সিল্করুট

গির্জা ও প্রাসাদের গায়ে তার কীর্তির জয়গান

মুহম্মদ আল মুখতাফি

সারধানার ‌ব্যাসিলিকা অব আওয়ার লেডি অব গ্রেসেস গির্জা

বে গম সামরু বেঁচে ছিলেন ক্ষমতার চর্চা আর নেতৃত্বের মধ্যে। তার জীবনযাত্রায় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রবাহ ছিল স্পষ্ট। ভারতের হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্য এবং ইউরোপীয় খ্রিস্টীয় সংস্কৃতির মিশেল ঘটেছে জীবনাচারে। সেই ছাপ ফুটে উঠতে দেখা যায় তার সময়ের স্থাপত্যকলায়ও। তার রাজ্যে স্থানীয় স্থাপত্যের সঙ্গে যেন মিলেমিশে একাকার ইউরোপীয় স্থাপত্য। প্রথম দর্শনেই চোখ আটকে যায় সাংস্কৃতিক ও জাতিগত বৈচিত্র্যে। বেগম সামরুর কোনো সন্তান ছিল না। ফলে সৃষ্টিকর্মগুলোকেই নিজের নাম প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাহিত হওয়ার উপায় হিসেবে হয়তো বিবেচনা করেছিলেন।  

দিল্লিতে বেগম সামরুর বাসভূমির অবস্থানটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। হাতের নাগালেই জামা মসজিদ, চাঁদনি চক, রেড ফোর্ট, ব্রিটিশ কোয়ার্টার ও ফতেহপুর মসজিদ। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহ তাকে ১৮০৬ সালে এ বিস্তৃত অংশ দিয়ে দেন সন্তুষ্টির দলিল হিসেবে। বরাদ্দকৃত ভূমিতে মনোরম প্রাসাদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন বেগম সামরু, যা শেষ হয় ১৮১৫ সালে। প্রাসাদের পাশেই তৈরি হয় বাগান। উনিশ শতকের মানচিত্রে জায়গাটি পরিচিতি পায় ‘বাগে বেগম সামরু’ নামে। তার একদিকে ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধির বাসস্থান, অন্যদিকে মোগল সম্রাটের বাসস্থান। যেন অবস্থানই তুলে ধরে দুটি শক্তিধর পক্ষের সঙ্গে বেগম সামরুর মৈত্রীকে। প্রাসাদটি ছিল রেড ফোর্ট থেকে জামা মসজিদের দিকে যাওয়া চাঁদনি চকের ঠিক পাশে। অর্থাৎ অনায়াসেই তৎকালীন দিল্লির প্রধান যোগাযোগ পথের ওপর ছিল নজর। প্রাসাদের সামনের দিকটাতে রয়েছে করিন্থিয়ান কলাম। দুটি বাঁকা সিড়ি সামনের আঙিনা থেকে উঠে গেছে ওপরের দিকে। গোটা প্রাসাদ এমনভাবে তৈরি, যেন গ্রীষ্মকালে ঠাণ্ডা ও বৃষ্টির মৌসুমে শুকনা থাকে। সামনের দিকটাতে চিত্রশিল্পীরা স্থাপন করেছেন নানা শিল্পকর্ম। ১৮২০ সালের আঁকা একটি চিত্রকর্মে দেখা যায়, প্রাসাদের সামনে ইউরোপীয় ও ভারতীয়দের ভিড়। সেখানে সংগীতকার ও কৌতূহলী দর্শকের পাশাপাশি রয়েছে নানা পেশার মানুষ। ভিড়ে প্রধান রাস্তা আর প্রাসাদের আঙিনার পার্থক্য অস্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রাসাদের ঠিক শীর্ষে দাঁড়িয়ে আছেন বেগম। সঙ্গে ভারতীয় ও ইউরোপীয় কর্মী। পুরোদস্তুর আধুনিকতার পরিচয় দেয়া হয়েছে স্থাপত্যের ক্ষেত্রে। প্রাসাদের ভেতরটাও যে পিছিয়ে ছিল না, তার প্রমাণ পাওয়া যায় মুহম্মদ আজমের আঁকা ছবিতে। সেখানে সভাসদ নিয়ে মুখে হুঁকা ধরে রাখা বেগমকে দেখা যায়। পেছনে ইউরোপীয় ধাঁচের জানালা ও কারুকাজ। সে সময় অন্দরমহলকে যে বিনোদন কিংবা অবকাশ যাপনের চেয়ে রাজনৈতিক ও সামারিক আলোচনার কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, সেটার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বেগমের মৃত্যুর পর ডাইস সম্বার দিল্লি ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে দেয় প্রাসাদটি। ব্যাংকের নিয়মিত কাজের পাশাপাশি ইংরেজ ম্যানেজার বেরেসফোর্ডের বাসভবন হিসেবেও ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভবন। বেগমের প্রাসাদকে কোঠি বলে চিহ্নিত করতে চান ঐতিহাসিকরা। আর কোঠিতে ইউরোপীয় ও ভারতীয় শৈলীর সমাবেশ ঘটানো ছিল উনিশ শতকের দিল্লিতে নতুন গড়ে ওঠা অভিজাত শ্রেণীর স্থাপত্য প্রবণতা। বেগম তার প্রতিনিধিত্ব করছে এক্ষেত্রে। প্রাসাদটি আজ ভাগীরথ প্যালেস নামে পরিচিত, যাকে পুরনো মানুষরা বেগম সামরু কি হাভেলি নামেই ডাকেন। 

