সিল্করুট

টাঙ্গাইল শাড়ির সাতসতেরো

শফিকুল কবীর চন্দন

ছবি : বণিক বার্তা

একসময় বাংলাদেশের খ্যাতি ও গৌরব ছিল মসলিন এবং জামদানির জন্য। তন্মধ্যে জামদানি টিকে থাকলেও মসলিন এখন শুধুই ইতিহাসের সামগ্রী। তবে মসলিন ও জামদানি শাড়ির পর বাংলাদেশের বস্ত্র খাতে টাঙ্গাইল শাড়ি নতুন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়েছে। কেমন করে? তাহলে আসুন সে কথা শুনি বসাক তাঁতি, গবেষকের কথায়—

‘‌বাংলার তাঁতের কাপড়ের নবতর উদ্ভাবন ‘‌‘‌টাঙ্গাইল শাড়ি’’। বয়নশিল্পে বাংলার সুখ্যাতি তো সেই কোন সুদূর অতীতকাল থেকেই—মসলিন, জামদানি, বালুচরি, শান্তিপুরী, ধনেখালি, বেগমপুরি....। সুচিক্কন সূক্ষ্মতায়, পেলব-স্নিগ্ধতায়, স্পর্শ-মধুরতায়, শিল্পের সৌকর্যে, নকশার কারুকার্যে, ঘরানার বৈশিষ্ট্যে প্রত্যেকেই ছিল স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। পরিপার্শ্ব-পরিবেশ পরিপ্রেক্ষিতে বয়ন-কারিগরের চিন্তন প্রসূত ধারায় সৃষ্টি হয়েছে এক একটি ঘরানা। গুণমান, মূল্যমানের বিচারে যার যেমন সাধ্য সেই মতো পরিধান ব্যবহার করে এসেছেন রাজ-অন্তঃপুরিকা থেকে অতি সাধারণ রমণীকূল। বঙ্গের শাড়ি-সরণিতে ‘‘‌‌টাঙ্গাইল’’ ঘরানা নিতান্ত নবাগত এবং এখন পর্যন্ত সর্বকনিষ্ঠ, বয়স একশো তিরিশ বছরের কিছু কম বেশি। বয়সে নবীন হলেও কৌলিন্যে তার স্টেষন মোটেই নিচুতে নয়। গুণে-মানে-দামে তার আসন নির্দিষ্ট হয়ে গেছে মসলিন, জামদানি, বালুছড়ির পরেই অর্থাৎ চতুর্থ স্থানে। কোনও বসনের উৎকৃষ্টতর বিচারে যে যে মানদণ্ড বিবেচ্য, সেগুলির পরিপ্রেক্ষিতেই নির্দ্বিধায় এ কথা বলা যায়।১

টাঙ্গাইল শাড়ির বয়স তার ইতিহাস নিয়ে সংক্ষেপে এভাবেও জানা যায়। 

‌As mentioned before, the homespun muslin thread was the domain of Hindu weavers of tantis, who, after the fall in the trade of fine Muslin, gradually migrated from Dhaka to present-day Tangail and neighburing Bajitpur, which also become famous as a centre of fine cotton saris.২

টাঙ্গাইল শাড়ির খ্যাতি তার সূক্ষ্ম বুনট, মিহি বস্ত্র, পাড়ের নকশার কারণে। এ কৃতিত্ব মূলত বসাক তাঁতিদের। বিশ শতকের প্রথমার্ধে ঢাকার নাগরিক হাকিম হাবিবুর রহমানেই প্রদত্ত বিবরণ তথা সূক্ষ্ম কাপড় উৎপাদন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘‌কাগমারি পরগনা, যা পশ্চিম ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল মহকুমার প্রসিদ্ধ জায়গা, সূক্ষ্ম কাপড় তৈরির ব্যাপারে প্রসিদ্ধি লাভ করে।’

লাল শাড়ীতে লাগে তারে অনেক বেশী ভালো

নীল শাড়ীতে জ্বলে যেন জ্যোৎস্না চাঁদের আলো।

...

