সিল্করুট

বার্মার শেষ রাজা থিবাউ মিন

আহমেদ দীন রুমি

থিবাউকে গ্রেফতার করতে এসেছেন ব্রিটিশ কর্মকর্তা প্রেনডারগাস্ট শিল্পী: মেল্টন প্রায়র। দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ, ৩০ জানুয়ারি, ১৮৮৬

কোনবাউং রাজবংশের শেষ রাজা থিবাউ মিন। আর রাজতান্ত্রিক বার্মার ইতিহাসে শেষতম রাজবংশ কোনবাউং রাজবংশ। টংগু রাজবংশের পরবর্তী সময়ে মিয়ানমার যখন বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। সে সময়টায়ই ১৭৫২ সালে শোয়েবোর এক গ্রাম্য নেতা আলংপায়া সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেন। মিয়ানমারের দক্ষিণাংশে মন শাসকদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করেন সফল সামরিক অভিযান। এভাবে মিয়ানমারকে তিনি একত্র করতে থাকেন। তার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশটি তৃতীয় রাজা হসিনবিয়ুশিনের পর থেকেই প্রতাপশালী রূপ লাভ করে। ১৭৬৪ সালে এ রাজা হসিনবিয়ুশিন রাজ্যে শৃঙ্খলা স্থাপন করেন। তার সেনাবাহিনী শান ও লাও রাজ্য এবং মণিপুর রাজ্যের (বর্তমানে ভারতের একটি প্রদেশ) অনেক গভীরে চলে যেতে সক্ষম হয়। চারবার মিয়ানমারের ওপর চীনা আক্রমণ প্রতিহত করেন তিনি। ষষ্ঠ রাজা বোদওপয়া ১৭৮২-১৮১৯ পর্যন্ত রাজত্ব করেন, তার সময়ে রাজধানী সরিয়ে নেয়া হয় অমরপুরে। বোদওপয়ার পৌত্র বাগিদও (১৮১৯-২৬ খিস্টাব্দ) এর আমলেই প্রথম ইঙ্গ-বর্মি যুদ্ধে (১৮২৪-২৬) মিয়ানমার ব্রিটিশদের হাতে পরাজয় বরণ করে।

এর পর থেকে মিয়ানমারের রাজত্বের পরিধি কমতে থাকে। কমতে থাকে প্রশাসনের ক্ষমতাও। রাজা থারাওয়াদি ও তার পুত্র পাগান দুজনেই ছিলেন শাসক হিসেবে দুর্বল। ফলে ১৮৫২ সালে অর্থাৎ রাজ্য প্রতিষ্ঠার শতবর্ষের মাথায়ই দ্বিতীয় ইঙ্গ-বর্মি যুদ্ধতে ব্রিটিশরা সমগ্র দক্ষিণ মিয়ানমার দখলে নিয়ে নিতে সক্ষম হয়। ১৮৫৩-৭৮ পর্যন্ত রাজা মিনদনের অধীনে মিয়ানমার তার অতীত গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালায়। কিন্তু ততদিনে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেছে। প্রথা অনুযায়ী তখনো রাজবংশের রাজাদের মনে করা হতো গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শাসক। কিন্তু তা কেবল পদবিতেই। রাজা মিনদন আভা রাজ্য শাসন করতেন মান্দালয়ের গোল্ডেন প্যালেস থেকে। কাঠে নির্মিত অভিজাত সাত স্তরবিশিষ্ট প্রাসাদটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। গোল্ডেন সিটির মধ্যখানে অবস্থিত প্রাসাদটিতে বসবাস করত রাজপরিবারের সদস্যরা। শহরে বসবাস করতেন মন্ত্রী, অভিজাত ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তি। শহরের বাইরে বর্গাকার দেয়াল ও দেয়ালের বাইরে ছিল পরিখা। যে মান্দালয় রাজ্যে মানুষের বসবাস, তা ছিল পরিখার বাইরে। 

