সিল্করুট

ইউরোপীয় রোমান্সে বেগম সামরু

মাহমুদুর রহমান

দিল্লির চাঁদনি চকে বেগম সামরুর প্রাসাদ

ইতিহাসের বহু চরিত্র এসেছে উপন্যাসে। আর আঠারো-উনিশ শতকের উপন্যাস মানেই ছিল রোমান্স। চরিত্রদের বাছাই করা হতো বাস্তব থেকে, কিন্তু গল্পের খাতিরে যোগ করা হতো অনেক কাল্পনিক বিষয়। আর যেহেতু ভারত তখন ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ, ভারতকে তারা দেখত অদ্ভুত একটা অঞ্চল হিসেবে। সেখানকার মানুষদের সম্পর্কে ছিল আজব সব ধারণা। সে রকম ধারণা প্রভাব রেখেছে ইউরোপীয়দের লেখায়। ভারত ও ভারতের মানুষ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তারা নিজেদের মতো করেই গল্প তৈরি করেছেন। ঐতিহাসিক চরিত্র বেগম সামরুর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। ঐতিহাসিক চরিত্র হলেও তার ওপর পড়েছে ইউরোপীয় রোমান্সের প্রলেপ।

বেগম সামরুর জীবনটা উপন্যাসের মতোই। অর্থাৎ তার জীবন নিয়ে সাধারণভাবে লেখা হলে সেটাই একটা উপন্যাস হয়ে যায়। জীবন শুরু হয়েছিল একজন বাইজি হিসেবে। এরপর ইউরোপীয় মার্সেনারির উপপত্নী হন। উপপত্নী, কেননা রাইনহার্ট সম্বার বেগম সামরুকে বিয়ে করেছিলেন কিনা তার কোনো প্রমাণ নেই। বয়সে ৩০ বছরের বড় রাইনহার্ট একটা সময় সামরুর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। মজার ব্যাপার, সামরু তার আসল নাম না। সারধানার শাসক হিসেবে যে বেগম সামরুর নাম পাওয়া যায় সেই সামরু নামটি মূলত ‘সামরুর বেগম’ (সম্বারের বেগম) থেকে এসেছে। কিন্তু এ কথা সত্য যে রাইনহার্ট সম্বারের জায়গির ভোগ করতে শুরু করে সামরু—যার নাম ফারজানা বলে রায় দিয়েছেন অনেকে—একসময় সেখানকার সার্বভৌম শাসক হন। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এ রাজ্য শাসন করেন।

এহেন সামরুকে নিয়ে ব্রিটিশ ও ফরাসি ঔপন্যাসিক এমনকি বিখ্যাত ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার হেনরি স্লিম্যান তার স্মৃতিকথায় একটি অধ্যায় রেখেছেন। এর বাইরে সামরুকে পাওয়া যায় তিনটি ফিকশন। এগুলো হলো স্যার ওয়াল্টার স্কটের দ্য সার্জন’স ডটার (১৮২৭ খ্রি.), উইলিয়াম ব্রোউন হকলির দ্য নচ (১৮৩৫ খ্রি.) ও জেমস ব্লেইথ প্যাটনের বিজলি দ্য ডান্সার (১৮৯৮ খ্রি.)। এগুলোর মধ্যে ইতিহাসের বেগম সামরুকে খুঁজতে যাওয়া ভুল, কারণ ঔপন্যাসিকরা তার নাম বা জীবনের একটা অংশকেই ধরেছেন। অরেকটি মজার ব্যাপার হলো বেগম সামরু একজন আগ্রহজাগানিয়া চরিত্র হলেও তাকে নিয়ে লেখার সংখ্যা কম। এর কারণ হিসেবে বলা যায় ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতে ঠগী, টিপু সুলতান, ভারতের ধর্ম ও রাজনীতি ছাড়াও পলাশীর যুদ্ধ ও সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে লেখার সুযোগ ছিল। কোনো এক নাচনেওয়ালিকে নিয়ে ইউরোপীয় লেখকরা বেশি মন দেবেনই বা কেন।

তবু তিনটি ফিকশনে সামরু এসেছেন। স্লিম্যানের লেখায়ও তার প্রসঙ্গ আছে। কিন্তু এসব লেখায় ইউরোপীয়দের অভিজাত মনোভাব স্পষ্ট। কলোনি তৈরি করা মনিবদের দৃষ্টিতে তারা মেপেছেন সামরুকে এবং তার সময়ের ভারতকে। সব ক্ষেত্রে ভারতকে বোঝার চেষ্টা করেননি। সামরুকেও না। মূলত ভারতের জটিল সংস্কৃতির মধ্যে তারা নানা সময়েই খেই হরিয়েছেন। সেখান থেকে দেখা যায় সামরুকে দেখা হয়েছে একজন সুযোগসন্ধানী নারী হিসেবে। অন্যদিকে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপীয়দের অভিজাত মনোভাব। ভারতকে কলোনি ও ভারতের মানুষকে নিজেদের তুলনায় হীন মনে করতেন তারা।