শাড়ী হল বাঙালীর চিরন্তনী পোশাক 

সবার আগে শাড়ী, অন্যগুলোও থাক।

জামদানি, মসলিন, টাঙ্গাইল, তাঁতের শাড়ী 

আমরা বাঙালী তাই ছাড়তে নাহি পাড়ি।।৩ 

টাঙ্গাইল শাড়ি সমাচার

আমার ঘর; আমার বাড়ি, 

গর্বের ধন টাঙ্গাইল শাড়ি’

প্রকৃতপক্ষে টাঙ্গাইল শাড়ি জেলার গর্বের বস্তু। টাঙ্গাইলের শাড়ির কদর দেশ জোড়া। শাড়ি বাংলা সাহিত্যের নানা শাখায় স্থান করে নিয়েছে। প্রেমময়ী স্ত্রী, মা, দাদি, নানি থেকে যেকোনো বয়সের যেকোনো নারী শাড়ির অবগুণ্ঠনে বা শাড়ির সাহচর্যে হয়ে উঠেছেন রূপলাবণ্যে লাস্যময়ী। ঢাকাই শাড়ি চাইতে সলজ্জ প্রিয়জন একেবারেই নির্লজ্জ যেমন, তেমনি আদরে আবদারের উপহারের নাম যেন হয় শাড়ি। হোক তা ঢাকাই বা টাঙ্গাইল শাড়ি। ঢাকাই শাড়িই কি টাঙ্গাইল শাড়ি? নাকি আছে কোনো ভিন্নতা? বা টাঙ্গাইল শাড়িই ঢাকাই শাড়ির মান্যতা? এমন সব উত্তরের সোজাসাপ্টা উত্তর দেয়া বা পাওয়া খুব সহজ নয় মোটেও। তবে অতীত ঘেটে তার কিছুটা সুলুকসন্ধান করা যেতেই পারে।

বাংলা সাহিত্যের গল্প উপন্যাসে কবিতায় টাঙ্গাইল শাড়ির প্রসঙ্গ লক্ষণীয়। 

‌টাংগাইল লাল সাদা তাঁতের ডুরে শাড়িটি শরীরে জড়াতেই, মনের ময়ুর পাখা মেলে উড়তে চাইল নীলাকাশে বিছানাটা ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নেই

    —অরণ্য আমার অরণ্য, লিলি হক

কবি রুবি রহমান রহস্যময় দুর্ঘটনায় একই সঙ্গে মানবদরদি স্বামী শ্রমিক নেতা নূরুল ইসলাম ও একমাত্র পুত্র তমোহর ইসলামকে হারান। কবি রুবি রহমানের অন্তর নিঃসৃত এ সংবাদ শুধু তাঁতশিল্পীর জন্য নয় সবার জন্য—কবিতায় হৃদয় নিংড়ে কান্না ঢেলে দিয়েছেন কবি।

‘ও টাঙ্গাইলের তাঁতী

আমার ঘরে নিভেছে আজ বাতি।’

‘‌কি শাড়ি পড়েছো? টাঙ্গাইল তাঁত তো? জানি। দামটা হয়তো সস্তা। কিন্তু চমৎকার লাগে। কিরকম একটা অশরীরী খসখস আওয়াজ বাজে।’৪

‌‘একটা সারপ্রাইজ দিলাম। বাজার থেকে শাড়ি কিনে আনলাম একটা। হালকা সবুজ টাঙ্গাইল শাড়ি। দাম এখনও মনে আছে। সত্তর টাকা। গিন্নিকে সারা জীবনে সাকুল্যে যে তিনটি শাড়ি উপহার দিয়েছি, এটি তার অন্যতম।’৫

‘আমি অনেক ভেবে চিনতে এই দিশি তাঁতের টাঙ্গাইল শাড়ি সিলেকশন করলাম। নামেই টাঙ্গাইল এখন নবদ্বীপে রিফিউজিরা তৈরী করছে।’৬

শাড়ির সাকিন টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইলের বস্ত্রশিল্প যেমন বসাক তাঁতিদের মেধা শ্রম পেয়েছে, তেমনি মুসলিম কারিগরদের (জোলা) শ্রম ঘাম দক্ষতায় তার সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হয়েছে। টাঙ্গাইল জেলার তাঁতবহুল গ্রামগুলো হচ্ছে নলশোঁধা বাজিতপুর, চন্ডী, পাথরাইল, বেড়াই, দশাইকা, বেড়াবচুনা, ঘাড়িন্দা, ব্রাহ্মণকুশিয়া, সুরুজ, বরুরিয়া, কোকডহরা, বলদি, বল্লারামপুর, ভুক্তা, তারটিয়া ইত্যাদি গ্রামের ২২ মৌজার অধিকাংশ বাসিন্দাই তাঁতি সম্প্রদায়ের লোক ছিল। তাছাড়া বিন্নাফৈর, তাইত্যা, জোয়াইর, রতনগঞ্জ, বার্থা, গোসাই, নলুয়া, দেওজান, বেলতা, গড়াসিন, সন্তোষ, কাগমারি, বল্লা, রামপুর, বাংরা, টাঙ্গাইল তাঁত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত।

