বিশেষ সংখ্যা

পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের আকরসন্ধানী ইতিহাস

আকমল হোসেন

ছবি : বণিক বার্তা

এ দেশের গণমানুষের ইতিহাসে বিভিন্ন প্রতিরোধ সংগ্রামের বিবরণ পাওয়া যায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শুরুতে বিদেশী নিয়ন্ত্রণ এবং বর্ধিত খাজনা দিতে অস্বীকার করে স্থানীয় রাজা ও জমিদাররা বিদ্রোহ করেছিলেন। এক অর্থে সে ইতিহাস হচ্ছে দুই পক্ষের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই, সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। তবে গণমানুষের গড়ে তোলা প্রতিরোধের চরিত্র ভিন্ন ছিল। ব্রিটিশদের আগে মোগল শাসকরা জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান দেখিয়ে বিভিন্ন ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কিন্তু কোম্পানি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা হওয়ায় তারা পৃষ্ঠপোষকতার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। ফলে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। পাশাপাশি সাঁওতাল, খাসি, চাকমা জাতির মানুষের বিদ্রোহ স্বতন্ত্র প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছিল। তবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অনেক বড় বড় কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে—রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ, নীলচাষীদের বিদ্রোহ, পাবনা কৃষক বিদ্রোহ, তেভাগার লড়াই—এসবের পেছনে অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার কারণ ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর সিপাহি বিদ্রোহ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সন্ত্রাসবাদী সশস্ত্র সংগঠনগুলোর প্রতিরোধ গণমানুষের সংগ্রামের উদাহরণ ছিল।

তবে স্বাধীনতা-উত্তর পূর্ব বাংলায় মাতৃভাষা নিয়ে যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল তা ধর্মীয় ভিত্তিতে গড়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলকে নাড়িয়ে দেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা নিয়ে পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সংঘটিত ভাষা আন্দোলন আগের সব আন্দোলনের তুলনায় এক স্বতন্ত্র আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ভাষাকে কেন্দ্র করে কোনো রাজনৈতিক সংগ্রাম যে হতে পারে তা অচিন্তনীয় ছিল। বিশেষ করে ইসলামের নামে তৈরি রাষ্ট্রের প্রভাবশালী নেতৃত্বের কাছে ধর্মীয় কারণে উর্দু ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষাকে স্থান দেয়ার চিন্তা অসম্ভব ছিল। বাঙালি মুসলমানের প্রথম পরিচয় মুসলমানের ওপর জোর দেয়ার কারণে বাংলাকে মুসলমানের ভাষা হিসেবে অগ্রাহ্য করার এক প্রবল মনোভাব এদের ভেতর জারি ছিল।

হিন্দিকে ভারত ডমিনিয়নের রাষ্ট্রভাষা করার চিন্তার সঙ্গে মিল রেখে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ১৯৪৭ সালের জুলাইয়ে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দীন আহমদ অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। তার এ ধরনের সুপারিশকে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে বিরোধিতা করা না হলেও ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ নামে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় লিখিত এক প্রবন্ধে এর বিরোধিতা করে লিখেছিলেন যে হিন্দির অনুকরণে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হলে তা শুধু পশ্চাদ্‌গমনই হবে। উর্দু পাকিস্তনের কোনো অঞ্চলের মাতৃভাষা না।  বিদেশী ভাষা হিসেবে যদি ইংরেজিকে বাদ দেয়া হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার কোনো যুক্তি নেই (পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৯)। ভাষা প্রশ্নে আলোচনা ও রাজনৈতিক প্রতিবাদ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও অব্যাহত ছিল। সে সময় গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী সম্মেলনে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হোক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের ওপর ছেড়ে দেয়া হোক (ঐ, পৃ. ২৫)। ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ও শিক্ষকের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত তমদ্দুন মজলিস পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু ও বাংলার প্রস্তাব করেছিল। করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে সর্বসম্মতিতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের বিরোধিতায় ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রথম ছাত্রসভায় বাংলাকে পাকিস্তান ডমিনিয়নের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলা হয়েছিল (ঐ, পৃ. ৩১)। এদিকে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সরকারের ভেতর ও সমাজের কিছু অংশকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। এর প্রতিক্রিয়ায় ছাত্রদের ওপর শারীরিক হামলাও সংঘটিত হয়।