থিবাউ পড়াশোনা করেছেন মান্দালয়ের মিশনারি স্কুলে। স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রেভারেন্ড ড. জন মার্কসের মাধ্যমে। রাজপরিবারের সদস্যদের স্কুলে আসার দিনগুলো সাধারণত নাটকীয় হয়। তার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ছিল না। একটা হাতির পিঠে ও সাদা ছাতার নিচে তিনি এলেন, সঙ্গে এক দল দেহরক্ষী। ক্লাসে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা টেবিল থেকে সরে মাটিতে নেমে শ্রদ্ধায় অবনত হয়। সেই মিশনারি স্কুল থেকেই থিবাউ শিখলেন ইংরেজি। কিছুটা পিয়ানো ও বর্মি ধ্রুপদি সংগীতের দরসও পেয়েছিলেন। মিশনারি স্কুলে দুই বছর থাকার পর থিবাউ চলে গেলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর অধীনে। এটাও ছিল বর্মি ঐতিহ্যের অংশই। প্রতিটি বর্মি বালককে অল্প সময়ের জন্য হলেও সন্ন্যাসের পাঠ নিয়ে তারপর ফিরে আসতে হতো সাধারণ জীবেনে। থিবাউ রয়েল গোল্ডেন মোনাস্ট্রিতে প্রায় তিন বছর কাটান। পড়াশোনা করেন বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন নিয়ে। পরীক্ষাগুলোয় তার ফলাফল ছিল অত্যন্ত ভালো, তাতে পিতা মিনদন ছিলেন উচ্ছ্বসিত। মিনদন তো ভেবেই বসেছিলেন খুব সম্ভবত থিবাউ হতে যাচ্ছে প্রতিশ্রুত ভবিষ্যৎ বুদ্ধ। তাকে সংবর্ধনা দেয়া হলো। ও তিনি চারটি ছাতা ব্যবহারের অনুমোদন পেলেন। কেবল রাজা ব্যবহার করতে পারতেন আটটি ছাতা।

আভা রাজ্যে সিংহাসনে বসার জন্য কোনো গুরুতর আইন ছিল না। রাজা নিজেই তার ওয়ারিশ নির্বাচন করতেন। যদি রাজা অন্য কোনো সিদ্ধান্ত না নেন, তাহলে প্রথম পুত্রসন্তানই রাজা হতো। যদি বড় সন্তান মারা যেতেন, তাহলে পরবর্তী সময়ে কোনো ধারাবাহিকতা ছিল না। কিং মিনদন উত্তরাধিকার হিসেবে তার ভাই কানাউংকে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু পিতার এ সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়ে দুই সন্তান ১৮৬৬ সালে বিদ্রোহ করে বসে। বিদ্রোহে কানাউং নিহত হন ও বড় ছেলে মালুন মারা যান। এ বিদ্রোহের পর রাজার ৪৮টি সন্তানের মধ্যে অবশিষ্ট ছিল ২২ জন। ততক্ষণ পর্যন্ত সবার ধারণা ছিল সিংহাসন যাবে তিনজনের যেকোনো একজনের হাতে। বড় রাজপুত্র থোনজ, বীর রাজপুত্র মেকখারা ও ধার্মিক নাইয়ুংইয়ান। সেদিক থেকে কোনো সমীকরণেই থিবাউর রাজা হওয়ার কথা ছিল না। রাজা মিনদন তার ৪১তম সন্তান থিবাউর প্রতি তৃপ্ত ছিলেন। কিন্তু তাকে কখনো সিংহাসনের বসানোর কথা ভাবেননি। বরং মনে করতেন যদি থিবাউ মসনদে বসেন, তাহলে রাজ্য স্বাধীনতা হারাবে।