বেগম সামরু তার দ্বিতীয় প্রাসাদটি তৈরি করেন তার রাজধানী সারধানায়। মৃত্যুর মাত্র দুই বছর আগে ১৮৩৩-৩৪ সালে নির্মাণ করা হয় প্রাসাদটি। স্বাভাবিকভাবেই বেগমের দিল্লির প্রাসাদের তুলনায় এটি অনেক বড়। কারণ দিল্লির প্রাসাদ ছিল ব্রিটিশ ও মোগলদের মতো দুটি বৃহৎ শক্তির আওতার মধ্যে। বিপরীতে সারধানায় ছিল কেবল তারই সার্বভৌম কর্তৃত্ব। দিলকুশা কুঠি নামে পরিচিত প্রাসাদটি ৭৫ একর ভূমির একটি এলাকায় নির্মিত হয়। পুরো এলাকাটি পাঁচিল দিয়ে পরিবেষ্টিত। প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে ছিল প্রাসাদটি। জীবনের বড় সময়টা এখানেই কাটিয়েছেন তিনি। ১৮০৩ সালে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেন, তখন কোম্পানিকে তার সৈন্য ব্যবহারের অধিকার দেয়া হয়। বিনিময়ে তিনি সারধানার ওপর সার্বভৌম কর্তৃত্ব লাভ করেন। এ চুক্তিতেই তার মৃত্যুর পর সম্পত্তি কোম্পানির অধীনে চলে যাবে বলে শর্ত জুড়ে দেয়া ছিল। বেগম কোম্পানির কাছে কয়েকবার আপত্তি তুললেও শর্তটি উঠিয়ে নিতে রাজি হয়নি কোম্পানি। ফলে সন্তানহীন বেগম সে অর্থে সম্পদ সঞ্চয়ের দিকে মন দেননি। বরং দীর্ঘশ্বাসকে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রাসাদ তৈরির সময়। সারধানা প্রাসাদে এমন বহু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা দিল্লি প্রাসাদেও ছিল। কিন্তু এটি দিল্লির প্রাসাদের চেয়েও আড়ম্বরপূর্ণ। ভবনের ঠিক মাঝখানে ডাইনিং হল। পাশেই সংযুক্ত বিভিন্ন কক্ষ। রুমগুলোয় স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন বেগমের নিকটাত্মীয় ডাইস সম্বার। সম্বারের দুই বোন ও তাদের ইউরোপীয় স্বামীরাও থাকত পাশাপাশি কক্ষে। এরা সবাই স্থায়ীভাবেই বসবাস করত সারধানায়। দিল্লি ও সারধানার স্থাপত্যের বাইরে আরো একটি নজির গুরগাঁওয়ের প্রাসাদ। দীর্ঘদিন ঝারসা-বাদশাহপুর পরগনার জায়গির ছিলেন বেগম। তার নিদর্শন হিসেবে ঝারসা এবং গুরগাঁওয়ের মাঝখানে তৈরি করেন মনোরম বাসভবন। তার মৃত্যুর পর ব্রিটিশ আমলে এটি ক্যাম্প অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রায় ২০০ বছর অতিক্রম করে এখনো প্রাসাদটি এখনো যথেষ্ট ভালো অবস্থায় আছে। 