সুতরাং প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছে বাংলা ভাষার যথাযথ মর্যাদা দানের দাবি তোলা সহজ কোনো ব্যাপার ছিল না। অন্যদিকে ছাত্র-তরুণদের সেই দাবি এবং ধারাবাহিক রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা আন্দোলনের অনন্য চরিত্র প্রকাশ করেছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক চেহারা, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্যের নীতি যে রাজনৈতিক ক্ষোভ তৈরি করছিল তা বিভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছিল। ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি হিসেবে আরবি হরফে বংলা ভাষা লেখার উদ্যোগ ছাত্রদের আন্দোলনকে বেগবান করে তুলেছিল। পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্না ১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকা সফর কালে প্রদত্ত বিভিন্ন বক্তব্যে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অভিমত প্রদান করেছিলেন। বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপনকারীদের তিনি ‘রাষ্ট্রের শত্রু ও বিদেশী এজেন্সির অর্থ সাহায্যপুষ্ট’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পরবর্তীকালে  ছাত্রদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ভাষা প্রশ্নে তার বাদানুবাদ আন্দোলনরত ছাত্রনেতৃত্বের চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রকাশ করেছিল।

ভাষা আন্দোলন চলাকালীন পূর্ব বংলায় দুর্ভিক্ষ, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, শ্রমিক-কৃষক-শিক্ষকদের দাবি নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও গণআন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল। বিশেষ করে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে  কৃষক আন্দোলন হচ্ছিল, তার মধ্যে রাজশাহীর নাচোলে সাঁওতাল কৃষকরা ইলা মিত্রের পরিচালনায় যে বিদ্রোহ করেছিল সে সময়ের রাজনৈতিক সংগ্রামে তা উজ্জ্বল হয়ে আছে। রাজনৈতিক এসব ঘটনা বিচ্ছিন্নভাবে ঘটেনি এবং সামগ্রিক রাজনীতির ওপর প্রভাব ফেলেছিল। লক্ষ করার বিষয় যে ছাত্র-শিক্ষক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পাশাপাশি কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীও সংগঠিত হচ্ছিল, যা পরবর্তী রাজনীতিকে দৃশ্যমানভাবে স্পর্শ করেছিল। 

ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম প্রকাশনা ছিল ১৯৫৩ সালের মার্চে হাসান হাফিজুর রহমান দ্বারা সম্পাদিত এবং পুঁথিপত্র প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামের একটি সংকলন, যেখানে শহীদদের স্মৃতির প্রতি আবেগ-ভালোবাসাসংবলিত অনেক গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছিল। এ গ্রন্থ যে আবেদন তৈরি করেছিল তাতে ভীত হয়ে তদানীন্তন সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে দেয়। খোন্দকার গোলাম মুস্তফার ‘একুশের ঘটনাপঞ্জী যেন ভুলে না যাই’ এবং কবির উদ্দিন আহমদের ‘একুশের ইতিহাস’ নামে দুটো মূল্যবান লেখা গ্রন্থটিতে সংযোজিত হয়েছিল। লেখাগুলোর মূল্য আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার জন্য অতিপ্রয়োজনীয় বলা যায়। লেখক দুজন ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সময়ের তারিখসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বর্ণনা করেছেন। ১৯৭৬ পর্যন্ত বইটির চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল।

প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করতে হয় যে ১৯৪৭-এর সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠিত তমদ্দুন মজলিস নামের এক সাংস্কৃতিক সংগঠনের দ্বারা ভাষা আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত ঘটে এবং ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ নামে একটা পুস্তিকা এরা প্রকাশ করেছিল। এ সংগঠনের কর্ণধার অধ্যাপক আবুল কাশেম ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ (১৯৬৭) রচনা করেছিলেন। বইটা হাতের কাছে না থাকায় এ বিষয়ে কোনো আলোচনা করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ধারণা করা যেতে পারে যে তমদ্দুন মজলিশের ভূমিকাই এ বইয়ের প্রধান বিষয় ছিল। ভাষা আন্দোলনের পরিচালক ছাত্রদের সঙ্গে তমদ্দুন মজলিশের মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও বংলা ভাষার প্রশ্নে সংগঠনটি নিঃসন্দেহে অগ্রবর্তী ভূমিকা নিয়েছিল।