ঘটনায় নাটকীয় পরিবর্তন আসে ১৮৭৮ সালে। সেবার সেপ্টেম্বরে অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে পড়লে এগিয়ে আসলেন রানী সিনবিয়ুমাশিন। তিনি রাজা ও প্রধানমন্ত্রী কিন উন মিংয়ির মতো অনেককেই বোঝাতে সক্ষম হলেন থিবাউকে রাজা নির্বাচনের কথা। তিনি ভালো করেই জানতেন আগের দফায় ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতির কথা। ফলে থিবাউয়ের জন্য অনুমোদন আনার আগে তিনি নিশ্চিত হয়ে নিলেন, ইতিহাস পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। তিনি তার সব সন্তানকে ডেকে পাঠালেন। তার আহ্বানে ছুটে আসলেন সবাই। কিন্তু বিষয়টি আঁচ করতে পেয়ে নেয়াংগিয়ান ও নেয়ুংগক প্রাসাদ ত্যাগ করলেন। বাকিদের একত্র করে গ্রেফতার করা হলো। ঘটনা কানে যাওয়া মাত্রই নড়েচড়ে বসলেন অসুস্থ রাজা। তিনি নির্দেশ দিলেন সব ছেলেকে তার সামনে হাজির করতে। সবাই সামনে আসার পর তিনি ঘোষণা করলেন, আভা রাজ্যকে তিনটি পৃথক অঞ্চলে বিভক্ত করা হবে। তিন অংশের প্রধান হবেন থোনজ, মেকখারা ও নেয়াংগিয়ান। বাকিদের বলা হলো তারা তিনটি প্রদেশের যেকোনো একটির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে। এমন নির্দেশনা দিয়েই রাজা দ্রুত তাদের রাজধানী ত্যাগ করতে বলেন। রাজা জানতেন রক্তপাত কেমন হতে পারে।

রাজার কথা মান্য করা হয়নি। মন্ত্রী কিন উন মিংয়ি নিজেই রাজ্যকে তিন টুকরা করতে নারাজ ছিলেন। তার মনে হচ্ছিল এর মধ্যে জন অসন্তোষ তৈরি হবে ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যবসা। ফলে রানী সিনবিয়ুমাশিনের সঙ্গে তিনি পরিকল্পনা করে রাজধানী থেকে দূরে যাওয়া থেকে বিরত রাখলেন। রানী চাচ্ছিলেন থিবাউকেই মসনদে আনতে। মন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি অসুস্থ রাজার সামনে যান। রাজা তখনো জানেন না সেই তিন ছেলে রাজধানী ত্যাগ করেননি। রানী রাজাকে জানালেন তিন পুত্র যেহেতু অনুপস্থিত, ফলে থিবাউকেই ইংশে-মিন বা সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করা হোক। এভাবে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৮ সালে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত হলেন থিবাউ। অসুস্থ রাজার তেমন কিছু করার ছিল না আসলে। ঠিক ওই বছরই ১ অক্টোবর মারা যান তিনি। রাজার শেষকৃত্য শেষ হয় ৭ অক্টোবর। স্বাভাবিকভাবেই রাজা মিনদনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নতুন রাজা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন থিবাউ। বিদ্রোহ আর রক্তপাতের ভয় ছিল রাজ্যজুড়েই, সে শঙ্কার মধ্যেই। ১১ অক্টোবর নতুন রাজার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলো। মূলত এরপর থেকেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা। নামের সঙ্গে যুক্ত করা হলো অজস্র উপাধি ও বিশেষণ। তিনি যেন জল, স্থল ও উদীয়মান সূর্যের শাসক। তার নাগালে চলে এল রাজকীয় সব পোশাক ও অলংকার। রাজকীয় ছাতা থেকে শুরু করে জুতা পর্যন্ত।

তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১ জানুয়ারি ১৮৫৯ সালে। সেদিক থেকে তার বয়স ২০ বছর হয়নি। থিবাউয়ের অভিষেক অনুষ্ঠিত হয় ১৮৭৯ সালের জুনের প্রথম দিকে। শাসন পরিচালনার দিক থেকে না তার কোনো প্রশিক্ষণ আছে, না কোনো প্রকার অভিজ্ঞতা। প্রতিটি সিদ্ধান্তের জন্যই ছিলেন চারপাশের অভিজ্ঞদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। এজন্যই রানী সিনবিয়ুমাশিন ও তার মন্ত্রীদের জন্যও থিবাউ ছিলেন বেশি গ্রহণযোগ্য। রাজা তো কেবল রাজা নয়, জনগণের ওপরেও তাদের মালিকানা একচ্ছত্র। কিন্তু সে একচ্ছত্র আধিপত্য এখন নামকাওয়াস্তে। কফিনের শেষ পেরেক বিঁধল থিবাউয়ের সিংহাসনে বসার কিছুদিনের মধ্যেই। সে সময় কিন উন মিংয়ি জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যৌথ পরিষদ গঠন করলেন মন্ত্রিসভার আদলে। বলতে গেলে এক রকম সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকতে চাইলেন তিনি। এর মধ্যে দিয়ে রাজার ক্ষমতা অনেকাংশেই কমে গেল।

১৮৭৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজপরিবারের আট সদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাদের মধ্যে রাজকুমার থোনজ ও মেকখারাও ছিলেন। যারা বয়সে খুব ছোট ছিল এবং যারা আগে পালিয়ে গিয়েছিল, কেবল তারাই রেহাই পায় সে হত্যাকাণ্ড থেকে। বোদ্ধামহলে ধারণা, রাজা থিবাউয়ের মা সিনবিয়ুমাশিন এ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। থিবাউ তখন পর্যন্ত মসনদে নতুন। আর তার মা তার মসনদ পোক্ত করার জন্য সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন, যদি থিবাউকে সিংহানচ্যুত করা হয়, তার ফলাফল সংশ্লিষ্ট সবার ওপরই পড়বে। আর দীর্ঘদিন থিবাউকে রাজা বানানোর প্রতিযোগিতাই এর মধ্যে তার অনেক শত্রুও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য রাজা যদিও পরে অস্বীকার করেছেন, না তিনি হত্যাকাণ্ডের কথা জানতেন, আর না তার নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই ব্রিটিশ সরকার ক্রমে নড়েচড়ে বসতে থাকে। থিবাউকে সরিয়ে নিয়াংগিয়ানকে বসানোর চিন্তা করতে থাকে সরকার। নেয়াংগিয়ান তখন পালিয়ে কলকাতায় বসবাস করছিলেন। ক্রমে ব্রিটিশ শক্তির সঙ্গে আভা রাজ্যের সম্পর্ক খারাপ হতে লাগল। এর আগে রাজা মিনদনের সময়ে ফ্রান্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব গভীর করে আভা, যা ব্রিটিশ সরকার ভালোভাবে নেয়নি। এছাড়া বার্মার ওপরের অংশকেও অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবতে থাকে। সবিশেষ দুই শক্তির মধ্যে সম্পর্ক নেতিবাচক দিকে বাঁক নেয়া। কয়েক মাসের বিবেচনার পর হুট করেই ১৮৭৯ সালের অক্টোবরে মান্দালয় থেকে সরে যায় ব্রিটিশ বাসিন্দা ও কর্মচারীরা। এমন পরিস্থিতিতে সতর্ক হয়ে পড়েন রাজা থিবাউ। দ্রুত রেঙ্গুনে দূত পাঠালেও তাতে লাভ হয়নি দিনশেষে। মিশনের ব্যর্থতা ক্রুদ্ধ করে রাজা থিবাউকে। তিনি রীতিমতো ঘোষণা করে দেন, তিনিই বাধ্য করেছেন ব্রিটিশদের মান্দালয় ছাড়তে। শিগগিরই দেশের বাকি অংশ থেকেও তাদের দূর করা হবে। শপথ নিলেন আর কখনো সাদামুখো বিদেশীদের মুখোমুখি হবেন না। এক মজলিসে রানী সুপায়ালাতও গর্বভরে এরই প্রতিধ্বনি করেছেন। এভাবে শাসনক্ষমতায় বসার এক বছরের মধ্যেই সবার কাছে প্রমাণিত হয়ে গেল ক্ষমতার দণ্ড আসলে থিবাউয়ের কাছে নেই।

আহমেদ দীন রুমি: লেখক