তবে সেখানেই শেষ না। আলোচ্য তিন উপন্যাসে সরাসরি প্রভাব রেখেছে ইউরোপীয় রোমান্সের প্রচলিত ধারা। সে অনুসারে গালগল্পের রেশ আছে। এর মধ্যে স্যার স্কট সবচেয়ে পরিচিতি, প্রশংসিত ও সম্মানিত লেখক। তিনি কিন্তু সামরুকে সরাসরি আঁকেননি। সামরুকে অনুপ্রেরণা ধরে একটি চরিত্র তৈরি করেছেন। তার উপন্যাস দ্য সার্জন’স ডটার। এতে একটি চরিত্র আছে মাদার মন্ট্রেভিল ও বেগম মোতি মহল। এ চরিত্র মূলত সারধানার রানীর অনুকরণেই তৈরি। ভিনসেন্ট স্মিথই সর্বপ্রথম বিষয়টি চিহ্নিত করেন। স্কট সরাসরি বেগমের নাম না নেয়ারও একটি যৌক্তিক কারণ আছে। স্কটের উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশ হয় ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে। বেগম সামরু তখনো জীবিত। তাই স্কট কোনো ঝামেলায় যেতে চাননি। কিন্তু তার উপন্যাসেরই বহু সূত্র ধরে সামরুর সঙ্গে স্কট নির্মিত চরিত্রের মিল পাওয়া যায়।

দ্য সার্জন’স ডটারে আমরা অ্যাডেলা মন্ট্রেভিলের দেখা পাই। সে কোঁৎ দে লালির রেজিমেন্টে কর্মরত এক স্কটিশ সার্জনের কন্যা। বসবাস পণ্ডিচেরিতে। এখানে সামরুর সঙ্গে তার মিল পাওয়া যায় না। এর পরই দেখা যায় তিনি এক ফরাসি সেনার বিধবা। এরপর একসময় ভারতে সে একটি ছোট রাজ্যের রানী হয়ে ওঠে। অ্যাডেলার স্বামী কোনো বেতনভুক ফরাসি সেনা না এবং রাইনহার্টও তা ছিলেন না। এরপর স্কট দেখান বেগম মন্ট্রেভিল হায়দার আলীর দলে তার সেনা নিয়ে যোগ দেন। এখানেও সামরুর সঙ্গে তার মিল ও অমিল দুই-ই আছে। সামরুর সেনাবাহিনী ছিল এবং তিনি অভিযানও করেছেন। তবে তা মোগল সেনার সঙ্গী হয়ে, টিপু সুলতানের সঙ্গে নন। এছাড়া সামরু ব্রিটিশদের সঙ্গে সবসময় সদ্ভাব বজায় রেখে চলেছেন।

উইলিয়াম হকলির দ্য নচ একটি ছোট গল্প। এটি প্রকাশ হয় ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে, সামরুর মৃত্যুর এক বছর আগে। হকলি ব্রিটিশ ভারতে ১০ বছর একজন সহকারী জজ হিসেবে কাজ করেছেন। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়েন তিনি। হকলির গল্পে বেগম একজন খলনায়িকা। তার বাহিনীর এক সৈন্যের সঙ্গে এক বাইজির প্রেমের খবর চাউর হলে বেগম সেই বাইজিকে মেরে পুঁতে ফেলেন। গল্পটা অনেকটাই সেলিম-আকবর-আনারকলি গোত্রের। কিন্তু মজার বিষয়, স্কট ও হকলি প্রায় একইভাবে দেখেছেন বেগমকে। স্কটের গল্পেও তিনি খলনায়িকা, যদিও এতটা না। কিন্তু হকলি ও স্কটের দেখা ও প্রকাশের ভঙ্গি কাছাকাছি ধরনের।

হকলির গল্পটি প্রকাশ হয়েছিল বেনামে। লেখক নিজের নাম দেননি। তাই গল্পটির খোঁজ অনেকের কাছেই ছিল না। কেবল মাইকেল ফিশার লিখেছেন এ বিষয়ে। তবে হকলির চেয়েও আড়ালে পড়ে গেছেন জেমস প্যাটন। তার বিজলি দ্য ডান্সার নিয়ে কোনো আলোচনা সহজে নজরে পড়ে না। না পড়ার আরো কারণ আছে। কেননা গল্পটা কোনোভাবেই সামরুকে নিয়ে নয়। এতে তার উল্লেখ আছে মাত্র দুবার। তবে যেভাবে সামরুর নাম এসেছে তা গুরুত্বপূর্ণ। উপন্যাসের মূল গল্প নবাব বাহাদুর খান ও এক নাচনেওয়ালি আফরানানকে নিয়ে। আফরানান নাচকেই পছন্দ করে। সে নবাবের ভালোবাসা, আভিজাত্যের প্রলোভনে না ভুলে শেষ অবধি নাচকেই আপন করে নেয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর উপন্যাসে এমন ক্লাইম্যাক্স দেখা যায় না। সেদিক থেকে উপন্যাসটি ভিন্ন ধারার। এর বাইরে সামরুর উপস্থাপনাও ভিন্ন। সামরুর উল্লেখ আসে আফরানান যখন সিদ্ধান্ত নিতে বসে তখন। উপন্যাস বলে সে তখন ‘‌সারধানার সেই রানীর কথা মনে করল, যে একদিন নাচনেওয়ালি ছিল।’

