সিল্করুট

ভোরেই শুরু হতো ব্যাংকের কার্যক্রম

মোহাম্মদ রবিউল হোসাইন


গ্রাহকের জন্য ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের দরজা খোলা হতো সকাল ৯টায়। কিন্তু ব্যাংকের প্রাত্যহিক কার্যক্রম শুরু হতো আরো আগেই। গ্রীষ্মকালে সকাল ৬টায়, শীতকালে সকাল ৭টায়। বলা হচ্ছে, আঠারো শতকের কথা।

ব্যাংক অব ইংল্যান্ড প্রথমে প্রিন্সেস স্ট্রিটের গ্রোসার’স হলে অবস্থিত ছিল। সেখান থেকে ১৭৩৪ সালে ব্যাংকটি থ্রেডনিডল স্ট্রিটে স্থানান্তর করা হয়েছিল। এর ঠিক বিপরীতে ছিল লন্ডনের বাণিজ্য কেন্দ্র ‘দ্য রয়াল এক্সচেঞ্জ’। ‘এক্সচেঞ্জ অ্যালি’, ‘ইস্ট ইন্ডিয়া হাউজ’ ও ‘সাউথ সি হাউজ’ও কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থিত ছিল। এক্সচেঞ্জ অ্যালিতে লন্ডনের শেয়ারবাজারের অধিকাংশ কার্যক্রম পরিচালিত হতো। থ্রেডনিডল স্ট্রিট থেকে সহজেই লন্ডনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়কে যাওয়া যেত। এসব রাস্তার মধ্যে চিপসাইড, কর্নহিল, লিডেনহল, ওল্ড জিউরি ও লোম্বার্ড স্ট্রিটের নাম উল্লেখযোগ্য। গুরুত্বপূর্ণ সব বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান এসব সড়কে অবস্থিত ছিল। বড় বড় শপিং মলগুলোও ছিল এসব এলাকায়। সবদিক বিবেচনা করে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সুবিধার্থে থ্রেডনিডল স্ট্রিটে অফিস স্থানান্তর করা ছিল ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ১৭২৪ সালে ১৫ হাজার পাউন্ড দিয়ে জায়গাটি কিনেছিল ব্যাংক অব ইংল্যান্ড কর্তৃপক্ষ। নতুন এলাকায় ব্যাংকের কার্যক্রমের আরো বিস্তার ঘটে। ইংল্যান্ডের অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনায় এটি মুখ্য স্থান দখল করে নিয়েছিল। সংগত কারণে ভোরেই ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করতে হতো।

ব্যাংকের প্রধান দারোয়ানের কাছে থাকত প্রবেশদ্বারের চাবি। তিনি ব্যাংকের সীমানায় অবস্থিত একটি বাসায় থাকতেন। ঘুম থেকে উঠে তিনি ব্যাংকের গেটগুলো খুলে দিতেন। গেটের বাইরে অপেক্ষারত থাকত দুই শ্রেণীর কর্মচারী। ‘আউট-টেলার’ ও ‘হাউজ পোর্টার’। আউট-টেলাররা ছিল ক্লার্ক। গ্রাহকদের বাড়িতে বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে বকেয়া বিল নিয়ে আলোচনা করা ছিল তাদের কাজ। গ্রাহকদের কাছ থেকে তারা বিল সংগ্রহ করত। দুপুরের মধ্যেই তাদের এ কাজ শেষ করার তাড়া থাকত। পোর্টারদের কাজ ছিল অফিস ও সংলগ্ন এলাকা পরিষ্কার করা। দৈনন্দিন কাজের জন্য অফিস প্রস্তুত করা। তাই তারা বেশ ভোরেই অফিসে উপস্থিত হতো।

যথাসময়ে অফিসে উপস্থিত হওয়ার জন্য আউট-টেলার ও পোর্টাররা ৫-৬টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠত। আউট-টেলারদের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সব উপকরণে সুসজ্জিত ঘর বরাদ্দ ছিল। এর ভাড়া হিসেবে তাদের সপ্তাহে মাথাপিছু ২ শিলিং ৬ পেন্স গুনতে হতো। সে সময় ব্যাংক অব ইংল্যান্ডে তাদের প্রাথমিক বেতন ছিল বার্ষিক ৫০ পাউন্ড। দীর্ঘদিন চাকরি করলে পর্যায়ক্রমে বেতন বাড়ত। কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও একাগ্রতার স্বীকৃতি হিসেবে কপালে কিছু পুরস্কারও জুটে যেত। সাধারণত ঘরে নাশতা তৈরি করার সময় তারা পেত না। অফিসে যাওয়ার পথেই নাশতা সেরে নিতে হতো। লন্ডনের রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের খাবার পাওয়া যেত। কিন্তু এসব কর্মচারী সাধারণত রুটি ও চা দিয়েই তাদের সকালের নাশতা সারত।