তবে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে করা আন্দোলন যে শুধু ভাষা-সংস্কৃতির লড়াই না, জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর দাবির লড়াইও তা কি তখন ভাবা গিয়েছিল? বদরুদ্দীন উমরের তিন খণ্ডের ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ শিরোনামের বইটির প্রথম খণ্ড হাতে আসার পর ব্যাপারটা নিয়ে ভাবার একটা অবকাশ তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশের বিদ্বদ্‌গোষ্ঠী এরপর বলতে থাকে ভাষা আন্দোলন থেকে যে সাংস্কৃতিক লড়াই শুরু হয়েছিল তা দেশের স্বাধীনতার লড়াইকে সম্ভব করেছিল। এবং ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই থেকে স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র তৈরির প্রেরণা এসেছিল। কিন্তু একুশে নিয়ে যত আবেগ প্রকাশ করা হয়েছে, বিশেষ করে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনকেন্দ্রিক, কোন প্রেক্ষাপটে তা ঘটেছিল তা খুঁজে বের করার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। বাঙালি জাতির সৌভাগ্য যে বদরুদ্দীন উমরকে এ উদ্দেশ্যে এক কষ্টকর ও পরিশ্রমসাধ্য কাজে ব্রতী হতে হয়েছিল। তার শ্রমের ফসল তিন খণ্ডের ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ নামে একুশের ইতিহাসের দলিল। ১৯৭০ সালে মাওলা ব্রাদার্স তার প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেছিল। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় খণ্ডও একই প্রকাশক ছেপেছিল। তবে ১৯৮৫ সালে তৃতীয় খণ্ড বের করে চট্টগ্রামের বইঘর। বর্তমান আলোচনা জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশনের নভেম্বর ১৯৯৫ মুদ্রণকে অবলম্বন করে 

করা হয়েছে। 

পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের স্বরূপকে বদরুদ্দীন উমর প্রথম খণ্ডের ভূমিকার শুরুতে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলনের কতকগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন ঘটনা এই আন্দোলনের ঐতিহাসিক মূল্য এবং তাৎপর্যকে কখনোই তুলে ধরতে পারে না। এই তাৎপর্য বিচার পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস ও তার শ্রেণী চরিত্র; পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী পর্যায়ে শ্রেণীসমূহের বিকাশ, বিন্যাস ও দ্বন্দ্ব; সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নীতি ও কর্মসূচীর মধ্যে তার অভিব্যক্তি—এ সমস্তকে বাদ দিয়ে কোনক্রমেই সম্ভব নয়। অন্য কথায় আমাদের দেশের সামগ্রিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলনকে বাদ দিয়ে যেমন অসম্পূর্ণ থাকে, ঠিক তেমনি ভাষা আন্দোলনের পর্যালোচনাও সেই পরিস্থিতিকে বাদ দিয়ে দাঁড়ায় তাৎপর্যহীন এবং অন্তঃসারশূন্য।’ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন যে হাত ধরে চলতে থাকে ভাষা আন্দোলন ও রাজনৈতিক সংগ্রামের আন্তঃসম্পর্ক তা প্রমাণ করেছিল।

উমর পথপ্রদর্শক ভূমিকা পালনের পর ভাষা আন্দোলন নিয়ে আরো অনেক বই প্রকাশ হয়েছে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের তালিকায় বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষার বই আছে। এসবের মধ্যে বশীর আল হেলালের ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ ৮০০ পৃষ্ঠার বিশাল কলেবরের গবেষণালব্ধ একটা বই। এর তিনটা খণ্ড আছে একই মলাটের ভেতর। প্রথম খণ্ডে ‘ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট’, দ্বিতীয় খণ্ড ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ এবং শেষ খণ্ড ‘বাংলা ভাষার সংস্কার-প্রয়াস’। তবে   অন্য বইগুলোর সঙ্গে উমরের বইটার মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে এর গবেষণার ফোকাস এবং বিশ্লেষণ কাঠামো।

১৯৪৮-৫২ সময়ে যেভাবে বাংলা ভাষা আন্দোলনের দাবিতে গণসংগ্রাম গড়ে উঠেছিল এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত সামগ্রিক রাজনৈতিকতা গতিশীলতা এসব বইয়ে অনুপস্থিত। তাছাড়া এসব লেখকের থেকে বদরুদ্দীন উমরের ইতিহাস সম্পকর্কে দৃষ্টিভঙ্গির যে মৌলিক পার্থক্য তা উল্লেখ করতে হবে। সমাজের গতিশীলতা ও পরিবর্তনের সঙ্গে উমর এর শ্রেণী বিভাজনের সম্পর্ক আবিষ্কার করেছেন। এ লেখার শুরুতে উমরের এ সম্পর্কিত অন্তর্দৃষ্টি উল্লেখ করা হয়েছে।  

