সিল্করুট

মান্দালয় প্রাসাদই ছিল তাদের জমকালো পৃথিবী

আলী আমজাদ

মান্দালয় প্রাসাদ ছবি: স্টিফেন জে ম্যাসন

দুর্বল শাসকদের মধ্যে থাকে উৎখাত ও গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার ভয়। সে ভয় থেকেই থিবাউ নিজেকে অন্তরীণ করেছিলেন প্রাসাদে। বার্মার শেষ রাজা থিবাউ ও রানী সুপায়ালাত তাদের প্রাসাদ থেকে বের হতেন না। কিন্তু মানুষ আর কত বন্দি থাকতে পারে! মানুষ বাইরের দিকে তাকাতে চায়। সে কারণে সোনালি প্রাসাদে থিবাউ তৈরি করেছিলেন একটি ওয়াচ টাওয়ার। এর উচ্চতা ছিল ৭৯ ফুট। মাঝে মাঝেই রাজা ও রানী সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতেন ওয়াচ টাওয়ারের শীর্ষে। সেখান থেকে দেখতেন তাদের রাজ্য। এছাড়া ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যেত মান্দালয় ও ইরাবতি নদীর প্যানোরমিক দৃশ্য। এমনকি আকাশ পরিষ্কার থাকলে শান পর্বতও দেখা যেত। মান্দালয় পর্বত ছিল প্রাসাদের উত্তর-পূর্বে।

মান্দালয় ও এর পরিপার্শ্ব নিয়ে একটি মিথ আছে। বলা হয় ভগবান বুদ্ধ এককালে মান্দালয়ে এসেছিলেন এবং তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মান্দালয়ের দক্ষিণে একটি শহর গড়ে উঠবে। তিনি আরো বলেছিলেন এ শহর বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র হিসেবে প্রকাশিত হবে। সে কথার কারণেই বার্মার রাজা মিনদন অমরপুর থেকে রাজধানী সরিয়ে নেন এবং কথিত স্থানে স্থানান্তর করেন। সেখানে তৈরি হয় প্রাসাদ। বলা বাহুল্য মিনদন ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ বৌদ্ধ। ১৮৫৭ সালের একটি দিনকে শুভ বিবেচনায় উৎসব করে জনসাধারণকে অমরপুর থেকে নিয়ে আসা হয়। মান্দালয়ের নাম দেয়া হয়েছিল রত্নপুর অর্থাৎ রত্নরাজির শহর। এটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় দুই বছর এবং ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মে এর কাজ শেষ হয়। শহরের বাইরে কাঠের একটি স্তম্ভে লেখা হয়েছিল শহর সম্পর্কে।

এ শহর ও প্রাসাদ নিয়েও আছে মিথ। বলা হয় শহর ও প্রাসাদের সদর দরজার নিচে বহু মানুষকে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়েছে। এদের আত্মা ওই দরজার পাশে ঘোরাফেরা করে এবং তারা জানে কোন ব্যক্তি অসাধু উদ্দেশ্য নিয়ে ঘুরছে এবং সেসব ব্যক্তিকেই আক্রমণ করে। এরা শহরের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত। তবে কেবল আত্মা দিয়েই তুষ্ট ছিলেন না রাজা। আয়তাকার এ শহর ও প্রাসাদের সুরক্ষার জন্য তৈরি করেছিলেন পরিখা ও চারটি সুদৃঢ় দরজা। শহরের মূল প্রবেশদ্বার ছিল পূর্ব দরজা। আর দক্ষিণ দরজা দিয়ে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হতো বলে নামকরণ করা হয় ‘সৎকারের দরজা’।

রাজকীয় সোনালি শহরের সোনালি প্রাসাদটি ছিল শহরের একদম মাঝখানে। এর চারপাশে ছিল গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ১২ ফুট উঁচু বেড়া। বেড়ার ভেতরে ৬০ ফুট চওড়া লন তৈরি করা হয়েছিল। লনের পর আবার ইটের তৈরি দেয়াল। অর্থাৎ মূল প্রাসাদকে আলাদা করা হয়েছিল সবকিছু থেকে। সোনালি প্রাসাদেরও ছিল চারটি প্রবেশদ্বার। তাদের ছিল আলাদা আলাদা রঙ। প্রাসাদে লাল রঙের পূর্ব দরজা ছিল রাজার বিশেষ ও প্রধান প্রবেশদ্বার।

