লিখেননি। কিন্তু ১৯৬৩ সাল থেকে তিনি অনবরত লিখে চলেছেন। এর পর থেকে তিনি প্রতি বছর গড়ে কমপক্ষে একটি করে বই লিখতে সক্ষম হয়েছেন। পার্টির কাজ এবং অন্যান্য অসুবিধা সত্ত্বেও তিনি যে অকৃত্রিম নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে এবং প্রচণ্ড পরিশ্রমের বোঝা বয়ে গবেষণামূলক-মৌলিক রচনা লেখেন তা অনুধাবন করলে বিস্মিত হতে হয়। কেবল একজন সম্পূর্ণভাবে সচেতন-উদ্দেশ্যপ্রবণ নিবেদিত চেতনাবান ব্যক্তির পক্ষেই এ কাজ করে যাওয়া সম্ভব।

ভাষা আন্দোলনের সাহিত্যিক দলিল: ইতিহাস উৎকীর্ণ করে ইতিহাস সৃষ্টি

‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় খণ্ড এবং তৃতীয় খণ্ড বদরুদ্দীন উমরের রচনাবলির মধ্যে এখন পর্যন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ। এ গ্রন্থ তিনটির গুরুত্ব, ব্যাপকতা এবং প্রভাব বাংলাদেশের সার্বিক সামাজিক জীবনে অপরিসীম। নিরঙ্কুশভাবে না হলেও ১৯৬৩-৮২ সাল পর্যন্ত কুড়ি বছর ধরে প্রায় দেড় হাজার পৃষ্ঠার এ গ্রন্থ তিনটি রচনা করতে তিন সহস্রাধিক তথ্য উৎস ব্যবহার করতে হয়েছে, প্রায় ২০০ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার, সাহায্য নিতে হয়েছে।

১৯৬০ সালে বদরুদ্দীন উমর পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ ইতিহাস রচনার জন্য তথ্যাদি সংগ্রহ শুরু করেন। পরে ওই পরিকল্পনা ত্যাগ করে তিনি ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করতে মনস্থ করেন। তার গ্রন্থত্রয় সম্মিলিতভাবে প্রায় দুই শতাব্দীর আংশিক পটভূমিতে একটি বিরাট জন-অঞ্চলের সামাজিক জীবনের গভীরতম প্রত্যয়যুক্ত দলিল, পূর্ব বাংলার উজ্জ্বল জীবন-নাট্য। গ্রন্থত্রয়ের পরিকল্পনাটিও ব্যাপক। প্রথম খণ্ড লেখা হয়েছে ’৬৯-৭০-এ। দ্বিতীয় খণ্ড ’৭৫-৭৬-এ এবং তৃতীয় খণ্ড ’৭৬-এ কিছু লেখা, বাকিটুকু ’৮২ সালে। লিখতে যে সময়ের প্রয়োজন হয়েছে লেখার আয়োজন করতে সময় নিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। নানা অসুবিধা মোকাবেলা করতে হয়েছে এবং এসব অসুবিধা মোকাবেলা করতে গিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডা হয়েছে প্রচুর।

ভাষা আন্দোলনে উমরের নিজের সরাসরি কোনো ভূমিকা ছিল না। কিন্তু উত্তাল রক্তঝরা সে সময়গুলোয় তিনি একজন ভালো দর্শক হিসেবে প্রায় প্রতিটি ঘটনার আশপাশে ছিলেন। মিছিলে তিনি অংশ নিয়েছেন। ১৪৪ ধারা ভেঙেছেন। এলাকায় অবস্থান করেছেন সবসময়।  সে হিসেবেও তিনি একজন ভাষাসৈনিক। পরবর্তী সময়ে এসব ঘটনার বিবরণ লিখতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী হয়েও তাকে নানা রকম অসুবিধার সামনাসামনি হতে হয়েছে। এর মধ্যে স্মৃতিচারণের সমস্যা এবং তথ্য উৎসের সমস্যাই ছিল সবচেয়ে বেশি। গ্রন্থ তিনটি রচনা করার জন্য লিখিত তথ্য এবং সাক্ষাৎকার প্রাপ্ত তথ্য মিলিয়ে হাজার হাজার পৃষ্ঠা তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, হাসান হাফিজুর রহমানকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করার জন্য তিনি তার সংগ্রহ থেকে দুই হাজার পৃষ্ঠার তথ্য দিয়েছিলেন।

তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সরকারি কোনো তথ্য উৎস থেকে তেমন সাহায্য পাননি। অজস্র তথ্যের মধ্যে দুজন বন্ধুর মাধ্যমে মাত্র দুটি সরকারি তথ্য উৎস ব্যবহার করেছিলেন। ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ খণ্ডত্রয় রচনার ক্ষেত্রে উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো।

প্রাথমিক সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়, ‘ভাষা আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে লিখিত বই পুস্তকের অভাব।’ প্রচুর বই তো ছিলই না উপরন্তু যে দু-একখানা বই ছিল তার মধ্যে ইতিহাস রচনার মতো উপাদানের যথেষ্ট অভাব ছিল। সে সময়ের তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক প্রকাশিত ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ এবং হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনটি উল্লেখযোগ্য। তবে এ বই দুটির ওপর ভিত্তি করে কোনো রচনা দাঁড় করানো সম্ভব ছিল না। সুতরাং বদরুদ্দীন উমরকে মৌলিক তথ্য উৎসের সন্ধানে ব্যাপক আয়োজন করতে হয়।

মৌলিক তথ্যের সন্ধান করতে গিয়ে গবেষণার আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন তিনি। ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়সহ শ্রমিক কৃষক ছাত্র অন্যান্য মেহনতি জনগণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত নানাবিধ অবস্থা, আন্দোলনের দলিল সংগ্রহ করেন তিনি। প্রথমত তথ্য উৎসকে তিনি তিন ভাগে ভাগ করেন: (ক) পত্রপত্রিকা, (খ) বিভিন্ন আন্দোলন সম্পর্কিত পুস্তক-পুস্তিকা, পার্টি দলিলপত্র, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাগত সংগঠনগুলোর আন্দোলনের দলিলপত্র, খণ্ড খণ্ড নানা আন্দোলনের সময় প্রচারিত ইশতেহার, পাকিস্তানের সংবিধান সভা ও পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের বিতর্কসমূহ এবং (গ) ভাষা আন্দোলসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার।

পত্রপত্রিকা, দলিল-দস্তাবেজ সংগ্রহ করতে বিভিন্ন লাইব্রেরি যেমন সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদ পাঠাগার, রাজশাহী পাবলিক লাইব্রেরি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসেম্বলি লাইব্রেরি, ঢাকা পাবলিক লাইব্রেরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব ক্যালকাটার নিউজপেপার সেকশন ইত্যাদিতে কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু লাইব্রেরিতে প্রয়োজনীয় বই-পুস্তকের সংখ্যা খুবই কম অথবা এসব বই পাওয়া যায় না। ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানবিশেষের কাছে গেলে দেখা যায় বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থায় তাদের কাছে রক্ষিত তথ্য নষ্ট হয়ে গেছে অথবা নিজেরা বাধ্য হয়ে বা ভয়ে নষ্ট করে ফেলেছেন। ফলে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বদরুদ্দীন উমরকে কয়েকশ ব্যক্তির কাছে যাতায়াত, যোগাযোগ করতে হয়েছে। বহু প্রতিষ্ঠানে সময় ব্যয় করতে হয়েছে দিনের পর দিন।

