সিল্করুট

‘টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই নিয়ে ভারত কিছু ভুল তথ্য দিয়েছে’

ছবি: সালাহউদ্দিন পলাশ

ড. হামিদা হোসেন বাংলাদেশের একজন অগ্রগামী মানবাধিকার কর্মী ও লেখক। ১৯৭৪ সালে তিনি স্থানীয় হস্তশিল্পের প্রচারণা ও বাণিজ্যিকীকরণের উদ্দেশ্যে সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কারিকা বাংলাদেশ হস্তশিল্প সমবায় ফেডারেশন লিমিটেড গোড়াপত্তন করেন। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভ বাংলার পোশাক উৎপাদনের ইতিহাস এবং কারিগরদের জীবন ও কর্মপরিবেশের ওপর একটি মৌলিক কাজ হিসেবে স্বীকৃত। পরে এ অভিসন্দর্ভ গ্রন্থাকারে ‘‌কোম্পানি উইভারস অব বেঙ্গল: দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যান্ড দি অর্গানাইজেশন অব টেক্সটাইল প্রডাকশন ইন বেঙ্গল, ১৭৫০-১৮১৩’ নামে প্রকাশিত হয়। টাঙ্গাইল শাড়ি, এর জিআই স্বীকৃতি নিয়ে ভারতের দাবি এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে হামিদা হোসেন সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শানজিদ অর্ণব

টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের সংস্কৃতি বা নারীদের পোশাক হিসেবে বিশেষ মর্যাদা পেয়ে আসছে। কিন্তু এখন শাড়ি পরা বা বিক্রি হ্রাসের একটি কথা শোনা যায়। আমাদের টাঙ্গাইল শাড়ির ভবিষ্যৎ কী?

শাড়ি ব্যবহার বা বিক্রির প্রচলন কমে যাচ্ছে, এর কোনো প্রমাণ কিন্তু আমরা পাচ্ছি না। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বা কর্মজীবী নারী আছেন তারা সাধারণত কামিজ ও শাড়ি পরে থাকেন। ইউনিভার্সিটিতে বয়স কম থাকে, তখন সালোয়ার কামিজ পরে, এরপর বয়স বাড়তে থাকলে কর্মজীবনে প্রবেশ করলে তারা শাড়ি পরতে শুরু করে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এটি বেশি দেখা যায়।

টাঙ্গাইল শাড়ির কথা যদি বলি এখন পত্রপত্রিকা থেকে এর জনপ্রিয়তা নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়। তবে আমি যদি আরো ২০-২৫ বছর আগের কথা বলি তাহলে ঢাকার বেইলি রোডে তখন শুধু একটি টাঙ্গাইল শাড়ির দোকান ছিল—মুনিরা ইমদাদের টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির। কিন্তু এখন বেইলি রোডের দুই পাশে টাঙ্গাইল শাড়ির অনেক দোকান হয়েছে। নামও লেখা থাকে টাঙ্গাইল শাড়ি। ঢাকায় তাই বলা যায় টাঙ্গাইল শাড়ির জনপ্রিয়তা বেড়েছে ২০-২৫ ধরে।

১ ফেব্রুয়ারি আমরা জানতে পারি ভারতের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় দাবি করে টাঙ্গাইল শাড়ি তাদের দেশের, টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি বাংলাদেশে নয়, বরং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। নিজেদের জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা জিআই পণ্য হিসেবেও শাড়িকে স্বীকৃতি দিয়েছে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে আপনার মতামত জানতে চাই।

জিআই দেয়া হয় এলাকাভিত্তিক। সেজন্য দেখা হয় সে এলাকায় কারা কাজ করছে, কাদের দক্ষতা আছে ও কীভাবে কাজ হচ্ছে। সে পদ্ধতিতে কোনো বিশেষ কোয়ালিটি আছে কিনা। আমাদের টাঙ্গাইল শাড়ির একটি ইতিহাস আছে। কীভাবে নারীরা সুতো তৈরি করেন। এটি একটি পরিবার মিলে কাজ করত। সুতা তৈরির পরে তারা বিক্রিও করত। টাঙ্গাইল শাড়ি জঙ্গলবাড়ী, বাজিতপুর, তিতাবাড়ী ইত্যাদি বিভিন্ন এলাকায় হতো। জায়গাটি কিন্তু আমাদের এখানেই পশ্চিমবঙ্গে নয়।

এখানে ভারত কিছু ভুল তথ্য দিয়েছে। এটা ঠিক যে কয়েকজন তাঁতি ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এখান থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছে। এর পরও তারা আবার এখানে এসেছে। এদের একটা আসা-যাওয়া, মুভমেন্টের ব্যাপার ছিল।