প্রাসাদটি এমনভাবে তৈরি হয়েছিল যে শহর থেকে তাকে সহজেই আলাদা করা যায়। শহরের সাধারণ এলাকার তুলনায় প্রাসাদ তৈরি করা হয়েছিল উঁচু ভিতের ওপর। এছাড়া ছিল ভিন্ন গঠনশৈলী। সাধারণ বাড়িগুলো ছিল বাঁশের তৈরি এবং এর ওপর খড়ের ছাউনি। রুডইয়ার্ড কিপলিং তার মান্দালয় কবিতার শহরটির রোমান্টিক বর্ণনা দিলেও এ শহর ততটা রোমান্টিক ছিল না। পুলিশ সার্ভিসের সুবাদে ১৯২০ সালে বার্মায় পোস্টেড ছিলেন জর্জ অরওয়েল। তিনি বলেছেন, মান্দালয় ছিল পাঁচটি ‘পি’র জন্য বিখ্যাত—প্যাগোডা, পারিয়া, পিগ (শূকর), প্রিস্ট (পুরোহিত) ও প্রস্টিটিউট (দেহোপজীবিনী)।

তবে সে তুলনায় খুবই রোমান্টিক ছিল এর রাজার মূল প্রাসাদ। অনেকটাই গোবরে পদ্মফুলের মতো। প্রাসাদের মূল কাঠামো তৈরি হয়েছিল ভূমি থেকে ৭ ফুট উঁচুতে। ভিত ছিল আয়তাকার। প্রাসাদের পূর্ব প্লাটফর্মের ওপর সাতটি সোপান রাখা হয়েছিল এবং তা সাজানো হয়েছিল নানা ধরনের রত্ন দিয়ে। এর ওপরে ছিল ছাতার মতো একটি অবকাঠামো। তাতে যুক্ত করা হয়েছিল ছোট ছোট ঘণ্টা যেন বাতাস এলেই এক ধরনের মিষ্টি আওয়াজ তৈরি হয়।

বার্মার রাজার সিংহাসন ছিল সত্যিকারের সিংহ চিহ্নিত আসন। এতে ছিল নানা চিত্র ও চিহ্ন। এর মধ্যে ছিল ময়ূর কেননা এটি বার্মার রাজবংশের পরিচয় বহন করে। ময়ূর দিয়ে সূর্যকে বোঝানো হতো। বার্মার রাজারা নিজেদের মনে করত ভারতের সূর্যবংশের অনুসারী। আর সিংহটি ব্যবহার করা হয়েছিল সাহসের প্রতীক হিসেবে। সিংহাসনের ওপরের দিকে খোদাই করা হয়েছিল ৩৩ দেবতার চিহ্ন। মূলত তারা বৌদ্ধ ধর্মের ত্রয়োত্রিংশ স্বর্গের দেবতা। রাজাদের বিশ্বাস ছিল স্বর্গ থেকে দেবতারা রক্ষা করবেন এ সিংহাসন। বলা বাহুল্য, সিংহাসনে কেবল রাজাই বসতে পারতেন। তার প্রধান রানীর বসার অনুমতি ছিল রাজার ডান দিকে।

সিংহাসনের সামনেই ছিল আয়তাকার বৃহৎ সভা। এখানেই সাধারণ মানুষ ও রাজার পারিষদরা আসতেন। এর বিপরীতে ছিল পদ্ম সিংহাসন কক্ষ। সে কক্ষে মূলত রানী বসতেন তার কাছে আসা অতিথি ও নিজের বয়সীদের নিয়ে। প্রাসাদের পশ্চিম অংশ মূলত নির্ধারিত ছিল নারীদের জন্য। সেখানে প্রধান রানী, রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ নারীদের পাশাপাশি তাদের প্রধান দাসী ও পরিচারকরা থাকতেন।