সাক্ষাৎকার সমস্যা ও স্মৃতিচারণের বিভ্রান্তি

তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকারের সমস্যা একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা যায়। একজন ব্যক্তিকে সময় দিতে রাজি করিয়ে নির্দিষ্ট দিনে হাজির হয়ে অথবা নানা অসুবিধার ফলে তারিখ পরিবর্তন করে করে একদিন বা একাধিক দিন অনেক সময় দিতে হয়েছে। বিভিন্ন কারণে একজনের সাক্ষাৎকারে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর সরাসরি নির্ভর করা যায় না। ফলে ওই তথ্যকে সমসাময়িক অন্যদের দ্বারা সপ্রমাণ করে সমসাময়িক সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তার স্বাভাবিকতা বিচার করে গ্রহণ করতে হয়। কারণ ওইসব সাক্ষাৎকারে প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে (ক) অতিশয়োক্তি, (খ) নিজের ভূমিকাকে অতিরঞ্জিত করা, (গ) অন্যের ভূমিকাকে ছোট করা, (ঘ) অনিচ্ছাকৃত বা দুর্বল স্মৃতির জন্য ভুল বিবৃতি দেয়া—প্রভৃতির সম্ভাবনা থাকে। ফলে এতসব সতর্কতা অবলম্বন করে একটি তথ্যকে সঠিক ধরে নিয়ে অগ্রসর হতে পরিশ্রম ও বিশেষ বিবেচনার প্রয়োজন হয়। এখানে একটি উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে।

১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জনাব আতাউর রহমান খানের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাপারে আলোচনার সময় খান সাহেব বদরুদ্দীন উমরকে বলেন, তিনি এই সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ওই সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলেন না। জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উপস্থিত কমরুদ্দীন আহমদকে তৎক্ষণাৎ ফোন করা হলে কমরুদ্দীন আহমদ সঙ্গে সঙ্গে জানান আতাউর রহমান খান ওই সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলেন না। তার পরও আতাউর রহমান খান সে কথা মেনে নেননি। পরে কমরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দীন আহমদ, মুহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ যারা ওই সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলেন তাদের সঙ্গে দেখা করলে তারা ওই সাক্ষাৎকারে আতাউর রহমান খানের উপস্থিতির কথা অস্বীকার করেন। এভাবে বদরুদ্দীন উমর বিষয়টির সমাধান করেন, যদিও পরবর্তী সময়ে আতাউর রহমান খান তার অভিযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন।

স্মৃতিচারণের বিভ্রান্তি সম্পর্কে উমর উদাহরণ উল্লেখ করে বলেন, অলি আহাদের বইটি (জাতীয় রাজনীতি-১৯৪৭-৭৫) full of slander. নিজেকে বড় করা, অন্যকে ছোট করা, তিনিই মূল নায়ক এবং তাকে অবহেলা করা হয়েছে—এ রকম ধারণায় ভর্তি বইটির গুরুত্ব খর্ব হয়েছে। ফেব্রুয়ারির দিনগুলোয় অলি আহাদের গুরুত্ব ছিল, কিন্তু তার বইয়ের বক্তব্যের ব্যাপারে সে গুরুত্বারোপ করলে সবাইকেই বিভ্রান্ত হতে হবে।

গ্রন্থ রচনায় শরিক: দুইশত জন এবং আরো

বদরুদ্দীন উমর ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ রচনা করতে বহু মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা নিয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ২০০ ব্যক্তি সাক্ষাৎকার দেয়া এবং তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। অন্যান্য ব্যাপারেও অনেকের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতা দরকার হয়েছে। এর মধ্যে কেউ কোনো বিষয়ের গভীরতা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন, কেউ বা কপি করেছেন, কেউ নির্ঘণ্ট প্রস্তুত করেছেন ইত্যাদি। এখানে যারা নিজেদের নাম প্রকাশ করতে আপত্তি করেছেন তাদের ছাড়া অন্যান্য অধিকাংশের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