এসব গ্রামের তাঁতিরা বংশানুক্রমে যুগের পর যুগ ধরে বুনে আসছেন ঐতিহ্যের টাঙ্গাইল শাড়ি। অনেক পুরনো একটা ঐতিহ্যের ধারায় চলছে এ কাজ। এভাবেই হাজার বছরের ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে শত প্রতিকূলতা ও প্রতিযোগিতাকে পেছনে ফেলেও স্বীয় ঐতিহ্য ধরে রেখে এ বিংশ শতাব্দীতেও বাঙালি নারীর প্রথম পছন্দের তালিকায় রয়েছে টাঙ্গাইল শাড়ি। লোকমুখে একটি প্রচলিত কথা প্রায়ই শোনা যায়—

‌‌নদী চর খাল বিল গজারির বন 

টাঙ্গাইল শাড়ি তার গর্বের ধন।

পশ্চিমবঙ্গের ফুলিয়ায় টাঙ্গাইল ঘরানার শাড়ি বোনেন অভিবাসী বসাকজনেরা। তাদের নতুন পরিচয়ের আখ্যান রচনায় সেই টাঙ্গাইলের পরিচিতির মতোই—

‌কৃত্তিবাসের ফুলিয়া জানে সর্বজন

টাঙ্গাইল শাড়ি তার গর্বের ধন।

টাঙ্গাইল শাড়ির কথকতা

একটা অঞ্চলের এমনকি একটি পরিবারের কারিগরি দক্ষতা দিন দিন ঠিক কোন উচ্চতায়, অভিনবত্বে, বিশেষত্বে পৌঁছে সৃষ্টিকর্মকে বিশেষায়িত নন্দনগুণান্বিত করে তা বাইরের জনসমাজ খুব সহজে ঠাহর করতে পারবে না। উপকরণের ব্যতিক্রমী ব্যবহার স্বচ্ছন্দে পণ্যকৃতি হয়ে উঠতে পারে মনোহর। ধীরে ধীরে বংশপরম্পরায় কত যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম করণকৌশল তথা কারুদক্ষতা দিয়ে শৈলীর রূপান্তর ঘটান সেসব কথা খুব বেশি লিখিত থাকে না। টাঙ্গাইল শাড়ি বয়নের ক্ষেত্রে অলখ্যে ঘটে যাওয়া এমন বহু ঘটনা এ শাড়ি বয়নের উৎকৃষ্টতায় অবদান রেখেছে। এসব কথা আপামর কারিগরি সমাজ স্মৃতি শ্রুতিতে বংশানুক্রমে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। প্রবাদপ্রতিম সেসব কথা গল্পগাথা হয়ে বিরাজ করে তাঁতি কারিগর সমাজে।

দিনের পর দিন তাঁতিদের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, তাদের নিরলস শ্রম, তাঁত শাড়ির প্রতি মমত্ববোধ সবকিছু মিলেটিলে টাঙ্গাইল শাড়ি আজকের রূপ পরিগ্রহ করেছে।

‌শাড়িগুলো ছিল মাঠা পাড়, নানা ছিটা ও বল বুটি। বেশিরভাগ জমিন হত সাদা। দাইহাটের তাঁতিদের মধ্যে একজনের মাছ ধরার নেশা ছিল। তাঁর বড়শির সুতা ছিল সোনালী রঙের। খুব শক্ত সুতা। নদীতে বড় বড় মাছ ঐ সুতার সাহায্যে টেনে তোলা যেত। হরিদাস বসাকের ঐ বড়শির সুতা নজর এড়ালো না। জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারল ওটা মুগা সুতা। দাইহাটের তাঁতিরা মালদা থেকে গুটি সংগ্রহ করে বাড়িতেই গুটি থেকেই রেশম বের করত। হরিদাস বসাক বড়শির সুতার উৎস ধরে কামরূপ জেলার শেয়ালকুচি গ্রামে হাজির হল। সেখান থেকে ১২৫ টাকা দরে কিনে এনে টাঙ্গাইল শাড়ির জমিনে দশঘর সুতা আর দশঘর মুগার ডুরে শাড়ি বানিয়ে ফেলল। তারপর লালপাড় পুরো মুগা শাড়ি বানিয়ে বাজারে বের করল।৭

