সিল্করুট

অরিজিন যদি টাঙ্গাইল হয়, তাহলে ফুলিয়ার শাড়ি কেন জিআই পাবে?

ছবি : বণিক বার্তা

আপনারা তো বাংশপরম্পরায় টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরির সঙ্গে যুক্ত। আপনাদের বংশের পুরনো দিনের কথা জানতে চাই।

আমরা বসাক সম্প্রদায়। বসা কাজ করার কারণে বসাক সম্প্রদায় নামে পরিচিত। সম্প্রদায়গতভাবে আমরা তন্তুবায়। তন্তুবায় সম্প্রদায় আগে একরকম যাযাবরের মতো ছিল। আমাদের কিছু অংশ পশ্চিম বাংলায় চলে গেছে। আমাদের অনেক আগের প্রজন্ম চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কিশোরগঞ্জ হয়ে ঢাকা যায়। তারপর ঢাকা থেকে ঘুরতে ঘুরতে ধামরাই আসে। ধামরাই থেকে আবার ঘুরতে ঘুরতে চৌহাট, বাওখণ্ড হয়ে টাঙ্গাইল এসে থিতু হয়। এখানে অবস্থান নেয়ার পর—লৌহজং নদীর পাশে—যখন বসতি স্থাপন হয় তখন বোঝা গেল এখানকার জলবায়ু আমাদের শাড়ি বোনার উপযুক্ত। তার পর থেকেই আমাদের সম্প্রদায় এখানে আবাস স্থাপন করে। এখানেই শাড়ি উৎপাদন করে। টাঙ্গাইলে যেহেতু উৎপাদন করা শুরু হয়, এজন্য উৎপাদিত এ শাড়িকে টাঙ্গাইল শাড়ি বলা হয়। অন্য কোথাও উৎপাদিত শাড়িকে টাঙ্গাইল শাড়ি বলা চলে না। 

টাঙ্গাইলে যে বসাকরা আছেন তারা কখন এখানে এসেছিলেন?

আমাদের জানামতে আমাদের সম্প্রদায় ৫০০ বছর আগে বাংলায় ঢুকেছে। তবে টাঙ্গাইলে তারা বসতি গড়েছে আড়াইশ বছরের বেশি সময় আগে। 

বসাক ছাড়া টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরিতে আর কারা দক্ষ?

এখন তো সবাই, সব  শ্রেণীর লোকই এখন শাড়ি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। একটু অধ্যবসায় দিয়ে মনোনিবেশ করলে সব সম্প্রদায়ই ভালো শাড়ি তৈরি করতে পারে। অনেক মুসলমানও আছেন, তারা  খুব ভালো তাঁতি। এটা বংশপরম্পরার কাজই ছিল।  একটা সময় ছিল বসাক ছাড়া আর কেউ বানাত না। এ পেশাকে অনেকে ভয় পেত। 

এটা তো বংশপরম্পরার পেশা। এ শিক্ষা কীভাবে প্রচলিত? পরিবারের জ্যেষ্ঠরাই কি নতুনদের শেখান? আর এখানে গুরু-শিষ্য বিষয়টা আছে কি?

এই পেশাটা আসলে বংশপরম্পরাতেই প্রচলিত ছিল। একটা সময়ে যখন শিক্ষাদীক্ষা কম ছিল মানুষের মধ্যে, তখন এ সম্প্রদায়ের বাইরে কাউকে শেখানো হতো না। আমরা যেটা শুনেছি, যদিও দেখিনি তখন। আমাদের আগে অন্য কোনো সম্প্রদায় এ কাজে হাত দিতে পারত না। শেখানো হতো না। আমরা দেখেছি পরে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ঢুকে গেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের আলাদা আলাদা সম্প্রদায় আছে, মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও কারিগর, খান, মিয়া, খান মজলিস, সবাই এখন এর সঙ্গে জড়িত। আপাতত আমাদের হার আছে ৩৫ শতাংশ। বাকি ৬৫ শতাংশই মুসলিম তাঁতি। শিক্ষার দিক থেকে বলতে গেলে, আসলে দেখে দেখে শিখে অত ভালো তাঁতি হওয়া যায় না। যারা উস্তাদ তাঁতির কাছ থেকে শিক্ষা নেয়, তাদের শিল্পগুলো ভালো হয়। দেখে দেখে শিক্ষা নিয়েও অনেকে ভালো কাজ করে। তবে শিল্পী হিসেবে তারা ভালো হতে পারে না। 

পরিবারের বড়দের কাছ থেকে নতুনরা শেখেন কি?

এখন আমাদের পর্যায়টা একটু নেতিবাচক দিকে ঝুঁকেছে। শিল্পটা থিতিয়ে পড়েছে। পরবর্তী বংশধরদের অধিকাংশই অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। আসলে তো বড়দের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আসতে হয়। কিন্তু এখন আর কেউ শিক্ষা নিতে চাচ্ছে না। তাছাড়া বড়রাও শিক্ষা দিতে চাচ্ছেন না। বিভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছেন তারা। 

সম্প্রতি টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই নিয়ে আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? 