পত্রপত্রিকা এবং অন্যান্য তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে উমরকে সহযোগিতা করেছেন তাজউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক শাহেদ আলী, এমদাদ আলী, শামসুল হক, সৈয়দ হোসেন রেজা, আবদুল কাদের ভুইয়া, সাইফুল ইসলাম, নূরুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক শামসুল আলম, আবদুর রশীদ খান, কমরুদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান (রাজশাহী), অলি আহাদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, শফিউদ্দীন আহমদ, শামসুদ্দীন আহমদ, মাহবুব জামাল জাহেদী, ডক্টর রশিদুজ্জামান, আমানুল হক, অজয় ভট্টাচার্য, কামাখ্যা রায় চৌধুরী, নগেন সরকার, প্রমোদ দাস, সইফ-উদ-দাহার, সুষমা দে প্রমুখ।

গ্রন্থ রচনার জন্য যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ আলাপ করতে হয়েছে তাদের নাম। প্রথম খণ্ডের জন্য—অজিত গুহ, অলি আহাদ, আজিজ আহমদ, আজহার হোসেন (নবাবগঞ্জ), আতাউর রহমান (রাজশাহী), আতাউর রহমান খান, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবদুর রহমান চৌধুরী (বরিশাল), আবদুল জব্বার খন্দকার, আবদুল মতিন (পাবনা), ডক্টর আবদুল মালেক, আবদুল হক, আবদুশ শহীদ, আবুল কাশেম (তমদ্দুন মজলিস), আবুল হাশিম, সৈয়দ আলী আহসান, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া), কাজী গোলাম মাহবুব, কাজী মহম্মদ ইদরিস, কমরুদ্দীন আহমদ, ডক্টর করিম, খয়রাত হোসেন, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, তাজউদ্দীন আহমদ, তফজ্জল আলী, মুহম্মদ তোয়াহা, নগেন সরকার, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, নূরুল আমিন, মণি সিংহ, মুনীর চৌধুরী, মারুফ হোসেন, খন্দকার মুশতাক আহম্মদ, মহীউদ্দীন আহমেদ (বরিশাল), মাহমুদ আলী, রণেশ দাশগুপ্ত, শতকত আলী, শেখ মুজিবুর রহমান, শফিউদ্দীন আহমদ, শামসুজ্জোহা (নারায়ণগঞ্জ), শামসুদ্দীন আহমদ, শাহ আজিজুর রহমান, ক্যাপ্টেন শাহাজাহান, শাহেদ আলী, শহীদুল্লাহ কায়সার, সমর সেন, সরদার ফজলুল করিম এবং হামিদা সেলিম (রহমান)।

দ্বিতীয় খণ্ডের জন্য— অজয় ভট্টাচার্য, অলি আহাদ, আজহার হোসেন, আবদুল হক, আবদুল শহীদ, ইমতিয়াজ উদ্দীন খান, কমরুদ্দীন আহমদ, তফজ্জল আলী, নগেন সরকার, মণি সিংহ, রমেন মিত্র, শরদিন্দু দে লালা, শান্তি সেন, সইফ-উদ-দাহার, সুখেন্দু দস্তিদার, সুধাংশু বিমল দত্ত, স্বদেশ বসু এবং হাজী মুহম্মদ দানেশ।

দ্বিতীয় খণ্ডে অজয় ভট্টচার্য, কামাখ্যা রায় চৌধুরী, নগেন সরকার (খুলনা), প্রমোদ দাস, সাইফ-উদ-দাহার, সুষমা দে-র লিখিত নোট ব্যবহৃত হয়েছে।