পোর্টাররা প্রথমে অফিসের ভেতর, বাইর ও রাস্তা পরিষ্কার করত। এটি ছিল বেশ সময়সাপেক্ষ ও ক্লান্তিকর কাজ। পোর্টাররা পাথরের মেঝেগুলো প্রথমে ঝাড়ু দিত। তারপর মুছত। কাঠের মেঝেগুলো বালি দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করত। আসবাবপত্রের ধুলো ঝেড়ে পলিশ করত। তাছাড়া আসবাবপত্র প্রয়োজন অনুসারে পরিচর্যা ও মেরামত করত পোর্টাররা। ঘড়িতে দম দিত। সব জায়গায় চর্বিমিশ্রিত মোমবাতি জ্বালিয়ে দিত। এগুলোকে বলা হতো ‘টেলো ক্যান্ডল’। এ মোমবাতিগুলো বিশ্রীভাবে পুড়ত। দুর্গন্ধ বের হতো। মোম গলে তলায় পুরু আস্তর জমা হতো। পোর্টাররা মোমের আস্তরণ পরিষ্কার করত। যুক্তরাজ্যে অফিসগুলো গ্রীষ্মে বেশ গরম ও শীতে খুবই ঠাণ্ডা থাকত। তাই শীতকালে বড় স্টোভ ও চুল্লিতে আগুন জ্বালানোর মাধ্যমে অফিসের তাপমাত্রা বাড়িয়ে কাজের উপযোগী করত পোর্টাররা। আগুন জ্বালানোর জন্য তারা কয়লা বয়ে আনত। আঠারো শতকে লন্ডনে তাপমাত্রা বাড়ানোর মুখ্য উপায় ছিল কয়লা। তা থেকে ঘন কালো ধোঁয়া ও তীব্র বাষ্প নির্গত হতো। তাই নতুনভাবে প্রজ্বালিত করার আগে চুল্লি ও স্টোভগুলো পরিষ্কার করত পোর্টাররা। কয়লা আনা, প্রক্রিয়াজাত করা, চুল্লি পরিষ্কার করা ও আগুন জ্বালানোর কাজ করতে গিয়ে পোর্টারদের সারা শরীরে কালি লেগে যেত। ব্যাংকের যাবতীয় আবর্জনা তারা ডাস্টবিনে ফেলে আসত। এসব আবর্জনার মধ্যে থাকত খাবারের উচ্ছিষ্ট, ছাইভস্ম, বাতিল কাগজপত্র ও অন্যান্য ভাঙা জিনিসপত্র। মলমূত্রের কুণ্ড পরিষ্কার ও পয়োনিষ্কাশনের জন্য কয়েকজন পোর্টার নির্ধারিত ছিল। তারা মলমূত্র বালতিতে ভরে গাড়িতে বোঝাই করত। তবে কাজটি দিনে করা আইনত নিষিদ্ধ ছিল। রাতে করতে হতো। এ ধরনের কাজ খুবই অপ্রীতিকর ও শ্রমসাধ্য ছিল। তৎকালে লন্ডনের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা বেশ খারাপ ছিল। তাই পোর্টারদের কাজটি না করে কোনো উপায় ছিল না।

পোর্টাররা যখন পরিচ্ছন্নতা ও অফিস প্রস্তুতের কাজে ব্যস্ত থাকত, তখন আউট-টেলাররা সারা শহর ঘুরে বিল সংগ্রহ করত। তাদের ‘ব্যাংকের বার্তাবাহক’ বলা হতো। আউট-টেলারদের কাজে বেশ ঝুঁকি ছিল। কারণ তাদের প্রচুর নথি ও বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে ঘুরতে হতো। তাই তাদের কাজটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সব বড় শহরের রাস্তায় তাদের উপস্থিতি ছিল এক চিরাচরিত দৃশ্য। তাদের ছাড়া বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের নিয়মিত ছন্দ বজায় রাখা সম্ভব ছিল না। পেমেন্ট ব্যবস্থা সাবলীল রাখতে আউট-টেলারদের কোনো বিকল্প ছিল না। ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে অর্থের ইলেকট্রনিক ট্রান্সফার রীতিতে পরিণত হয়। তার পর থেকে আউট-টেলারদের গুরুত্ব কমতে থাকে।

