সিল্করুট

বাংলা অঞ্চলে লবণ উৎপাদনের সনাতন পদ্ধতি

মোহাম্মদ রবিউল হোসাইন

স্ফুটন প্রক্রিয়া

ব্রিটিশদের আগমনের অনেক আগেই বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে লবণ শিল্প বিকশিত হয়েছিল। মোগল আমলে লবণ বণিকরা সমাজে যথেষ্ট মর্যাদা পেতেন। বাংলায় গড়ে উঠেছিল লবণ উৎপাদনের নিজস্ব পদ্ধতি। লবণ উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল লবণাক্ত পানি ও মাটি। প্রথমে দুটি উপাদানকে মিশিয়ে ভালোভাবে ছেঁকে নেয়া হতো। পরিস্রাবণ থেকে পাওয়া ব্রাইনকে (লবণ পানি) ফুটানো হতো। তারপর শুকিয়ে নিলেই উৎপন্ন হতো লবণ। লবণ উৎপাদনের সনাতন প্রক্রিয়া চারটি ধাপে সম্পন্ন হতো—কাঁচামাল প্রক্রিয়াকরণ, পরিস্রাবণ, স্ফুটন ও শোষণ। লবণের প্রতিটি উৎপাদন ক্ষেত্রের দায়িত্বে থাকতেন একজন ‘মলঙ্গি’। তিনি তার অধীনদের সাহায্যে লবণ উৎপাদন করতেন।

কাঁচামাল প্রক্রিয়াকরণ

মলঙ্গি প্রথমে লবণাক্ত মাটির জন্য জমি নির্বাচন করতেন। তারপর এটিকে তিনটি সমান আয়তাকারে ভাগ করতেন। প্রতিটি ভাগকে বলা হতো চত্বর। তারপর সযত্নে সব আগাছা সরানো হতো। তারপর পাঁচ ইঞ্চি গভীর করে মাটি খনন করতেন। তাতে জমা হতো লবণাক্ত পানি। জুলাই ও আগস্টে জমি বারবার চষা হতো। ফলে পানির লবণাক্ত উপাদান জমিতে মিশত। পর্যাপ্ত লবণাক্ত হলে মই দিয়ে মাটি সমান করা হতো। পাঁচ-ছয়দিন রোদে শুকানোর পর পৃষ্ঠতলে বের হতো লবণাক্ত উপাদানের ছোট ও নরম গুটি। সাত-আটজন শ্রমিক পা দিয়ে সেগুলো গুঁড়ো করে দিতেন। তারপর আরো সাত-আটদিন রোদে শুকালে লবণাক্ত মাটি কণায় পরিণত হতো। তখন একটি খুরপি দিয়ে কণাগুলো চেছে নেয়া হতো। লবণাক্ত পানির জন্য একটি জলাধার খনন করা হতো। ছোট নালার মাধ্যমে এটি নদী বা খালের সঙ্গে সংযুক্ত থাকত। জোয়ারের সময় উপকূলবর্তী নদী বা খালের লবণাক্ত পানি জলাধারে জমা হতো।

পরিস্রাবণ

এ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত ফিল্টারটি ছিল মাটির তৈরি। পিরামিড আকৃতির। এর উপরে একটি গামলা সংযুক্ত থাকত। গামলার তলদেশ ছিল মাটি, ছাই ও বালি দিয়ে তৈরি। মাঝখানে একটি ছিদ্র থাকত। তার ঠিক নিচে মাঝখানে ছিদ্রযুক্ত একটি মাটির পাত্র থাকত। এটিকে বলা হতো ‘কুনরি’। একটি ফাঁপা বাঁশের এক প্রান্ত গামলা ও কুনরির ছিদ্রে আটকানো থাকত। অন্য প্রান্ত আরেকটি ছিদ্রযুক্ত মাটির পাত্রের সঙ্গে আটকানো থাকত। এটিকে বলা হতো ‘নাদ’। ফাঁপা বাঁশের মাধ্যমে গামলা থেকে কুনরি হয়ে পরিস্রুত লবণাক্ত পানি নাদে চলে যেত। কুনরির উপরিভাগে বাঁশের একটি পাতলা কাঠামো সংযুক্ত থাকত। এতে দুটি স্তর ছিল। একটি স্তরে থাকত খড়। অন্য স্তরে লবণাক্ত মাটি।

প্রথমে দুজন কুলি চত্বর থেকে লবণাক্ত মাটি দিয়ে গামলা পূর্ণ করতেন। তারপর সে মাটি পা দিয়ে আঘাত করতেন। তখন মাটি থেকে নির্গত লবণাক্ত পানি ফাঁপা নলের মধ্য দিয়ে পরিস্রুত হয়ে ব্রাইন হিসেবে নাদে জমা হতো। ব্রাইন ২৪ ঘণ্টা রেখে দেয়া হতো। এতে অপরিশোধিত অংশ তলানিতে চলে যেত।

স্ফুটন

একটি মাটির চুলার কেন্দ্রে থাকত বয়লার। প্রায় পাঁচ হাত ব্যাসের অর্ধবৃত্তাকার বয়লারটির ওপর পিরামিড আকারে ২০০-২২৫টি ছোট মাটির পাত্র সাজানো থাকত। সেগুলো মাটি দিয়ে আটকানো থাকত। প্রতিটি পাত্রে প্রায় ১ কেজি ব্রাইন থাকত। সব সাজিয়ে চুলা জ্বালানো হতো। একজন মলঙ্গি মাটির পাত্রগুলোয় ব্রাইন ঢালতে থাকতেন। লবণ ও পানির অনুপাত ৩:১ হওয়া পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলত। ব্রাইনকে ফুটানোর মাধ্যমে দানাদার লবণ পেতে ৪-৫ ঘণ্টা লাগত।

শোষণ

একটি বাঁশের কাঠামোর ওপর লবণের পাত্রগুলো রাখা হতো। এতে লবণের জলীয় উপাদান ফোঁটায় ফোঁটায় মাটিতে পড়ে যেত। তারপর কাঠি দিয়ে লবণের ডেলাগুলো গুঁড়ো করে দেয়া হতো। তারপর সেগুলো একটি গোলাঘরের মাটির মেঝেতে এক সপ্তাহ ফেলে রাখা হতো। মাটি লবণের কণায় থাকা পানি শুষে নিত। তারপর গোলাঘর থেকে বের করে খোলা জায়গায় লবণ স্তূপ করে রাখা হতো। এর তলদেশে মাটি বা কাদার একটি স্তর থাকত। এ স্তর লবণে থাকা অবশিষ্ট আর্দ্রতা ভালোভাবে শুষে নিত। পাওয়া যেত সাদা ও ঝরঝরে লবণ। 

ওপরে বর্ণিত প্রক্রিয়ায়ই সাধারণত লবণ উৎপন্ন হতো। তবে অঞ্চলভেদে সামান্য ব্যতিক্রমও পরিলক্ষিত হতো।

মোহাম্মদ রবিউল হোসাইন: লেখক