প্রাসাদের পূর্ব অংশে ছিল বড় সভাকক্ষটি। সেখানে সিংহ সিংহাসনের পাশাপাশি ছিল আরো ছয়টি সিংহাসন। প্রতিটি সিংহাসনের সঙ্গে ছিল আলাদা করে একটি সিংহাসন কক্ষ। এছাড়া এ অংশেই ছিল রাজার প্রধান কোষাগার। লেখার শুরুতেই যে ওয়াচ টাওয়ারটির কথা বলা হয়েছে সেটি তৈরি হয়েছিল মূল সিংহাসন তথা সিংহ সিংহাসন কক্ষ বরাবর। এছাড়া ছিল ঝরনা দিয়ে তৈরি একটি অংশ। ইতালিয়ান একজন শিল্পীকে দিয়ে কক্ষটির দেয়ালে নানা চিত্রকর্ম আঁকানো হয়েছিল। রাজা ও রানী গ্রীষ্মকালে কক্ষটিতে সময় যাপন করতেন।

শিশমহল বাংলা ভাষায় খুবই পরিচিত। অনেক ক্ষেত্রে একে আয়নামহলও বলা হয়। মূলত কাচ ও আয়না দিয়ে তৈরি হয় এ মহল। বার্মার রাজার প্রাসাদে তা থাকবে না এমন তো হয় না। এ মহলের ভেতরের অংশ আয়না দিয়ে সাজানো এবং সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে নান রঙের কাচ। এটি ছিল প্রসাদের অন্যতম সেরা, সুদৃশ্য অংশ। এছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাচ দিয়ে শিশমহলে তৈরি করা হয়েছিল মোজাইক। পুরো প্রাসাদেই মোম জ্বালানো হতো। তবে শিশমহলের জন্য বিশেষ ধরনের মোম ব্যবহার করাই ছিল প্রাসাদের রীতি।

প্রাসাদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ছিল সুসজ্জিত বাগান। এতে নানা জাত, বর্ণ ও গন্ধের ফুলের গাছ ছিল। এছাড়া ছায়া দেয় এমন আকৃতির গাছও লাগানো হয়েছিল। রানী সুপালায়াত মাঝে মাঝেই বাগানগুলোয় চড়ুইভাতির পাশাপাশি সখীদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতেন। ফিল্ডিং ও হল তাদের থিবাউ’স কুইন বইয়ে এক পরিচারিকার স্মৃতিচারণ যুক্ত করেছেন। পরিচারিকা বলেন, ‘আমি স্মরণ করতে পারি বাঁশঝাড়ের পেছনে একটি টিলায় তিনি হাঁটু গেড়ে বসে আছেন। সবাই তাকে দেখতে পারে সহজেই। আমি তাকে একবার খুঁজে বের করি আর তিনি আমার কানে মুষ্ট্যাঘাত করেন। তাকে খুঁজে বের করার অনুমতি আসলে কারো ছিল না। শুধু রাজা যখন আমাদের সঙ্গে খেলতেন, তিনি পারতেন। আমরা যখন তাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যেতাম, তিনি হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসে নিজেকে খুব চতুর দাবি করতেন।’

রাজাদের জীবন রাজকীয়ই হতো তা সে রাজা ছোট হন বা বড়। বার্মার শেষ রাজা থিবাউ কেবল একটি প্রাসাদের মধ্যে বাস করেও যাপন করেছেন আয়েসি জীবন। রানী সুপায়ালাতের লুকোচুরি খেলা তার একটি অংশ মাত্র। বলা হয় বার্মিজদের মতো থিয়েট্রিক্যাল পারফরম্যান্স পৃথিবীতে আর কেউ দেখেনি। রাজা থিবাউ ও রানী সুপায়ালাত কখনো প্রাসাদের বাইরে পা রাখেননি। তাই প্রতি সন্ধ্যায়ই তারা প্রাসাদে কোনো না কোনো আসর বসাতেন। কখনো রাজার প্রিয় নর্তকী একাই নাচত। এ নর্তকীর রূপ ও নাচের গুণ সারা বার্মা জানত। বলা হয় একটা নরম ঘাস যেমন বাতাসে নড়ে, প্রধান নর্তকী সেভাবেই নাচতে পারতেন।