‌মন পড়ল ডিজাইনে, নকশা তৈরিতে। তাঁতঘরের পাশেই আলাদা ঘর নিলেন। আর দেখে কে! সৃষ্টিশীলতার ঘোড়া তখন ঘোড়া দৌড়াচ্ছে ঝর্ণা কলমে, কাগজে, গ্রাফ পেপারে..

বাংলাদেশে, একই সাথে এ দেশেও সংসার, সমাজ জীবন তথা প্রকৃতি নিয়ে যে কল্পনার জগৎ গড়ে উঠেছিল তাঁর মধ্যে তাই ডিজাইন হয়ে উঠল। ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হয়ে উঠল। শাড়িতে, পাড়ে, আঁচলে ধরা দিল কালক্রমে। প্রকৃত শিল্পীরা কাজের প্রতি নেশাগ্রস্ত হন। কবি, চিত্রকর, বিজ্ঞানীরা যেমন পাগল হন, এঁরাও যে তেমনই। বাঁদিকে ডানদিকে চৌকির ওপরে নিচে যেদিকেই তাকাই স্তূপীকৃত কাগজ, গ্রাফ পেপার! চৌকির ওপরে ডেস্ক। তার ওপর উপুড় হল দুটো চোখ, উপুড় হল অসংখ্য মুহূর্ত, কল্পনা, দৈনন্দিনতা। অগুনতি চৌকো খোপ পেন্সিল পূরণ হতেই নকশার ঢেউ উঠল। বড় ছোট কলকা, বুটির সে দৌড় সামলাতে লাগাতে হল কাগজের গায়ে কাগজ, তার গায়ে কাগজ, তার গায়ে...৮

অন্য বঙ্গে ‘‌একখণ্ড টাঙ্গাইল’ ও শাড়ি 

‘‌যদি হই চোর কাঁটা ওই শাড়ির ভাঁজে, দুষ্টু যে হয় এমন কাজ তো তারই সাজে।’ মহানায়ক উত্তমকুমারের ঠোঁটে কিশোরকুমারের গাওয়া ‘অমানুষ’ ছবির গানটা শুনেছেন? শর্মিলা ঠাকুর সে দৃশ্যে ‘‌ডবি’ নকশায় বোনা হলুদ রঙের যে তাঁতের শাড়িটা পরেছিলেন, সেটি কার জানেন? কিংবা, ‘‌এ বার মলে সুতো হবো, তাঁতির ঘরে জন্ম লবো, পাছা পেড়ে শাড়ী হয়ে দুলবো তোমার কোমরে, তোমরা যে যা বল আমারে।’ মৌচাক সিনেমায় উত্তমকুমারের লিপে মান্না দের গাওয়া গানটি হয়তো শুনেছেন। ওই দৃশ্যে সাবিত্রী যে শাড়িটি পরেছিলেন, সেটির স্রষ্টা কে জানেন? তার নাম নির্মল ভট্টাচার্য্য। ধাত্রীগ্রামের সবাই যাকে চেনেন নির্মল ঠাকুর নামে। অন্ধকারে আলো হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন নির্মল।

ধাত্রীগ্রামে তখন বাংলাদেশ থেকে আসা তন্তুবায়দের বাস। তারা টাঙ্গাইল শাড়ি বোনেন। কিন্তু খুবই অল্প দামে বিক্রি হয়। তবু কোনোমতে সংসার চলে যায়। বাঁচার তাগিদে নির্মল ভেবেছিলেন তাঁত বোনা শিখবেন। কিন্তু বামুনের ছেলেকে কেউ তাঁত বোনা শেখাতে চাননি, পাপ হবে ভেবে। নাছোড়বান্দা নির্মলবাবু তাঁত বোনা শিখেছিলেন শান্তিলাল বসাকের কাছ থেকে। শান্তিলাল বাবুও ছিলেন ময়মনসিংহের একই গ্রামের মানুষ। মুলিবাঁশ আর বেড়া দিয়ে তৈরি করা বাড়িতে নিজের তাঁত বসিয়েছিলেন নির্মলবাবু। জন্ম নিয়েছিলেন ব্রাহ্মণ ঘরে, হয়ে গিয়েছিলেন পেশাদার তন্তুবায়। বুনতে শুরু করেছিলেন অনবদ্য টাঙ্গাইল শাড়ি। নিজে হাতে তাঁত বুনেছেন প্রায় ১০ বছর। টাঙ্গাইল শাড়িতে তিনি এনেছিলেন অসাধারণ বৈচিত্র্য। পাটলি পাল্লু, গিলা বুটি, মুগা ডুরে, মীরা নামের শাড়িগুলো যেন প্রাণ পেত নির্মলবাবুর হাতে।