ভাষা আন্দোলনের দুটি পর্যায়—১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চ এবং ১৯৫২-এর জানুয়ারি-মার্চ—আন্দোলনের মধ্যে সচেতনতা, ব্যাপকতা, সাংগঠনিক তৎপরতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে মৌলিক পার্থক্য তিনি লক্ষ করেছেন এবং বলেছেন যে এ তফাতকে বুঝতে হলে মধ্যবর্তী চার বছরের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতির খতিয়ান ছাড়া সম্ভব না। (১ম খণ্ড, পৃ. ৯)। তার সঙ্গে যোগ করেছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ক্রিয়াশীল দুটো রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রেণী সংগঠনের উত্থানের পটভূমি এবং তাদের অনুসৃত নীতি ও কার্যকলাপ সম্পর্কে ‘মোটামুটি’ আলোচনা ব্যতীত ভাষা আন্দোলনে চরিত্রের উপলব্ধি ও বর্ণনা সম্ভব না। (পৃ. ১০ ঐ)। তার গবেষণা পদ্ধতি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সাক্ষাৎকার ও দালিলিক প্রমাণের ওপর নির্ভর করে নির্মাণ করা হয়েছে। আজকাল ‘ওরাল হিস্ট্রি’ বলে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যেভাবে উপাদান সংগ্রহ করার একটা প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা লক্ষ করা যায় তা উমরই শুরু করেছিলেন বললে কোনো ভুল হবে না। তিনি ৬৪ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় মানুষ অনেক সময় নিজের ভূমিকাকে বড় করে দেখে বা ঝাপসা স্মৃতির কারণে ভুল করতে পারে। সেই সীমাবদ্ধতা মেনে উমর এভাবে পাওয়া কোনো তথ্য ‘ক্রস চেক’ করে নিশ্চিত হতে চেয়েছেন, যা সামাজিক গবেষণার পদ্ধতির জন্য আবশ্যকীয় এক শর্ত। প্রতিটা খণ্ডের তথ্যনির্দেশ পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে বাম ও ডানপন্থী উভয় ধারার ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার তিনি গ্রহণ করেছিলেন।

১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে দুই পর্বে একই ব্যক্তি আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন না। উমর লক্ষ করেছেন যে নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের প্রত্যেকের ভূমিকা সব পর্যায়ে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কারো গুরুত্ব প্রথম দিকে এবং কারো শেষের দিকে ছিল। ব্যক্তি বিশেষের সামগ্রিক ভূমিকা বুঝতে হলে দুই পর্বের ইতিহাস আলোচনা করা ছাড়া সম্ভব না। কমিউনিস্ট নেতা আবদুল মতিন দ্বিতীয় পর্বে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

উমরের ভাষায় আন্দোলনের প্রকৃত নায়ক হচ্ছে পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনগণ। এ উক্তির মধ্যে কোনো অতিশয়োক্তি নেই। কেননা ভাষা আন্দোলন বিকশিত হয়ে যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়া হয় তখন জনগণের সমর্থনে আন্দোলন এগিয়ে গিয়েছিল। পুরান ঢাকার অধিবাসীদের মধ্যে প্রথম পর্বে বিরোধিতা লক্ষ করা গেলেও পরের পর্বে তা সমর্থনে পরিণত হয়েছিল।  ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম-বিপ্লব গণঅংশগ্রহণ ছাড়া সফল হয় না।  