আঠারো শতকে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডে ১০-১৪ জন আউট-টেলার কাজ করত। প্রয়োজন অনুসারে তাদের সংখ্যা বাড়ানো হতো। সোম-রবি প্রতিদিন তাদের কাজ করতে হতো। আউট-টেলারদের দায়িত্বে থাকতেন ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের বিল শাখার একজন ক্লার্ক। তিনি আগের দিনই বকেয়া বিলগুলো বাছাই করে একটি লোহার সিন্দুকে রাখতেন। সকালে তিনি আউট-টেলারদের বিলগুলো বুঝিয়ে দিতেন। তারা বকেয়া বিল আদায় করে তাকে জমা দিলে তিনি তা ব্যাংকে জমা করতেন।

ব্যাংক নোট ছাপানোর কাজ তদারকি ও রাজস্ব বিভাগের সঙ্গে ব্যাংকের সম্পর্ক পরিচালনার জন্য কয়েকজন কেরানি বরাদ্দ ছিল। প্রতিদিন সকালে একজন কেরানি সেদিনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রিন্টিং প্লেটগুলো বুঝে নিতেন। ব্যাংক নোট ছাপানোর কাজ শেষ হতে প্রায় ৩টা বাজত। ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি প্রিন্টিং প্লেটগুলো চোখের আড়াল হতে দিতেন না। ছাপানোর কাজ শেষ হলে তিনি প্রিন্টিং প্লেটগুলো ব্যাংকে নিয়ে আসতেন। রাজস্ব বিভাগের সঙ্গে ব্যাংকের সম্পর্ক পরিচালনা করতেন তিনজন কেরানি। তারা প্রতিদিন রাজস্ব বিভাগে যেতেন। তাদের মাধ্যমে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সরকারকে ক্যাশিয়ার সার্ভিস দিত। রাজস্ব সংগ্রহ, ঠিকাদার ও সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধে তারা সরকারি কেরানিদের সাহায্য করতেন। তারা সরকারের ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ হওয়া অর্থ গ্রহণ ও পরিশোধ করতেন।

ওপরে আলোচিত কর্মচারী ও ক্লার্করা ছাড়া ব্যাংকের অন্যান্য কর্মচারী ৯টায় অফিসে উপস্থিত হতেন। সর্বাগ্রে উপস্থিত হওয়া কর্মচারী প্রধান হিসাবরক্ষকের বাসভবন থেকে লোহার সিন্দুকের চাবি সংগ্রহ করতেন। কর্মচারীরা ব্যাংকের হলঘরে গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলতেন। তার প্রস্তুতি হিসেবে তারা ব্যাংকের স্টোর থেকে খাতা, কলমসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করতেন। স্টোরের দায়িত্বে থাকতেন একজন ক্লার্ক।

ব্যাংকের পেমেন্ট বিভাগে যারা কাজ করতেন, তাদের বলা হতো ‘ইন-টেলার’। প্রতিদিন তারা ওয়্যারহাউজ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যাংক নোট সংগ্রহ করতেন। ৯টার আগেই তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হতো। তাদের কাজ তদারক করতেন একজন সুপারভাইজার। তাকে সাড়ে ৮টার মধ্যে অফিসে উপস্থিত হতে হতো। ট্রেজারি বুক ও এক্সচেকার বুকের দায়িত্বে থাকতেন ডেপুটি হিসাবরক্ষক।

লন্ডনে প্রচুর ব্যবসায়ী ছিলেন। শহরটির বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। সারা দিনের জন্য ব্যাংকটিকে প্রস্তুত করতেন পোর্টাররা। আর আউট-টেলার, ক্লার্ক, হিসাবরক্ষক ও ইন-টেলাররা মিলে ব্যাংকের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড ও গ্রাহকদের সামলাতেন।

মোহাম্মদ রবিউল হোসাইন: লেখক