বেগম সামরুর সেরা স্থাপত্যকর্ম হিসেবে মাথা উঁচু করে আছে ‘‌ব্যাসিলিকা অব আওয়ার লেডি অব গ্রেসেস’। চার্চটির দেয়ালে শিশুকে কোলে নিয়ে মাতা মেরি। এখান থেকেই নামটা রাখা। কিন্তু স্থাপনাটি বেগম সামরু চার্চ হিসেবেও পরিচিত। ১৮২১ সালের ৫ ডিসেম্বর স্থাপন করা হয় ভিত্তিপ্রস্তর। প্রায় এক দশক ধরে চলা কাজ শেষ হয় ১৮২৯ সালে। নির্মাণে ব্যয় হয় ৪ লাখ রুপি। নির্মাণে নেতৃত্ব দেন ইতালীয় স্থপতি আন্তোনিও রেগেলিনি। তিনি ভিসেনজা থেকে প্রকৌশলবিদ্যার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। প্রচলিত আছে, রেগেলিনি চার্চের নকশা তৈরি করেছেন রোমে অবস্থিত সেন্ট পিটার্স চার্চের অনুকরণে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তাদের মধ্যে খুব একটা মিল নেই। বরং চার্চটির বেশি মিল রয়েছে আগ্রায় অবস্থিত রোমান ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে, যা আকবরের চার্চ নামে পরিচিত। ১৫৯৯ সালে সম্রাট আকবর দরবারের জেসুইটদের সম্মানে চার্চটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। সারধানায় অবস্থিত চার্চটি আকবরের নির্মিত চার্চের থেকেও আকারে বড়। তবে বেশকিছু বিষয়ে অনুকরণ করা হয়েছে। সামনের চত্বর, কেন্দ্রীয় গম্বুজ ও চ্যাপেলের কাঠামোর দিক থেকে দুটি চার্চের মধ্যে সাদৃশ্য বিস্তর। চার্চের দেয়ালে একটি ফারসি ও একটি লাতিন ফলকে খোদিত আছে বেগমের প্রশংসা। লাতিন ফলকে তাকে জোয়ানা এবং ফারসি ফলকে তাকে জেবুন্নেসা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। পৃথক ফলকে রয়েছে স্থপতি রেগেলিনির নাম। এটি ঔপনিবেশিক ভারতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্যাথলিক চার্চ। সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে বারোখ যুগের অনুকরণে। নির্মাণ উপকরণ হিসেবে স্থানীয় ইট ব্যবহৃত হলেও যুক্ত হয়েছে অলংকরণপূর্ণ পলেস্তারা। দিল্লির ম্যানসন যেমন ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য নির্দেশ করে, ঠিক তেমনটাই নির্দেশ করে সারধানার চার্চটি। চার্চটি যেন বেগমের সঙ্গে ভ্যাটিকানের যোগসূত্র। বাসভবনের মতো চার্চেও দেখা যায় বিভিন্ন ঘরানার স্থাপত্যের মিশেল। খ্রিস্টীয় বেল টাওয়ারের বদলে গ্রহণ করা হয়েছে ইসলামী মিনারের ধারণা। পলেস্তারা দেখলে মনে হবে ইসলামী স্থাপত্যের মুকারনাসের কথা। কেন্দ্রীয় বেদিতে পিয়েত্রা দুরা নকশা, যা মোগল আমলের স্থাপত্যকলার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তাজমহল ও রেড ফোর্টেও ব্যবহৃত হয়েছে পিয়েত্রা দুরা কৌশল। এভাবে চার্চের গঠনে মিশে গেছে ভারতীয়, ইসলামী এবং ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক উপাদান।

চার্চকেও তিনি ক্ষমতার একটা সূচক হিসেবেই দেখেছেন, যার মধ্য দিয়ে পোপের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র তৈরি হয়। ১৮৩৪ সালের জানুয়ারিতে তিনি পোপ ষোড়শ গ্রেগরির আশীর্বাদ চেয়ে দূত পাঠান। ভ্যাটিকান তার উপঢৌকনের স্বীকৃতি দেয়। তাকে ভারতবর্ষের গুরুত্বপূর্ণ ক্যাথলিক প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করে। চার্চের প্রথম বিশপ ছিলেন ইতালি থেকে আসা জুলিয়াস সিজার স্কোটি। হিন্দু ও মুসলিম অধ্যুষিত উপমহাদেশে ক্যাথলিক প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে কাজ করে। কোম্পানির আধিপত্যের নিচে আলাদা করে ইউরোপের সঙ্গে সংযোগ তৈরি হয় এর মাধ্যমে। একদিকে তিনি প্রতি রোববারে চার্চে হাজির হতেন। অন্যদিকে ঈদ এবং দিওয়ালির সময়েও প্রজাদের পাঠাতেন উপঢৌকন। আবার মিরাটে অ্যাংলিকান চার্চ তৈরিতেও তিনি অনুদান দেন। অর্থাৎ একদিকে যেমন ক্যাথলিক যোগাযোগ বজায় রেখেছেন, অন্যদিকে নন-ক্যাথলিক আচারগুলোয়ও বজায় রেখেছেন যোগাযোগ। তিনি যে তার প্রভাবকে ভারতবর্ষ ছাপিয়ে সম্প্রসারণ করতে চেয়েছেন, তার আরেকটা উদাহরণ ফরাসি রাজা ফিলিপের সঙ্গে যোগাযোগ। মৃত্যুর বছর খানেক আগে তিনি লুই ফিলিপের কাছে পোর্ট্রেট পাঠান। রাজাও ছবি প্রাপ্তির স্বীকৃতি হিসেবে নিজের একটি পোর্ট্রেট পাঠিয়ে দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা হাতে পাওয়ার আগেই মারা যান বেগম। মৃত্যুর এক দশক পর জীবিত উত্তরাধিকারী ডাইস সম্বার রোমে ভ্রমণ করেন। ইতালীয় ভাস্কর আদামো তাদোলিনির মাধ্যমে বেগমের একটা ভাস্কর্য তৈরি করান। ১৮৪৮ সালে সারধানায় আনা হয় সে শিল্পকর্মটি। বেগমকে সিংহাসনে বসা অবস্থায় দেখা যায় সেখানে। যেন প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মানুষের মিলনস্থল তার দরবার।

মুহম্মদ আল মুখতাফি: লেখক