কেবল মানুষের উদ্দাম বা শৈল্পিক নৃত্যই না, কখনো কখনো আয়োজিত হতো পুতুলনাচ। বার্মার বিখ্যাত পুতুলনাচের শিল্পী মাং থা বো এজন্য রাজার প্রিয় ছিলেন। রাজা যেহেতু বৌদ্ধ ছিলেন, তিনি জাতকের গল্প পছন্দ করতেন। কিন্তু সে গল্প কেবল শুনে নয় তিনি দেখেও আনন্দ নিতেন। জাতক কথা অভিনয়ের জন্য ছিল আলাদা দল। তারা বিচিত্র পোশাক নকশা করে সেসব পরে রাজার সামনে জাতকের নানা গল্প অভিনয় করে দেখাত। আর সেসবে যখন রাজা আগ্রহ হারাতেন, তখন অভিনয় হতো দেশ বিদেশের নানা নায়কের বীরত্বের গল্প। এ অভিনয় দেখারও ছিল বিলাসী রীতি। রাজা ও  রানী তক্তপোশের ওপর কুশনে হেলান দিয়ে বসতেন। সেবার জন্য হাজির থাকত বহু পরিচারিকা। আর রাজা রানীর পাশে থাকত সোনার পানদান। একজন পরিচারিকা থাকতেন কেবল চুরুট নিয়ে।

ধূমপান সেকালে খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল। আর রাজপরিবার তো ইচ্ছামতো করত। এর মধ্যে রানী সুপায়ালাতের ধূমপান বিখ্যাত। কথিত আছে, রানী সুপায়ালাতের ছিল ৩০০ পরিচারক। তিনি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন এবং তার পরিচারকরা প্রথমেই তাকে এক কাপ চা দিয়ে ঘুম ভাঙাত। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হতো স্নানাগারে। সেখানে তিনি সময় নিয়ে স্নান সারার পাশাপাশি শুনতেন নানা গল্প। প্রতিদিন তিনি বিচিত্র নকশার পোশাকে নিজেকে সাজাতেন। সাজগোজের প্রতি তার ছিল বিশেষ ঝোঁক। এজন্য পরিচারকরাও তাকে নানা সাহায্য করত। তার পরিচারিকাদের ৫০ পাউন্ড করে পারিশ্রমিক দেয়া হতো প্রতি মাসে। কিন্তু প্রাসাদের ভেতরে তাদের অবশ্যই নগ্নপদে থাকতে হতো। এটিই ছিল রীতি। অবশ্য প্রত্যেক পরিচারকের থাকত নিজস্ব কামরা।

পরিচারকদের সঙ্গে সুপায়ালাতের সম্পর্ক নিয়ে তার নাতনির স্মৃতিচারণ উল্লেখ করার মতো। তিনি বলেন, ‘তিনি (সুপায়ালাত) যদি কাউকে পছন্দ করতেন তাকে দামি উপহার দেয়া হতো। এর মধ্যে থাকত দামি রেশম, সাটিন ও মখমলের কাপড়। এছাড়া নানা সময় তিনি বড় বাক্সে করে রত্নরাজি নিয়ে আসতেন। এর মধ্যে দামি রত্ন ও স্বর্ণ থাকত। পরিচারিকাদের তিনি দান করতেন অকাতরে। তারা প্রত্যেকে দুহাত ভরে যা নিতে পারতেন তা-ই নিতে পারতেন।’ 

প্রাসাদে থিবাউর চেয়ে সুপায়ালাতের জোর ক্ষেত্রবিশেষে বেশি খাটত। তবে রাজা থাকতেন নিজের কাজে। এর মধ্যে থিবাউ ও সুপায়ালাত প্রতি সকালে ও সন্ধ্যায় প্যাগোডায় প্রার্থনা করতে যেতেন একসঙ্গে। প্রাসাদ থেকে তারা বের হবেন না তা নিজেরাই নিশ্চিত করেছিলেন। তাই বছরে উৎসবে ও কয়েকটি সময়ে রাজা থিবাউ তার প্রাসাদের বারান্দা থেকেই জনতার উদ্দেশে ছুড়ে দিতেন অর্থ। প্রাসাদে বসেই হতো সব সিদ্ধান্ত। নানা আলাপ আলোচনা। বিশেষত ভিক্ষু ও সন্ন্যাসীদের সঙ্গে। থিবাউ ও সুপায়ালাতের পৃথিবীই ছিল এ প্রাসাদ। এটিকেই তারা করেছিলেন ক্ষমতা ও রাজ্যের কেন্দ্র।

তথ্যসূত্র:

১. The King in the Exile: The Fall of the Royal Family of Burma, Sudha Shah

২. Fielding, Thibaw’s Queen, pp. 19, 65–66.

৩. Princess Hteik Su Gyi Phaya’s (Rita) letter to Mr Symington dated 22 December 1970, British Library, London, MSS Eur D 1156/7.

আলী আমজাদ: লেখক