তৃতীয় খণ্ডের জন্য যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে এবং অন্যান্য সহযোগিতা পাওয়া গেছে তাদের নাম হলো—খন্দকার গোলাম মোস্তফা, হাসান হাফিজুর রহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, গাজীউল হক, আবদুর রজ্জাক, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, হাবিবুর রহমান শেলী, খয়রাত হোসেন, অজিত গুহ, আবদুর রহমান চৌধুরী, সৈয়দ নুরুদ্দীন, হেদায়েত হোসেন চৌধুরী, হাশিমউদ্দীন আহমদ, ইশতিয়াক আহমদ, সুফিয়া আহমদ, বদরুল আমিন, আহমদ হোসেন, মোস্তফা জামাল জাহেদী, অজয় ভট্টাচার্য, অলি আহাদ, আজহার হোসেন, আজিজ আহমদ (চিফ সেক্রেটারি), আতাউর রহমান খান, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, আবদুল আওয়াল, আবদুল আওয়াল ভূঁইয়া, আবদুল মতিন, আবদুল হক, আবদুস শহীদ, আবুল হাশিম, ইমতিয়াজ উদ্দীন খান, এমআর আখতার (মুকুল), কমরুদ্দীন আহমদ, কাজী গোলাম মাহবুব, কাজী মহম্মদ ইদরিস, কিউ কিউ এম জহুর (কাসেদ আলী), ক্যাপ্টেন শাহজাহান, খায়রুল কবির, খন্দকার মুশতাক আহমেদ, গাজীউল হক, জহুর হোসেন চৌধুরী, ডক্টর মালেক, তফজ্জল আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, নগেন সরকার, নূরুল আমিন, মণি সিংহ, মহম্মদ তোয়াহা, মহীউদ্দীন আহমেদ, মাহবুব জামাল জাহেদী, মাহবুব আলী, মুজিবুল হক, মোহন মিঞা, রমেন মিত্র, রণেশ দাশগুপ্ত, শওকত আলী, শরদিন্দু দে লালা, শামসুদ্দীন আহমেদ, শামসুদ্দোহা, শাহ আজিজুর রহমান, শান্তি সেন, শেখ মুজিবুর রহমান, সাইফ-উদ-দাহার, সমর সেন (ফরিদপুর), সরদার ফজলুল করিম, সফিউদ্দীন আহমেদ, সাদেক খান, সুখেন্দু দস্তিদার, সুধীন ধর, বিমল দত্ত, মোহম্মদ নজরুল ইসলাম, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, হামিদা রহমান।

এছাড়া সিরাজুল হক কুতুব, পিনাকী দাস, সালাহুদ্দীন, আবুল আসাদ, আবদুর রশীদ খান এই গ্রন্থ রচনায় বিভিন্ন সহযোগিতা করেছেন।

ভাষা আন্দোলনের বিষয়বস্তু

‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থটির প্রথম খণ্ডে পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন রূপে তার বিকাশ এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের উন্নততর পর্যায়ে তার উত্তরণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে ভাষা আন্দোলনের পটভূমির অংশবিশেষ আলোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শেষ পর্যায়ে পূর্ব বাংলার কৃষকের অবস্থা, ৫০-এর দাঙ্গা, ছাত্র নির্যাতন ও অন্যান্য নির্যাতন এবং নির্যাতনের প্রতিরোধ, শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনভিত্তিক অবস্থার বর্ণনা। তৃতীয় খণ্ডে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের সময়ে শ্রমিক আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন এবং বিশেষ করে একুশে ফেব্রুয়ারির নাটকীয় ঘটনাবলি। 

অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও প্রতিরোধের প্রতীক একুশে

উমরের মতে, ১৯৪৮ বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনই পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম ব্যাপক জাতীয় প্রতিরোধ। ১৯৬৪-৬৫ সালের আইয়ুবি নির্বাচন, ১৯৬৮-৬৯ সালের ডিসেম্বর-মার্চ আন্দোলন এবং সর্বশেষ ২৫ মার্চ-পরবর্তী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে। পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিকাশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন এজন্যই এত তাৎপর্যপূর্ণ। একুশে ফেব্রুয়ারি এজন্যই আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পথচি‎হ্ন। (ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, পৃ-২)। ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করে। এই পরিবর্তন একদিকে যেমন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গণবিরোধী চরিত্র সম্পর্কে এ দেশের শিক্ষিত সমাজ ও জনগণকে সচেতন করে তোলে, অন্যদিকে তেমনি তা পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর জাতীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনকেও স্থাপন করে ব্যাপক গণভিত্তির ওপর।... পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন যে কেবল ছাত্র ও শিক্ষিত জনগণের আন্দোলন ছিল না, সে কথা আজ বলাই বাহুল্য। আমাদের দেশে পাকিস্তান সরকার যে জাতিগত নির্যাতন জারি রেখেছিল, তাদের বাংলা ভাষাসম্পর্কিত নীতি ছিল তারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভাষার ওপর বিধিনিষেধ জারি করে, বাংলা ভাষা শিক্ষাকে গুরুত্বহীন করে তারা শুধু বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-শিক্ষক এবং বুর্জোয়া শ্রেণীকেই পঙ্গু করার ব্যবস্থা নেয়নি, এর দ্বারা তারা শ্রমিক শ্রেণীর শিক্ষা, তার রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং কৃষক জনগণের সংগঠিত রাজনীতির পথও রুদ্ধ করেছিল। বস্তুতপক্ষে ভাষা প্রশ্নে সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিয়ে তারা সামগ্রিকভাবে পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেই খর্ব এবং চূর্ণ করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল। জনগণও সেক্ষেত্রে নির্লিপ্ত থাকেনি। বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণকে নিজেদের সংস্কৃতি, আর্থিক জীবন এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর সামগ্রিক আক্রমণ হিসেবে ধরে নিয়ে তার বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ব্যাপকভাবে। তাই যে আন্দোলন ১৯৪৭ সালে শুরু হয়েছিল মুষ্টিমেয় শিক্ষিত ছাত্র যুবকের সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে, সে আন্দোলন কয়েক বছর পর ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই পরিণত হলো পূর্ব বাংলাব্যাপী এক বিরাট গণআন্দোলনে।...

পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন শুধু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং শিক্ষার মাধ্যমের আন্দোলন ছিল না। সামগ্রিকভাবে তা ছিল আমাদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের যথাযথ বিকাশের সংগ্রাম এবং সেই সংগ্রামের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে ব্যবহারের অধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রাম। (ঐ পৃ-৩-৫)

ভাষা আন্দোলনের দুর্বলতা

গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে ভাষা আন্দোলনের দুর্বলতা দুটি হচ্ছে, রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটিকে পাকিস্তানের সব অঞ্চলের সমস্যা হিসেবে দেখতে না পারা এবং ভাষা নির্যাতনকে মূলত সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের মুৎসুদ্দিদের চক্রান্ত হিসেবে না দেখা। পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসকারী নানা ভাষাভাষী বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণ উর্দুকে ধর্মীয় ভাষা হিসেবে মোটামুটি স্বীকার করে নেন। ভাষার লড়াইকে তারা ধর্মবিরুদ্ধ আন্দোলন হিসেবে দেখেন। এর ফলে পাকিস্তানের জনগণ নিজ নিজ ভাষার দাবিকে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি এবং ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে উগ্র জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চরিত্র না থাকা ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় দুর্বলতা। পাকিস্তানে সাম্রাজ্যবাদের দালাল ও মুৎসুদ্দি শ্রেণী ছিল ভাষানীতির মূল নির্ধারক এবং জাতিগত নিপীড়ক। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের এ সম্পর্ক ব্যাপকভাবে বুঝতে আন্দোলনীদের বেশ সময় লেগেছিল। ফলে ভাষা আন্দোলন এক ধরনের বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী চেতনা সঞ্চার করেছিল কিন্তু সমগ্র পাকিস্তানের নিপীড়িত জনগণের মধ্যে ভাষার প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদী ও তার মুৎসুদ্দিরা যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করেছিল তার মীমাংসা করতে সে আন্দোলন ব্যর্থ হয়।’ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা না থাকার ফলে এই আন্দোলনের গণতান্ত্রিক চরিত্র অনেকাংশে খর্ব হয়।