ভারত টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এটি আমি দেশীয় সংবাদমাধ্যমে জানতে পারি। আমি জানি না কেন আমরা এত বছর এটি নিয়ে চুপ করে বসে আছি। এখন আমাদের শিল্প মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বলা হচ্ছে এ বিষয়ে আবেদন করা হবে। আজ (৮ ফেব্রুয়ারি) টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্বের ঘোষণা দিয়ে জার্নাল প্রকাশ করেছে আমাদের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। আমাদের হাতে এখনো সময় আছে। ভারত টাঙ্গাইল শাড়িকে জাতীয়ভাবে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে, তবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এখনো আমাদের সুযোগ আছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থায় লোক পাঠিয়ে দরকারি কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। এর সঙ্গে তাঁতিদেরও বোঝাতে হবে। তারা যে কাজ করছেন সেটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং কীভাবে তাদের এ কাজকে আরো সমৃদ্ধ করা যেতে পারে। এসব নিয়ে প্রচারও বাড়াতে হবে।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধেও ধামরাইতে মসলিন তৈরি করেন বা তাদের উত্তরসূরি তাঁতি পরিবারগুলোর বসতি ছিল। মসলিনের পতনের পরিপ্রক্ষিতে সে শতকের শেষের দিকে টাঙ্গাইলের জমিদারদের আমন্ত্রণে তারা দেলদুয়ার, সন্তোষ ও ঘারিন্দায় চলে যান। তাদের হাতেই তৈরি হয় টাঙ্গাইল শাড়ি। আপনি ঔপনিবেশিক আমলে বাংলার তাঁতিদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। এ বিষয়ে আপনার ‘দ্য কোম্পানি ওয়েভার্স অব বেঙ্গল’ বইটিকে মান্য বিবেচনা করা হয়। ঔপনিবেশিক আমলে ঢাকা বা সংলগ্ন এলাকার তাঁতিদের জীবন কীভাবে বদলে গিয়েছিল বা তাদের পরিস্থিতি কেমন হয়েছিল?

ঔপনিবেশিক আমলেও শাড়ির বাজার ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চেয়েছিল বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে। তখন দাদন সিস্টেম ছিল অর্থাৎ তাঁতিদের অগ্রিম টাকা দেয়া হতো। কোম্পানি এসে দালালদের মাধ্যমে এ বাজার নিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু এ পদ্ধতিতে তাদের খুব বেশি লাভ হয়নি। কারণ দালালদের একটা স্বাধীনতা ছিল। তারা নিজেরা বেশ লাভবান হতো। তাই কোম্পানি দালাল ব্যবস্থা বাদ দিয়ে গোমস্তা নিয়োগ করে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ শুরু করল। তারা তাঁতিদের কাজের সব এলাকাগুলোয় নিজেদের লোক ঠিক করল। প্রত্যেক আড়ংয়ে কোম্পানি থেকে তাঁতি নিয়োগ দেয়া হতো এবং তাদের বলা হতো কোম্পানির তাঁতি। ফলে স্থানীয় তাঁতিদের ওপর অনেক টাকা-পয়সার চাপ রাখা হতো এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ব্যবসায়ের জন্য স্বাধীনতা থাকা খুব দরকার, যা সে সময়ে ছিল না।

আধুনিক কারখানা, প্রযুক্তির যুগে তাঁতের শাড়ির মতো বিশেষ ঐতিহ্য, তা সে টাঙ্গাইল কিংবা জামদানি যা-ই হোক, টিকিয়ে রাখতে বিশেষ উদ্যোগের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন কি?

এ আধুনিক সময়ে সবাই আধুনিক কাজে চলে যেতে চায়। পরিশ্রমের মূল্য আগের মতো আর নেই। তবু তাঁতিদের পক্ষ থেকে চেষ্টা চলছে। এ কাজ থেকেই তাঁতিদের মূল আয় হয়। গ্রামে গেলে দেখা মিলবে যেখানে কাজ হচ্ছে, একজন মাস্টার তাঁতির সঙ্গে আরো বেশকিছু তাঁতি থাকেন। নারীরা সুতো তৈরি করেন, সঙ্গে ডায়িংয়ের কাজও করেন। অনেকজন জড়িয়ে আছে এ কাজের সঙ্গে। অনেকে বলছেন জামদানি শাড়ির নকশা টাঙ্গাইল শাড়িতে ব্যবহার হচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ ভুল একটি তথ্য। টাঙ্গাইল শাড়ির নকশা আলাদা এবং একটি আলাদা ধরন আছে। টাঙ্গাইল শাড়ি তার পাড়ের নকশার জন্য বিখ্যাত। টাঙ্গাইল শাড়ির ব্যবহার স্থানীয়ভাবে বা বাংলাদেশী নারীরা বেশি করেন। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায়ও এ শাড়ি দেখা যায়।

বাংলাদেশে তাঁত শিল্পের আর কোনো বিশেষ পণ্যের জিআই নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন?

আসলে এখানে সবসময় একটি প্রতিযোগিতা আছে। আমাদের সঙ্গে ভারতের। আমরা কী করছি এবং ভারত কী করছে এ বিষয়গুলো নিয়ে। জামদানি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কারণ আমরা অনেক পরিশ্রম করেছিলাম বিষয়টি নিয়ে। যেসব জায়গায় আবেদন করতে হয় আমরা সেসব করেছিলাম। মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সব দপ্তরে আবেদন করা হয়েছিল। একটি বড় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যেখানে সরকারেরও অবদান ছিল। তেমনিভাবে টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে জিআই স্বীকৃতি পেতে এভাবে এগিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের অনেক কিছু ভাবতে হয়। কেন জিআই দেয়া হচ্ছে, কোন এলাকাভিত্তিক এটি হচ্ছে। বিষয়গুলো বুঝতে আমার মনে হয় আরো গবেষণা দরকার।