আমরা টাঙ্গাইল শাড়ি উৎপাদন করি, জিআই ট্যাগ আমাদের পাওয়াই ন্যায্যতা। কিন্তু ভারত দাবি করেছে জিআই ট্যাগ। এটা অনৈতিক ব্যাপার। তারা জিআই ট্যাগ নিয়েছে। অডিটরের কলম সবসময় ফ্রডস অ্যান্ড এররসের জায়গায় পড়ে। ঠিক তেমনি আসামি অন্যায় কিছু করে যাওয়ার সময় কোনো না কোনো একটা ভুল করে যায়। চিহ্ন রেখে যায় তার অন্যায়ের। ভারত থেকে যারা জিআই ট্যাগ নিয়েছে, তারা বলে রেখেছে স্বাধীনতার পর আমরা বাংলাদেশের টাঙ্গাইল থেকে কিছুসংখ্যক তাঁতি এসে শাড়ি উৎপাদন করি, সেটাকে টাঙ্গাইল শাড়ি নাম দিয়ে বাজারজাত করি। ওরা নিজেরাই বলছে, ওদের শেকড় টাঙ্গাইল। এখন অরিজিন যদি টাঙ্গাইল হয়, তাহলে ফুলিয়ার তাঁতের শাড়ি কেন জিআই ট্যাগ পাবে? চাইল কীভাবে। চাওয়াটাও অন্যায় ও অপরাধ। এ অপরাধের সাজা দেয়ার ক্ষমতা তো আমাদের নেই। টাঙ্গাইল বাংলাদেশের একটি উৎকৃষ্ট জেলা, যেখানে টাঙ্গাইলের শাড়ি উৎপন্ন হয়। অথচ সে শাড়িকে না দিয়ে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জিআই ট্যাগ নিয়েছে, এজন্য তারা শাস্তির পাওয়ার উপযুক্ত। আমি তাদের শাস্তি দাবি করি। ভারতের ঘোষণার পর আমরাও এখন টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্বের ঘোষণা দিয়েছি। তবে ওদের বিরুদ্ধে কীভাবে আপিল করতে পারি সেটা দেখতে হবে। 

সব মিলিয়ে এই শিল্প ও তাঁতিদের এখন কী অবস্থা?

ফ্যাশন চেঞ্জেবল, ফ্যাশনের এ যুগে শাড়ির ব্যবহার সর্বতোভাবে অনেকটা কমে গেছে। এজন্য শাড়ির বিক্রিও অনেকটা কমে গেছে। আমরা অনেকটা কঠিন সমস্যার মধ্যেই আছি। অবস্থার পরিবর্তন কীভাবে ঘটবে জানি না। ১৯৮০-৮১ সালে আমাদের ঘরে শাড়ি ছিল, বিক্রি করার টাকা ছিল না, চাল কেনার টাকা ছিল না। ঠিক সেই সময়ে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হওয়া শুরু করল। তখন ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছিল না। তবে প্রিন্ট মিডিয়া আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। যথেষ্ট প্রচার করা হয়েছে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করার জন্য। বিদেশী পণ্য বর্জন করুন—এ স্লোগানের ওপর ভিত্তি করে সমগ্র দেশে জিনিসপত্র ব্যবহারে আগ্রহ বাড়তে থাকে। তখন শাড়ি বিক্রি শুরু হয় নতুন করে। এখন আমরা যে অবস্থায় আছি, এখান থেকে উত্তরণের জন্য সব মিডিয়ার যথেষ্ট সহযোগিতা চাচ্ছি। আর সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা কামনা করছি। জিআই ট্যাগসহ আমাদের শাড়ি বাজারজাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থা, সেটা দেশে হোক বা বিদেশে, করা হোক। আমাদের এ শাড়ি উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হয় না। কিছু টাকা সরকার যদি বিনিয়োগ করে, সরকারি উপায়েই সরকার সেগুলো ফেরত পাবে। কিন্তু আমরা যারা তাঁতের সঙ্গে জড়িত, তাদের উৎপাদিত দ্রব্যগুলো যদি সরকারিভাবেই বাজারজাতের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে শিল্পটা রক্ষা করা সম্ভব। প্রত্যেকের ব্যক্তিগতভাবে বাজার সম্পর্কে ধারণা নেই। আধুনিক বাজার ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা নেই। এখানে সনাতনি পদ্ধতিতে সব কাজ চলছে। আমরা চাচ্ছি এ বিষয়ে সরকারি সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা। পাশাপাশি মিডিয়ার সহযোগিতাও চাই।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো.পারভেজ হাসান