মজার ব্যপার, উপন্যাসে সারধানার রানীকে সামরু বলে উল্লেখ করা হয়নি। তাকে ‘‌কুইন অব সারধানা’ বলা হয়েছে। নাম বলা হয়েছে জয়নব। ধারণা করা যেতে পারে, জয়নব আসলে জেব-উন-নিসা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই লিখেছিলেন জেমস। তবে এটা স্পষ্ট যে এখানেও সামরুর রাজস্ব, শাসন বা সেনা চালনা মনে রাখেননি ঔপন্যাসিক। তার কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ছিল সামরুর নাচনেওয়ালি পরিচয়, যে কিনা একদিন রানী হয়েছিল।

স্কটের উপন্যাসে বেগম মন্ট্রেভিল সামান্য পরিমাণে খল। অ্যাডেলার পরিচয় বা পরিচিতি এমনভাবে দিয়েছেন তিনি, যেখানে মনে হয় নারীটি বহুদিন যৌন সংসর্গবঞ্চিত ছিল। এক ধরনের যৌন ঈর্ষা কাজ করত তার মধ্যে। হকলির গল্পে বিষয়টি আরো স্পষ্ট। তিনি বলছেন, বেগম তার দলের সৈন্যের সঙ্গে নাচনেওয়ালির প্রেম মেনে নিতে পারেননি। কারণ তিনি নিজে ওই আনন্দবঞ্চিত ছিলেন। বাস্তবে রাইনহার্ট সম্বার ছিলেন সামরুর চেয়ে বছর ত্রিশের বড়। এরপর তিনি মারাও যান। আবার সামরু একসময় পালাতেও চেয়েছিলেন আরেক অফিসারের সঙ্গে। সেসব মাথায় রেখেই হয়তো লেখকরা এসব চিন্তা করে সামরুকে কল্পনা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে সামরু ছিলেন একজন যোদ্ধা নারী। শাহ আলমের সময় শিখ বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করেছিলেন তিনি। এছাড়া গোলাম কাদিরের বিরুদ্ধেও মোগলদের সহায়তা করেন।

পরবর্তী সময়ে বেগম সামরুকে নিয়ে আলোচনা যারাই করেছেন তারা সামরুকে দেখেছেন একজন দৃঢ়চেতা নারী হিসেবে। ইতিহাসে সামরুর বর্ণনা থেকে জানা যায় মাত্র সাড়ে চার ফুট উচ্চতা ছিল তার। কিন্তু এর মধ্যেও নিজে সৈন্য চালনা করেছেন। এছাড়া ছোট হলেও একটা রাজ্য চালিয়েছেন তিনি নিজ হাতে। ব্রিটিশদের সঙ্গে রেখেছিলেন সদ্ভাব। কিন্তু ইউরোপীয় রোমান্স সেসব বুঝত না। সে সময়ের লেখকরা চরিত্রকে দেখত নিজের মতো করে। সামরুকেও তারা দেখছেন নিছক এক ভারতীয় নারী হিসেবে, যার মধ্যে ছিল ঈর্ষা ও পরে এসেছিল ক্ষমতার দম্ভ। তবে স্লিম্যানের স্মৃতিকথায় বেগম সামরুর অন্য পরিচয় পাওয়া যায়। সেটি বাস্তবের সঙ্গে মেলে। এর কারণ স্লিম্যান রোমান্স লেখেননি।

এসবের বাইরেও অনেকে মনে করেন, জুল ভার্নের বেগম’স ফরচুন লেখার পেছনে সামরুর সম্পদ ও তার কিংবদন্তি কাজ করেছে লেখকের অনুপ্রেরণা হিসেবে। কেননা সামরুর নিজের কোনো সন্তান ছিল না, সারধানার সম্পদ নিয়ে তৈরি হয়েছিল নানা রকম কিংবদন্তি। তবে জুল ভার্নের গল্পটি সামরুর সম্পদের কিংবদন্তির চেয়েও অনেক বেশি কল্পিত। সামরুকে এর সঙ্গে যুক্ত করা যায় না। সামরু থেকে গেছেন ইউরোপীয় ওই তিন লেখকের কল্পিত চরিত্র হিসেবেই।

মাহমুদুর রহমান: লেখক