হাইব্রিড টাঙ্গাইল শাড়ি, কান তব্দা পাওয়ারলুমে

‌‌খাঁটি তাঁতের শাড়ি ক্রমশ অতি ধনীর বিলাসবস্ত্র হয়ে উঠবে। বাংলার পল্লী প্রকৃতি সমাজজীবন, ঘরকন্নার সঙ্গে বাঙালি মেয়ের আটপৌরে বসনের সংযোগ ক্রমে মিলিয়ে যাবে। নববর্ষে অভিজাত ক্লাবে বিতর্ক সভা হবে, ‘‌বাঙালি কি তার ঐতিহ্য হারিয়েছে?’ পাওয়ার লুমে বোনা পলিয়েস্টার জামদানি পরে শুনতে যাবে বঙ্গললনা।৯ 

অবশ্য এখনই আকছার এসব যে ঘটছে তা বলাই বাহুল্য। 

‌‘টাকা দিয়ে কাপড় কিনতে কয়েক মিনিট হয়তো লাগে কিন্তু এই একটি কাপড় বানাতে তাঁতির লাগে কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ। তুলোর মাঠ থেকে দোকানের খরিদ্দার অব্দি পৌঁছাতে একখণ্ড কাপড়ের জন্য কয়েক হাজার লিটার ভৌমজলের দরকার হয়। যে গতিতে আমাদের হাতে টাকা থাকলে বস্ত্র খরিদ করি সেই গতিতে একজন তাঁতি থেকে দর্জির কাজ করা সম্ভবপর নয়। এসব জানা যেন আমাদের ক্রয় ইচ্ছার কাছে মাথা নিচু করে থাকে! সেখানে মাথা উজিয়ে থাকে পুঁজিকর্তৃত্বের আলোচনা। হাতে তাঁতি বোনে কাপড় তৈরি করতে তাঁতির অনেক সময় লাগে। মানুষ যে হারে বস্ত্র চায়, সে হারে হস্ত তাঁতে বস্ত্র বোনার সাধ্য নেই। কাজেই যন্ত্র তাঁত আনো, সেই তাঁতের উপযোগী সুতা দরকার, কাজেই পলিয়েস্টারসহ নানা কৃত্রিম সুতায় বস্ত্র বোনাও। হস্ত তাঁত কারিগর কাজ হারাক, অনাহারে মরুক! নয়া জমানায় বস্ত্রমাল তৈরির ও কেনাবেচার হিড়িক উঠুক। মানুষ সস্তায় গা ভাসিয়ে পকেট উজাড় করুক সাথে প্রাণ প্রকৃতিও। কলের পক্ষে দাঁড়িয়ে মানুষ বলতে থাকবে অনায়াসে—চাহিদা অনুযায়ী বস্ত্র যোগানের সাথে তাঁতি অপারগ।’

আমরা জানি অতীতে গ্রামগঞ্জে মহামারীর বিস্তারে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। যার মধ্যে সবচেয়ে ভোগান্তি ছিল কলেরা। আজকের দিনে হস্ত তাঁত অঞ্চলে মহামারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যন্ত্রচালিত তাঁত বা পাওয়ার লুম। গত কয়েক দশকে এ যন্ত্রদানবের প্রাদুর্ভাবে গ্রামকে গ্রাম এর শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী তাঁত-তাঁতি উজাড় হয়ে গেল! শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি, গামছা সব বুনছে কল। এমনকি বিশেষায়িত বস্ত্র জামদানি, টাঙ্গাইল বুটি শাড়ি সবই বোনা হচ্ছে পাওয়ার লুমে। তাঁতিরা এখন সেই কলের সুইচ টেপে! সেখানে তাঁতির কোনো মুনশিয়ানার বালাই নেই।