উমরের গবেষণার আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে প্রাথমিক সূত্র (চৎরসধৎু ঝড়ঁৎপব) থেকে অধিকাংশ তথ্য সংগ্রহ করা। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদ ইংরেজিতে যে ডায়েরি লিখতেন তা উমরকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। এছাড়া তার সংগ্রহের বহু ইশতাহার ও রাজনৈতিক প্রচার পুস্তিকা দিয়েছিলেন। তাজউদ্দীন একজন অন্যতম অংশগ্রহণকারী হিসেবে প্রতিদিনের যে লিখিত তথ্য রাখতেন তার বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। প্রধান অংশগ্রহণকারীদের সাক্ষাৎকার তথ্যসূত্রের এক প্রধান উৎস হিসেবে উমর ব্যবহার করেছেন। এছাড়া ১১ জনের কাছ থেকে তিনি লিখিত নোট ও চিঠি পেয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘কাগুজে তথ্য অর্থাৎ খবরের কাগজ, অন্যান্য সাময়িকী, পার্টিসমূহের দলিলপত্র, ইস্তাহার, পুস্তিকা ইত্যাদি সংগ্রহ করার জন্য আমি বস্তুতপক্ষে ১৯৬৩ সাল থেকে চেষ্টা করে আসছি। এ ব্যাপারে যখন যে সূত্রে কোন তথ্য সম্বলিত কাগজ পাওয়া সম্ভব সেখানেই আমি ব্যক্তিগতভাবে অথবা অন্যের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছি।’ (প্রথম খণ্ড, পৃ. ১০) । 

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে গিয়ে উমর কেন সে সময়ের রাজনীতির অবতারণা করেছিলেন, এ-জাতীয় প্রশ্ন উঠতে পারে। ভাষা আন্দোলন কি এক স্বতন্ত্র অস্তিত্বসম্পন্ন বিষয় ছিল না? যারা রাজনীতি ও মানবজীবনকে আলাদা ভাবে বিচার করতে চান তারা বুঝতে পারেন না যে রাজনীতির ছোঁয়া ছাড়া জীবন হয় না। রাজনীতি নিরপেক্ষ বলে কোনো প্রত্যয় অক্সিজেন ছাড়া জীবনের মতো অবাস্তব কথা। পূর্ব বাংলায় ভাষা প্রশ্ন একটা রাজনৈতিক প্রশ্ন 

ছিল। যারা বাংলার বিরোধিতা করেছেন তারা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা করেছেন। যারা ভাষার দাবি তুলেছেন তাদেরও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। ভাষা-সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের লড়াই রাজনৈতিকভাবে করা ছাড়া সাফল্য আসতে পারে না বলে ছাত্ররা প্রথম থেকে সাংগঠনিক শক্তির আশ্রয় নিয়েছে। সভা করা, ধর্মঘট করা, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া, ঢাকার বাইরে আন্দোলনের বিস্তার ঘটানো, সবই সংঘবদ্ধ হয়েই করতে হয়েছে। তবে ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি পূর্ব বাংলায় সে সময় যেসব ইস্যুতে জনগণ প্রতিবাদ-ধর্মঘট-সংগ্রাম করেছে তা সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রমাণ ছিল। ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, কর্মচারী সবাই নির্যাতিত শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের দমন-নির্যাতনের বিরোধিতা করেছেন। একটা জনগোষ্ঠীর সংগ্রামী তেজ অপর জনগোষ্ঠীর জন্য প্রেরণা ছিল। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এসব আন্দোলন সামাজিক গতিশীলতার উদাহরণ। ভাষা আন্দোলন বা কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের সংগ্রাম গণতান্ত্রিক সমাজ তৈরির আকাঙ্ক্ষা থেকেই উৎসারিত হয়েছে। 

বাংলা ভাষার সংগ্রাম-পরবর্তী সময়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষাকে পরিপুষ্ট করেছিল বলার সময় মনে রাখতে হবে যে এ ভূখণ্ডে ধারাবাহিকভাবে জনগণের যে লড়াই হয়েছে তার পেছনে এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো তৈরির লক্ষ্য ছিল। ভাষার প্রশ্ন যেমন সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের সঙ্গে জড়িত ছিল সেভাবেই কৃষক-শ্রমিকের শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই এক ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল। ভোটের ফলাফলকে অস্বীকার করা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের শুরু বলার মধ্যে আংশিক সত্য নিহিত আছে। সাতচল্লিশোত্তর জনগণের যাবতীয় লড়াই-সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল বলা কোনো অতিকথন হবে না। 

(২০২২ সালে প্রকাশিত সি আর আবরার, গোলাম মুস্তাফা, চৌধূরী মুফাদ আহমদ ও ওমর তারেক চৌধূরী সম্পাদিত ‘বদরুদ্দীন উমরের জীবন ও কাজ নিবেদিত প্রবন্ধাবলি’ গ্রন্থে সন্নিবেশিত আমার প্রবন্ধের কিছুটা সংক্ষেপিত রূপ উপরের প্রবন্ধটি)

ড. আকমল হোসেন : সাবেক অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়