উমরের মতে, ‘ভাষা আন্দোলন আমাদের প্রতিরোধের প্রতীক এবং ভাষা আন্দোলন এদেশের বুর্জোয়া রাজনীতির সাম্প্রদায়িকতাকে ধর্মনিরপেক্ষতা দান করেছে এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে সামনে তুলে ধরেছে। কিন্তু এই আন্দোলনের দুর্বলতার দিকগুলোও তিনি উল্লেখ করেছেন। চীনের ৪ মে আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করে উমর বলেছেন, ৪ মে আন্দোলনের একটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা ছিল। একইভাবে অর্থাৎ সাংস্কৃতিকভাবে শুরু হলেও আমাদের ভাষা আন্দোলনে এই ভূমিকা অনুপস্থিত ছিল। এর কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন, ভাষা আন্দোলনের ঘটনায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের ভূমিকা বুঝতে অনেকেরই সময় লেগেছিল। এছাড়া ৪ মে আন্দোলন যেমন পরবর্তীকালে রাজনৈতিকভাবে বিকশিত হয়েছিল আমাদের ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে তা হয়নি। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায় বা প্রকাশ হিসেবে দেখা গেল, এখানকার কমিউনিস্ট পার্টি এই আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে উপস্থিত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো,  কোনো শক্তিশালী সাহিত্যের জন্ম হলো না। আরো পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলনের ফসলকে নিয়ে যেতে দেখা গেল শাসক-শোষকদেরকেই। এদেশের প্রগতি আন্দোলনীরা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে নিজেদের অর্থাৎ শোষিত জনগণের পক্ষে নিয়ে যেতে সক্ষম হননি। ফলে শহীদ মিনার এখনো দাঁতাল শোষকশ্রেণীর পদপিষ্ট হয়েই চলেছে— একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা আজকের তরুণদের কাছে এবং সমাজের কাছে প্রায়ই বিকৃতভাবে উপস্থিত।’

বদরুদ্দীন উমর সহজ, অনাড়ম্বর, বক্তব্য প্রকাশক, কাটা কাটা বাক্যে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-যুক্তি উপস্থিত করেন। পলেমিক্যাল লেখায় তিনি অব্যর্থ তীরন্দাজ। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম শক্তিশালী গদ্যশিল্পী। লেখায়, রাজনৈতিক সংগঠনে, আমাদের দেশের শোষিত জনমানুষের সার্বিক মুক্তির জন্যে— অর্থনৈতিক-অধিকাঠামোমূলক মুক্তির জন্যে তিনি অনবরত এবং নিরাপস সংগ্রাম করে চলেছেন। ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থ রচনা করে তিনি আমাদের দেশের জনগণের ব্যক্তিত্ব সৃষ্টিতে সহায়তা করেছেন, এই দেশের মানুষকে অন্যায়ের প্রতিবাদে সদাজাগ্রত চেতনা দান করেছেন।

পূর্বে উদ্ধৃত সূত্রে লোকায়ত পত্রিকায় আবুল কাসেম ফজলুল হক আরো লিখেছেন: বদরুদ্দীন উমরের গ্রন্থ পাঠ করা এবং তার বক্তব্যের পক্ষে অথবা বিপক্ষে সাড়া দেয়া সুশিক্ষিত বাঙালি মাত্রেরই কর্তব্য। বদরুদ্দীন উমর আমাদের দেশের অনেক অনেক বিষয় সম্পর্কে যেসব মূল্যবান বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছেন অনেক গ্রন্থে, তার যথেষ্ট পরিমাণ আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। অথচ সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে তিনি লিখেছেন। তিনি কনস্পিরেসি অব সাইলেন্স বা নীরব থাকার ষড়যন্ত্রে পড়েছেন কিনা অথবা তার মতো আন্তরিকতা, পরিশ্রম ও যুক্তি দিয়ে তাকে আলোচনা করার মতো ব্যক্তির অভাব দেশে রয়েছে কিনা আমরা জানি না।

(১৯৮১ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় কভার স্টোরি হিসেবে মুদ্রিত রচনার সংক্ষেপিত রূপ)

আফজালুল বাসার: লেখক এবং বদরুদ্দীন উমর রচনাবলীর সম্পাদক