এরই মধ্যে জানা যাচ্ছে, যন্ত্রচালিত তাঁত দেহ-মনের অচলাবস্থার অশুভ বার্তা বয়ে আনছে। অনেকের ভাষ্য, একজন কানে কম শুনছে তো অন্যজন একবলায় কথা শুনতে-বুঝতে পারছে না। অবিরত তাঁতযন্ত্রের শব্দ সন্ত্রাসে মস্তিষ্কের পীড়ন থেকে ঘুমের ব্যাঘাত, কানে সবসময় রকমারি আওয়াজের জের। এ নয়া উপসর্গের ভাব, ভাষা অনেকেই যেমন বুঝতে পারেন না, তেমন ভুক্তভোগীও বুঝাতে অক্ষম যেন। সমাজে বোঝার সক্ষমতা আসতে আসতে হয়তো বড্ড দেরি হয়ে যাবে।

‌টাঙ্গাইলের হস্ত তাঁতে, শাড়ি মনোরম জমিন পাড়ে;

নকশা ফোটে শাড়ির বাহারে, দেশ বৈদেশের প্রান্ত জুড়ে।

এমন এক কান্ড হইলো, হাইব্রিড শাড়ি হচ্ছে কলে;

টাঙ্গাইল শাড়ি রইলো ঢেকে, পাওয়ারলুমের ভ্রান্তি বলে।

রকম সকম পাড় জমিনের, শাড়ী জন্মাতে লাগলো;

তাই দেখে সব আদি শাড়ি, অভিমানে মগ্ন হয়ে রইলো।

রকম সকম রঙ সুতার ব্যাপার, গুমর আরও আছে;

পলিয়েস্টার সুতি চটকদার, দেদারসে বিকিয়ে সব যাচ্ছে।১০

হাতেগোনা হাত তাঁত সচলের এ কালে পাওয়ারলুমে বোনা বাংলাদেশে আজকের টাঙ্গাইল শাড়ি তার নকশা-বয়নে-বাহানায় ‘‌হাইব্রিড’, এ কথা বলাই বোধ করি সংগত! চোখ কপালে উঠে যাওয়ার কিছু নেই! টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি বলে যা বাজারে বিকাচ্ছে সেসবের সিংহভাগকেই আজ আর বসাক বাড়ির বউ-ঝিদের সহায়তায়, তাঁতিদের বোনা এ কথা বুকে হাত দিয়ে দোকানির বলার কোনো অবকাশ নেই! এটাই সত্যি! এটাই বাস্তব! কার্পাস, কাটনি, তাঁতির সঙ্গে মসলিন যেমন বিলীন হয়েছে, তেমনি একবার হস্ত তাঁত, তাঁতি বিলীন হলে বিলীন হবে ঐতিহ্যবাহী জামদানি, টাঙ্গাইল শাড়িও।

‌কারও-দুঃখের টানা সুখের পোড়েন-বড়োই অবিরাম-

মন মাকুতে চলছে বুনে- চলছে অবিরাম-।

সাধের সুতো ছিঁড়ে গেছে, 

ভেঙেছে ধৈর্য্য-সানা ... 

জীবনটা ভাই 

সুখ দুঃখের এক রঙিন তাঁত বোনা-।।১১

উদ্ধৃতি সূত্র

১. হরিপদ বসাক।

২. Zulekha Haque, ‘Sari: Cotton and Silk’, Textile traditions of Bangladesh, National craft council of Bangladesh, Dhaka, 2006, p. 68.

৩. শাড়ি ও প্রিয়া, সৌরভ শুভ (কৌশিক)।

৪. ফুলেশ্বরী, ইন্দু সাহা।

৫. ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, টুকরোগুলো। 

৬. শংকর—ঘরের মধ্যে ঘর।

৭. টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিকথা, সুশীল চন্দ্র বসাক, টানাপোড়েন

৮. এক চার তিন বাদ দুই, স্মরণে শিল্পী যামিনীকান্ত বসাক, অনিন্দ্য মোদক, টানাপোড়েন।

৯. স্বাতী ভট্টাচার্য। 

১০. শফিকুল কবীর চন্দন।

১১. গান, জীবনকৃষ্ণ মজুমদার, টানাপোড়েন।

শফিকুল কবীর চন্দন: শিল্পী ও গবেষক